ছবি: সংগৃহীত
স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ঘুরিয়ে প্রশ্নটা তুলে দিয়েছিলেন দুর্গাপুজোর আগে, যখন তিনি প্যান্ডেলে ঢোকার জন্য ‘ভিআইপি’ কার্ড প্রথা বন্ধ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন ক্লাবগুলিকে। এ-হেন পরামর্শের কারণ, কলকাতা তথা রাজ্যের দুর্গাপুজো যতই বড় হচ্ছে, যতই থিম, বাজার ও পুরস্কারের দেখনদারি বাড়ছে; ততই তার থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সব কিছু ঠিক থাকলে হয়তো আগামী বছর কলকাতার দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমা পাবে। কিন্তু তার আগেই প্রশ্ন উঠছে মানুষের যে উপচে পড়া ভিড় এখানকার দুর্গাপুজোকে অসাধারণ করে তুলছে, তাঁরা কতটা গুরুত্ব পান ক্লাবগুলির কাছে? বা প্রশাসনের কাছে?
সত্যিটা হল, ঠিক যে ভাবে তাঁরা ভোটপুজোয় স্রেফ একটা সংখ্যা হিসেবে বিবেচিত হন, গড়পড়তা বড় পুজোতেও তাঁদের ভূমিকা একই, পুজোকমিটিকে সংখ্যার অহঙ্কার উপহার দেওয়া! তাই শহরের পুজোয় চরম নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের ভিড়ের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়, কোনও হেলদোল হয় না। তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে প্যান্ডেলে প্রবেশের পর তাঁদের জন্য বরাদ্দ হয় দু’এক মিনিট, বা তারও কম। এই সময়ের মধ্যে কখনও স্বেচ্ছাসেবকের, কখনও নিরাপত্তারক্ষীর কনুইয়ের গুঁতো বা লাঠির বাড়ি খেয়ে তাঁদের বেরিয়ে আসতে হয়।
কলকাতার পুজোকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়ে এই কি তাঁদের প্রাপ্য? এ প্রশ্ন তুললে পুজো সংগঠকরা ভিড়ের চাপ, মোবাইলে ছবি তোলা এবং নিজস্বী তোলার প্রবণতার ফলে তৈরি বিশৃঙ্খলাকে দায়ী করেন। এই সবের সমাধান তো তাঁদেরই খুঁজে বার করতে হবে। আগেকার দিনে ভবানীপুরের মুক্তদল ক্লাবে ঠাকুর দেখার অভিজ্ঞতা মনে আছে, এক দল দর্শনার্থীকে একসঙ্গে প্যান্ডেলে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হত, নির্দিষ্ট সময় পর তাঁদের বার করে পরের দলকে ঢোকানো হত। এই মডেলটা পুজোকমিটিগুলি ভেবে দেখতে পারে। হয়তো দর্শনার্থীদের অপেক্ষা সামান্য দীর্ঘতর হবে, কিন্তু তাঁরা অপেক্ষার মর্যাদা পাবেন। পাশাপাশি তাঁরা ভাবতে পারেন, ভিআইপি দর্শকদের জন্য জায়গা কমিয়ে সাধারণ মানুষের জায়গা বাড়ানোর, থিমগুলিকে আরও ভাল ভাবে দেখানো যায় কি না। বহু খরচ করে, ঢাকঢোল বাজিয়ে যে থিম ক্লাবগুলি তৈরি করে, তার অধিকাংশই মানুষের কাছে অল্প সময়ে পৌঁছয় না। অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো কেউ আলোর ঝাড়, কেউ প্যান্ডেলের কাজ দেখে পরের প্যান্ডেলে যাওয়ার রাস্তা ধরেন।
একই প্রবণতায় ভুগছে প্রশাসনও। পুজোর কয়েক দিন লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় সামলে রাস্তায় যানবাহনের গতি কিছুটা হলেও বজায় রাখা বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ সামলাতে যে কোনও রাস্তা যখন তখন খুলব আর বন্ধ করব, এমন হওয়া অভিপ্রেত নয়। কিন্তু এই ঘটনাই এ বারের পুজোয় বার বার ঘটেছে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে রাস্তায় দাঁড়ানো পুলিশকর্মীর নির্বিকার মুখ নীরবে বুঝিয়ে দিয়েছে, কারণ জানার অধিকার মানুষের নেই। এমন ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোনও শহরে ঘটলে প্রশাসন তথা পুলিশ নাগরিকদের অধিকারভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হত।
এ তো গেল যাঁরা রাস্তায় বেরোচ্ছেন ঠাকুর দেখতে, তাঁদের সমস্যার কথা। আর যাঁরা বেরোচ্ছেন না? যদি মনে করেন এই ক’দিন ভিড়ের চাপ থেকে বাঁচতে নিজের বাড়িতে থাকবেন, তা হলেও আপনার বাঁচোয়া নেই। রাস্তা বন্ধ করে, হয়তো আপনার বাড়ির জানালা দরজাকে প্রায় আটকে তৈরি হয়েছে প্যান্ডেল। কেউ অসুস্থ হলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া এভারেস্ট জয়ের চেয়েও কঠিন। সম্প্রতি ৭৬ বছরের এক প্রবীণ উত্তর কলকাতা থেকে জানালেন যে তাঁর বাড়ির চার পাশের যাবতীয় রাস্তা বিভিন্ন প্যান্ডেলে আটকানো— তাঁর চিন্তা ৬৯ বছরের অসুস্থ স্ত্রীকে হঠাৎ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলে কী করবেন। তার ওপর আছে গভীর রাত অবধি নিয়ম ভেঙে মাইকের উপদ্রব। এমন পরিস্থিতি শহর ও শহরতলির অলিতে গলিতে।
আরও সমস্যা: বহু প্যান্ডেলই মাসের পর মাস রাস্তা বা ফুটপাত জুড়ে সাধারণ মানুষকে চরম সমস্যায় ফেলে। কলকাতার মতো ঘিঞ্জি শহরে রাস্তায় পুজো করতে হলে কী ভাবে সাধারণ মানুষের অসুবিধা কমিয়ে, প্রয়োজনে প্যান্ডেলের স্থান ও মাপ খানিকটা রদবদল করে, প্যান্ডেল তৈরির সময় কমিয়ে পুজো করা যায়— এ সব কথা এখন ভাবার সময় এসেছে।
আসলে ক্লাবগুলি ও প্রশাসনকে বুঝতে হবে যে, পাড়ার বারোয়ারি পুজো থেকে ক্রমেই পাড়া দূরে সরে যাচ্ছে। ঢুকে আসছে বাজার। আর বাজার তৈরির ব্র্যান্ডিং-এর বৃত্তে সাধারণ মানুষের জায়গা নেই। তাঁদের ভূমিকা নেই পুরস্কারের হিসেবনিকেশেও। এই পরিস্থিতি যদি না পাল্টায়, তবে কাল নয়তো পরশু দুর্গাপুজো এবং একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা হাজার কোটি টাকার গোটা বাজারটাই ভেঙে পড়তে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy