অর্থনীতির উদ্ধারে বেকারত্বের মোকাবিলা জরুরি
বৃহত্তর অর্থনীতির সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানগুলি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বেশির ভাগ ভাষ্যকারই সঠিক ভাবে শেষ ত্রৈমাসিক বা এপ্রিল থেকে জুন মাসের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর বৃদ্ধির পরিসংখ্যানকেই বেছেছেন। এর প্রেক্ষিত হিসেবে অবশ্যই কাজ করেছে কোভিড অতিমারির কারণে আগের বছরের লকডাউন পরিস্থিতির অর্থনীতির উপরে প্রভাব। সুতরাং সেই সঙ্কটের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি যেখানে আশাব্যঞ্জক ভাবে ২০ শতাংশ, জিডিপি সেখানে গত বছরের তুলনায় ৯ শতাংশ কম। কিন্তু সরকারের মুখপাত্র খুবই দুর্বল যুক্তি দেখিয়ে বলতে চেয়েছেন যে, ২০২০- ’২১-এর ‘নিচুভিত্তি’কে মনে রেখে দেখলে বৃদ্ধির হার আশাতীত রকমের ভাল।
বেশ দৃঢ় বিশ্বাসযোগ্যতা দেখিয়ে তাঁরা যুক্তি দিয়েছেন যে, উৎপাদনে বাধকতা না থাকলে বৃদ্ধির হারও বেশি হত। বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক চিপ উৎপাদন কম হওয়ায় তা গাড়ি তৈরি ও বিক্রির ব্যবসার উপর প্রভাব ফেলে। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ভোগ্যপণ্য এবং শিপিং কন্টেনারের উৎপাদন ও ব্যবসাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। এপ্রিল থেকে অগস্টের মধ্যে শেষোক্ত বস্তুটির বাণিজ্যে বৃদ্ধি ছিল দেখার মতো। প্রায় ৬৭ শতাংশ। জিডিপি-র বিপরীতে রফতানি গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি বেশ আশ্বস্ত করার মতোই। এই বৃদ্ধির কিছু অংশ এসেছে বিশ্বময় অর্থনৈতিক কাজকর্মে গতি ফিরে আসার কারণে এবং বাকিটুকু অবশ্যই পণ্যমূল্যের বৃদ্ধির ফল হিসেবে। যা-ই হোক না কেন, পণ্য রফতানি এক দশক থমকে থাকার পরে এই বৃদ্ধি এক আনন্দ সংবাদ তো বটেই। এবং এ থেকে এক সাধারণ সমীকরণে উপনীত হওয়া যায় যে, অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধি তখনই সম্ভব, যখন রফতানির গতিছন্দ দ্রুত।
কিন্তু এই সাধারণীকরণ বেশ বিতর্কের জন্মও দিয়েছে।
ইতিমধ্যে যে বিষয়টি নজর এড়িয়ে গিয়েছে, ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এর মতে তা হল, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ব্যক্তিগত ভোগের হার চার বছর আগেকার (২০১৭-’১৮) তুলনায় কম ছিল। জিডিপি-র অন্যান্য উপকরণগুলি তার পর থেকে বেড়েছে। যেমন, সরকারি স্তরে ভোগ এবং পুঁজির সংগঠন বেড়েছে, বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ কমেছে। মনে রাখা দরকার যে, এই তুলনা পণ্য ও পরিষেবা আইন (জিএসটি) চালু হওয়ার আগের পর্বের সঙ্গে, যে সময় নিযুক্তি-নিবিড় ক্ষুদ্র ও মাঝারি মাপের উদ্যোগগুলি একত্রে থাকত। জিএসটি-র পর এই সহাবস্থানটিই উধাও হয়ে যায়। আরও একটি বিষয়, ২০১৯-’২০-র শেষ দিকে দেশব্যাপী লকডাউন বিপুল পরিমাণ বেকারত্বের জন্ম দেয় এবং শ্রমজীবী মানুষেরা শহর থেকে গ্রামে ফেরে।
সব কিছু একত্রে দেখলে মনে হতে পারে, এই দু’টি বিষয়ই প্রধান ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু সার্বিক উৎপাদন চার বছরের বেশি সময় ধরে থমকে থাকলে তা নিম্নতন আয়গোষ্ঠীর মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। এখান থেকেই জন্ম নেবে বৃহত্তর অসাম্য, যা নিয়ে গত পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০১৬-র নভেম্বরে নোটবন্দির সময় থেকে তর্ক-বিতর্ক এবং আলোচনা চলেছে। এবং এখানে লক্ষণীয় বিষয়টি হল, বৃহত্তর অর্থনীতি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান নিয়ে প্রসঙ্গ উঠলেই সরকার তাকে উজ্জ্বল এবং পরিপাটি করে দেখাতে তৎপর হয়। বস্তুত, সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সত্যি সত্যিই অস্বীকার করেছেন যে, আর্থিক পুনর্জাগরণের বিষয়টি ইংরেজি বর্ণমালার ‘কে’ অক্ষরটির মতো, অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত সঙ্গতিসম্পন্নরা আরও বেশি সঙ্গতি প্রাপ্ত হয়েছেন, আর দরিদ্ররা বিপন্ন হয়ে পড়েছেন।
এ বিষয়ে আমেরিকার পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি সমীক্ষার কথা ভাবা যেতে পারে। ওই সমীক্ষায় দেখানো হয়েছিল, ভারতীয় মধ্যবিত্তদের এক-তৃতীয়াংশের সঙ্কোচন ঘটেছে, যার মধ্যে ৩ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ নিম্নতন আয় গোষ্ঠীতে পড়ে গিয়েছেন এবং সাড়ে তিন কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছেন। যার ফলে দরিদ্রের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে। সে দিক থেকে দেখলে যদি কর্মনিযুক্তি এবং ভোক্তা জগতের পুনরুদ্ধার না হলে আর্থিক পুনরুত্থানের বিষয়টি সেই ‘কে’ অক্ষরের আকৃতিতেই আটকে থাকবে।
এমন অবস্থায় শুধুমাত্র জিডিপি-র দিকে তাকালে চলবে না। যদিও সেই একটি বিষয়ের পরিসংখ্যান মাথা পিছু হিসেবে কমেছে এবং তা দেশের মানুষের সাচ্ছল্যের প্রাথমিক নির্ণায়ক হয়ে রয়েছে। কারণ, এটি প্রায় সব সময়েই জীবনযাত্রার মান এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলির চিহ্নক। সেই কারণে আয়ের বণ্টন এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ছক শুধুমাত্র পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি মানবিক সংবেদ থাকে না, তা হয়ে দাঁড়ায় আরও বেশি চিন্তার বিষয়।
যদি দেশের মানুষের একটা বড় অংশ কাজ হারায়, তা হলে সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ব্যাহত হতে থাকে। মানুষের আয়ের ভাঁড়ারে টান ধরলে তার ভোগের পরিমাণও কমে আসে। এই দু’টি বিষয় মোট চাহিদাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পুঁজির বিনিয়োগে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এবং সব মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেয়। ১৯১৪ সালে আমেরিকান শিল্পপতি হেনরি ফোর্ড লক্ষ করেছিলেন যে, তাঁর সংস্থার কর্মীদের বেতন বাড়ালে ভোক্তা-চাহিদারও সার্বিক বিকাশ ঘটছে। আজকের দিনেও সরকারের উচিত সেই উদাহরণটিকেই অনুসরণ করা এবং সেই সঙ্গে নজর রাখা, যাতে বেকারত্বের সাম্প্রতিক বৃদ্ধিকে রোধ করা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy