Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

দাঁড়িয়ে আছি অতীত আর বর্তমানকে সঙ্গে নিয়ে, দিশা দেখাক আশার আলো

উৎসব আছে, রয়েছে তার উদ্‌যাপনও। তবে বদলে গিয়েছে অনেক কিছু। অতীত বাঙালিয়ানায় কিছু অনুষঙ্গের কথা লিখছেন মণিদীপা নন্দী বিশ্বাসযৌথ বাড়ির ঘরে ঘরে প্রণাম-কোলাকুলির ঘটা। কারও কাছে নারকেল তক্তি, নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু অথবা মুড়ির মোয়া আর কোনও জেঠিমা বা কাকিমার ঘরে হয়তো ঘুগনির দারুণ গন্ধ। মুখ মিষ্টির পর ওই ঝাল ঝাল স্বাদ!

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৯ ০৪:৩০
Share: Save:

সত্তরের দশক। বিজয়ার প্রণাম শুরু প্রথম বাড়ির ঠাকুরঘরের প্রাঙ্গণ থেকে। বয়সে বড় থেকে ক্রম অনুসারে। একটু আগেই শেষ হয়েছে ঠাকুর বিসর্জন। সকলে ঠাকুরমণ্ডপ থেকে শান্তিজল নিয়ে এসেছে। যাঁরা বাড়িতে আছেন, যেতে পারেননি, তাঁদের জন্য ঠাকুরের পিতলের গ্লাসে আনা হয়েছে শান্তিজল। ছিটোনোও হয়ে গিয়েছে। মণ্ডপের ঠাকুর বসানোর জায়গা টিমটিমে আলোয় ম্যাড় ম্যাড় করছে। বুকের ভিতর কষ্ট তো দানা বাঁধছেই। কিন্তু সেই বিজয়ারও অন্য মাধুর্য ছিল।

যৌথ বাড়ির ঘরে ঘরে প্রণাম-কোলাকুলির ঘটা। কারও কাছে নারকেল তক্তি, নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু অথবা মুড়ির মোয়া আর কোনও জেঠিমা বা কাকিমার ঘরে হয়তো ঘুগনির দারুণ গন্ধ। মুখ মিষ্টির পর ওই ঝাল ঝাল স্বাদ! সে কি ভোলা যায় কখনও! আর ক্রমান্বয়ে প্রণামের ঘটা। কোনও আত্মীয়ের বাড়ি রাতে আর যাওয়া হল না নিজের বাড়ির প্রথা সেরে নিতে নিতে। পরদিন সকালের অপেক্ষা। হয়তো সে বাড়িতে যাঁকে প্রণামের জন্য যেতে হবে বাবার নির্দেশে, তাঁকে প্রণামের ইচ্ছেটা কেমন তলানিতে। নানা পারিবারিক গোলমালে বা সেই আত্মীয়ের দুর্বিনীত আচরণে। কিন্তু সে কথা উল্লেখই করা যাবে না! যেতেই হবে! প্রণাম করে নাড়ু খেয়ে বা নিয়ে চলে আসতে হবে।

এর দু’দিন পর থেকেই শুরু হবে দূরদূরান্তে চিঠি দিয়ে বিজয়ার প্রণাম জানানোর পালা। অফিস ফেরত বাবার হাতে এক পাঁজা ইনল্যান্ড লেটার আর পোস্টকার্ড। একেবারে ছোট তখন। পাঁচ কি ছয়। যেখানে চিঠি লিখব, সেখানটা নির্ধারণ করে পেনসিল স্কেলে দাগ কেটে দেওয়া হয়েছে, লেখা হয়ে গেলেই পেনসিলের দাগগুলো মুছে দেওয়া হবে। লিখে চলেছি একের পর এক চিঠি— মালদহে, কলকাতায়, দিনহাটায়, হলদিবাড়িতে। চিঠি লেখার গৎ বা নিয়ম তখনই তো শেখা। প্রথম লাইনে শ্রীচরণেষু, পরের লাইনে খানিকটা ছেড়ে চিঠি শুরু। মনে আছে, প্রথম দিকে বাবার বলে দেওয়া কথাগুলো লিখতাম। পরে দেখলাম, নিজেই কখন শিখে গিয়েছি। বিজয়ার পরদিন থেকে ড্রেসপরা পিওন ক্রিং-ক্রিং সাইকেলের সুধীরকাকুর অপেক্ষা। একই ইনল্যান্ডের প্রথম অংশে বাবা, পরের পাতায় মা, শেষ পৃষ্ঠায় আমি লিখেছি। আবার পাঁজা পাঁজা চিঠির তাড়াও জমা হচ্ছে টেবিলে। অন্তত দুই থেকে তিন সপ্তাহ এই চিঠির যাওয়া-আসা চলত। পরে নব্বইয়ের দশকে আমার কন্যাকেও হাতে ধরে ইনল্যান্ড লেটার বা কাগজে পেনসিলে দাগ টেনে চিঠি লেখা শিখিয়েছি। সেও পেয়েছে তার দাদুর বাড়ির সুন্দর সুন্দর সব কালির, সুন্দর হস্তাক্ষরের চিঠি। পরের দশকের মাঝামাঝি মনে আছে ছেলেকে বারদু’য়েক লিখিয়েছিলাম। সেও নিয়মিত পেত দাদুর চিঠি। কিন্তু কবে যে বিজয়ার চিঠি তার শেষ চন্দ্রবিন্দুটি এঁকেছিল, এখন আর মনে নেই। এখন তো মা দুর্গার ঘটে বিসর্জনের আগেই টুং-টাং মেসেজ আসতে থাকে। হাতের লেখার মকশো আর কেউ করে না। আসলে, দরকার ফুরিয়েছে। কেউ বাংলা টাইপে, কেউ রোমান হরফে বাংলায় বিজয়ার প্রণাম-শুভেচ্ছা জানাচ্ছে অথবা বিভিন্ন মেসেজ ফরোয়ার্ড করে দিচ্ছে। সেকেন্ডে কাজ সেরে নিচ্ছে। কেউ কারও বাড়িমুখো আজকাল আর হয় না। রাস্তাঘাটে শিক্ষক শিক্ষিকাদের দেখলে ছাত্রছাত্রী প্রণাম করে বটে, তবে অনেকেই বিশেষ রীতি অনুযায়ী হাঁটু পর্যন্ত ছুঁয়ে মাথা তোলে। আবার এর বৈজ্ঞানিক যুক্তিও দিতে চেষ্টা করে, ধুলোভরা পা ছোঁয়ার কী আছে! আর জুতোয় হাত দেওয়াই-বা কেন!

আসলে, এ সব শোনা বা ভাবার অবকাশ আমাদের এখন নেই। আমরা অবশ্য একই ভাবে ঝুঁকতে ভালোবাসি। প্রাণ থেকেই মাথা নত হয়। ফলে, আমরা ঠিক এ কালের হতে পারি না আর সত্যি বলতে কি মাথা নীচু করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করব যাঁদের, তাঁদের সংখ্যাও দিন দিন কমে আসছে। আমরা শূন্যস্থান পূর্ণ করে দেখছি, মূল্যবোধ খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। তা মানুষের প্রবৃত্তির বদল ঘটিয়ে মানুষকেও বদলে ফেলছে।

আসলে, আমরা সবাই রাজা। এ ভাবনা সর্বত্র কি ভাল! প্রজন্মের পর প্রজন্ম যখন কোমর সোজা করে দাঁড়িয়ে থেকে হ্যান্ডসেটেই বিজয়া সেরে নেয়, তখন মনে হয়, যতই জিমনাশিয়াম বাড়ুক বা বাড়িতে সুস্থতার চর্চা চলুক, ওদের ভিতরে ভিতরে কি সংকীর্ণতা জায়গা নিচ্ছে? নমনীয়তা কমছে? পারস্পরিক স্বচ্ছ-সুন্দর-সাম্মানিক সম্পর্কগুলো কি আলগা হয়ে পড়ছে! মা, বাবা, কাকু, কাকিমা, দাদু ঠাম্মা, জেঠু, জেঠিমার টান কমে গিয়ে ফ্রেন্ড সার্কেল প্রধান হয়ে উঠছে! বিজয়ার দিনটুকু কিংবা লক্ষ্মী পুজো বা দীপাবলিতে ওরা আসবে, এই প্রত্যয়ে ভর করে অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলো বেশ ক'বছরের অভিজ্ঞতায় আর অপেক্ষা করেনও না। যদি ভুল করে কেউ আসে, সে আশায় তাকে তোলা থাকে গুড়ের কড়াপাকের নাড়ু অথবা মুড়ি-মুড়কির কৌটো বা সাদা নারকেল তক্তির পাত্র।

শহর ঘুরছে নাগরিক বলয়ে। প্রচ্ছন্ন বাঙালিয়ানা ভেঙে পড়ছে কথায়, ভাষায়, চালচলনে। সংস্কার নাই-বা থাকল, গুরুজনের প্রতীক্ষায় সামান্য ছুঁয়ে আসা আঙুল বেঁচে থাকার স্পৃহা বাড়িয়ে দেয় যে! যে বোধ কম বয়সে বুঝি কারওরই থাকে না। তখন হাওয়ার মতন, উড়তে থাকা ঘুড়ির মতন, নতুন দৌড়তে শেখা বাছুরের মতন ছুটতে ছুটতে চেনা আদরের সম্পর্কগুলো তোলা থাকে কুলুঙ্গীতে। বিজয়া আসে, লক্ষ্মীপুজোর কোজাগরী চাঁদ আলো করে রাখে অন্ধকার বাড়িঘর, পায়ে পায়ে তিনিও উঁকি দিয়ে ফেরেন ঘরে ঘরে। প্রদীপ জ্বলে আজও। ভোগের গন্ধে ম-ম ঠাকুরঘর। শুধু নমনীয় হওয়ার, আশীর্বাদ নেওয়ার ইচ্ছেটুকু যেন মরে গিয়েছে!

মনে মনে সংকোচন বাড়ছে। কিন্তু বিরাট গভীর প্রসারতা আজও তো বুকের ভিতর সুরের ঢেউ তোলে! অতীত ছবি চিত্রকরের মতো চোখের সামনে না ভাসলে শব্দ, অক্ষর, ভাবনা, কল্পছবি সবই তো যন্ত্রের সাহায্যে পাখা মেলবে! বুকের ভিতর জন্ম নেবে কেমন করে সেই দাদু-ঠাকুমার গল্পগাথা! সুধীরকাকুর চিঠির থলে আর আসে না বিজয়ার চিঠি বয়ে নিয়ে। লাল ডাকবাক্স পাড়ার মোড়ে এক আধখানা এখনও দেখা যায়। আর পোস্ট অফিসের বাইরে লাগানো থাকে নিয়ম করে দু’তিনটে লালচে পোস্টবাক্সও। এ স্মৃতিটুকু থাক‌! শ্রদ্ধা-ভালবাসার দৃঢ় বন্ধন!

বিশ্বাস না অভ্যাস— জানি না! উৎসব উৎসবই! তাই মনে হয়, বেজে উঠুক সুর আর জ্বলুক আলো! আমরা দাঁড়িয়ে আছি অতীতের কিছু ভাললাগা আর বর্তমানকে সঙ্গে নিয়ে! চলার পথের সামনে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার মতো থাকুক আশার আলো, সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাঙালিয়ানার দীপ্ত দীপাবলি!

(লেখক কোচবিহারের সুনীতি অ্যাকাডেমির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja Festival Vijaya Dashami
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy