এ পর্যন্ত বিষয়টি বেশ পরিষ্কার ছিল। গত কালের আলোচনায় দেখেছি (‘এই বিলে নাগরিকত্ব কোথায়’, আবাপ, ৯-১২), ভারতীয় রাজনীতি ও সমাজ থেকে মুসলমান কাঁটা তোলার জন্য কী ভাবে এই বিলটির ব্যবহার করতে চাইছেন বিজেপি নেতৃবর্গ। এমনকি, দেশভাগের শিকার বিধিবিড়ম্বিত বাঙালি হিন্দুদের এ বার স্থায়ী হিল্লে হবে, অসমাপ্ত দেশভাগে নির্যাতিতরা এ বার ঐতিহাসিক ন্যায়বিচার পাবেন— এই ধরনের এক ছদ্ম-সত্যও উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির পুরনো, স্থায়ী ও সর্ববৃহৎ ভোটব্যাঙ্ক, বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে উল্লাস তৈরি করেছে। বিলের সমর্থনে বিজেপির প্রচার এমন এক তত্ত্ব উৎপাদন করেছে যাতে মনে হচ্ছে, দীর্ঘ কাল ধরে রাজনৈতিক অধিকার-বঞ্চিত হিন্দুরা এ বার এ দেশে প্রথম বারের মতো নাগরিকত্ব পাচ্ছেন।
অথচ, বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজকের দিনে দেশে কোথায় রয়েছেন অনাগরিকরা, যাঁরা বিলের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পেতে হবে মনে করে হা-পিত্যেশ করছেন? ১৩০ কোটির দেশে এমন অনাগরিক কত জন? এনআরসি-তে যে উনিশ লক্ষকে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে— বলা হচ্ছে, এঁদের মধ্যে বারো লক্ষই নাকি হিন্দু বাঙালি— এঁরাও তো এই দেশেরই নাগরিক। এঁদের ভোটে সরকার ভাঙা-গড়া হয়েছে। আজ হঠাৎ এঁদের অনাগরিক হিসেবে দেগে দেওয়ার যুক্তি কী?
বিজেপি হিন্দু বাঙালির একমাত্র বান্ধব-দল— এই ধারণাকে বদ্ধমূল করার জন্যই এনআরসি এবং বিল। ইংরেজিতে বলা হয়, ‘এক্সক্লুড অ্যান্ড ক্যাপচার’। ঠিক এই মডেলে প্রথম মনগড়া ভাবে অমুসলমানদের অনাগরিক বানানো হবে। তার পর দেওয়া হবে তথাকথিত নাগরিকত্ব।
আবার, এই সহজ প্রক্রিয়াটি কঠিন করে দিয়েছে উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যের জনজাতি। দোসরদের সন্তুষ্ট করতে গিয়ে এবং উত্তর-পূর্ব জুড়ে বিল-বিরোধিতাকে প্রশমিত করতে গিয়ে, নতুন বিলে বাদ রাখা হয়েছে ষষ্ঠ তফসিলি এলাকা এবং ইনার লাইন পারমিট বহাল থাকা রাজ্যগুলি। কার্যত, তা হলে, বিল আইনে পরিণত হলে, সুবিধা মিলবে অসমের সমতল এলাকার হিন্দুদের। অথচ, এঁরা দশকের পর দশক জুড়ে এই রাজ্যেরই অধিবাসী এবং দেশের নাগরিক।
এই বিলের সাংবিধানিকতা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৬-র প্রথম বিলের বেলায় যৌথ সংসদীয় সমিতির বিস্তারিত প্রতিবেদনে মৌলিক অধিকার খর্ব হওয়ার বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে। ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত সমতার প্রশ্নে ইন্টেলিজিবল ডিফারেনশিয়া, অর্থাৎ একটি স্পষ্ট, গ্রহণযোগ্য এবং বোধগম্য গোষ্ঠী হিসেবে দেশভাগের শিকার অমুসলমান জনগোষ্ঠীকে গণ্য করা যায় কি না, তা নিয়েও তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওই ধরনের চুলচেরা বিশ্লেষণে না গিয়েও, বোঝাই যায়, এই বিল আখেরে খুব কাজের কিছু হবে না। প্রথমত, একই দেশে এক রাজ্যে বসবাস করলে আবেদন করা যাবে, অন্য একটি রাজ্যের বেলা নয়, এই একুশে আইনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে আবেদন করাই যাবে না। দ্বিতীয়ত, এই আইনে শুধু আবেদন জানানোর অধিকারই থাকছে। নাগরিকত্ব প্রাপ্তির কোনও সুনিশ্চয়তা নাগরিকত্ব আইন দিতে পারছে না। যত দিন পর্যন্ত এই খুড়োর কল চলবে, হতভাগ্যদের ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দিদশা, আইন-আদালতে দৌড়ঝাঁপ, এবং যাবতীয় হেনস্থাও চলবে।
উদ্বেগের বিষয় হল, যে বিলে নাগরিকত্ব হাতে পাওয়া সুদূরপরাহত, সেই বিলের বিরুদ্ধে কিন্তু একজোট উত্তর-পূর্ব। হিন্দু বাঙালিরা রাজ্যে এখন গণশত্রু। পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অসূয়া সামাজিক বিন্যাস ও ভারসাম্যকে বিনষ্ট করছে।
এই কুৎসিত পরিবেশ দেখে মনে পড়ছে শিবরাম চক্রবর্তীর এক অনবদ্য গল্প। দুই জন যাত্রী ট্রেনের একই কুপে ভ্রমণ করছেন। এক জনের শীতের বাতিক। অন্য জন গরম মোটেই সইতে পারেন না। জানালা বন্ধ দেখে দ্বিতীয় জন আপত্তি করলেন। প্রথম জন তেরিয়া হয়ে বললেন, ওই জানালা খোলা যাবে না। শুরু হল বাদানুবাদ। ক্রমশ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়। অবশেষে অ্যাকশন। যার গরমের সমস্যা তিনি জানালা তুলে দিচ্ছেন। পরমুহূর্তেই শীতরোগী সেই জানালা টেনে নামিয়ে দিচ্ছেন। এই শিশুসুলভ চাপান-উতোরের মধ্যেই ট্রেন একটি স্টেশনে দাঁড়াল। ওই মুহূর্তে নির্দিষ্ট জানালাটি বন্ধ ছিল। দেখা গেল, তৃতীয় এক সহযাত্রী অবলীলায় সেই বন্ধ জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে হাঁক দিলেন, ‘‘ভাই, এক কাপ চা!’’ আসলে সেই জানালার শার্সিই ছিল না মোটে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy