নমো নমো বালক জিশু, তোমাকে জানাই প্রণাম, হে শিশু-রাজা তুমি মহান...’ এই ভাবেই শুরু হয় হিন্দি গানটি। এটি একটি ক্রিসমাস ক্যারল। বড়দিনের গান। এ রকম অনেক গান আছে। নানা ভাষায়। ট্রেনে চাপলে এক রাতে কতগুলো ভাষা পার হয়ে যাই আমরা— আমাদের দেশে নানা ভাষার গান না হলে চলবে কেন?
চলবে না— ফরমান জারি করেছে ওরা। যারা দেশটাকে হিন্দু বানাতে চায়। হিন্দু কাকে বলে, হিন্দুধর্ম মানে কী, সেই ধর্মের অর্থ ক্রমাগত কী ভাবে পালটেছে, কেমন করে সে নদীর মতো নিজেকে বার বার নানান ধারায় ভেঙেছে, নতুন করে গড়েছে, যে ধারাটি বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য পথে চলে গিয়েছিল তাকেই আবার ফিরিয়ে এনে নিজের শরীরে মিশিয়ে নিয়েছে, এমনকী সম্পূর্ণ অপরিচিতকেও কখন যে আপন করে তুলেছে তা সে বুঝতেও পারেনি, আর তাই মুসলমান বাড়ির বধূ অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর পেয়ে মুসলমান গায়িকারা কিসের টানে এসে গান শুনিয়ে গেছে, ‘হে আল্লা, আমার ভাইকে নন্দলাল এনে দিয়ো’, বালক জিশুর বন্দনায় ভক্তরা চেতনা বা অবচেতনের কোন খেলায় স্মরণ করেছে বৃন্দাবনের যশোদাদুলালকে— সেই সব বৃত্তান্ত ওরা জানে না, জানতে চায় না, জানার কোনও প্রয়োজনও নেই ওদের। ওরা হিন্দুত্বের স্বনিযুক্ত ঠিকাদার।
ভুল হল। স্বনিযুক্ত নয়, ওদের ঠিকা দিয়েছে রাজনীতির কারবারিরা। গুজরাত থেকে ত্রিপুরা, জম্মু থেকে কন্যাকুমারী— ভারতবাসীর মনোভূমিতে হিন্দুত্বের সার দিয়ে সেই জমিতে ক্ষমতার ফসল ফলানোর ঠিকা। এবং, মানতেই হবে, ফসল উঠছেও গোলা ভরে। ‘উনিশটা রাজ্যে আমাদের রাজত্ব’ বলে বত্রিশ পাটির আস্ফালন ভয়ানক বটে, কিন্তু ভয়ানক সত্যও বটে। এই রাজত্বের রাজা মন্ত্রী সেনাপতিরা হিন্দুধর্মের প্রকৃত অর্থ নিয়ে এক মুহূর্তও মাথা ঘামাচ্ছেন না, তেমন মাথা তাঁদের আছে বলে মনেও হয় না। হিন্দুত্ব তাঁদের কাছে একটি প্রযুক্তি, যে কেবলই ‘শত্রু’ চিহ্নিত করে, সেই শত্রুর প্রতি বিদ্বেষ ও ভয় জাগিয়ে তোলে এবং তাকে কাজে লাগিয়ে আরও আরও আরও ‘হিন্দু’কে নিজের শিবিরে জড়ো করতে চায়। এই ভয় আর বিদ্বেষের রাজনীতির ভাড়াটে গুন্ডারাই পঁচিশ বছর আগে একটা আস্ত মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, তারাই আঠারো বছর আগে এক প্রবীণ ধর্মযাজক এবং তাঁর দুই শিশুপুত্রকে পুড়িয়ে মেরেছিল। সহস্রাব্দ পালটে গেছে, সেই ট্র্যাডিশন সমানে বেড়েছে। এবং গত সাড়ে তিন বছরের এই নয়া জমানায় গোটা দেশ জুড়ে বজরং-আদি বাহিনীর যে তাণ্ডব চলছে, তা দেখলে স্তম্ভিত নটরাজের প্রলয়নাচন থেমে যেত, সুদর্শন চক্রের প্রয়োজন হত না আর।
এমন রাজত্বে বড়দিনের মরশুমে হিন্দুত্বের অধর্মযোদ্ধারা খ্রিস্টধর্মের অনুগামীদের ওপর চড়াও হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? যোগী আদিত্যনাথ শাসিত উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে স্কুলগুলিকে হিন্দু জাগরণ মঞ্চ হুকুম দিয়েছে, খবরদার যেন সেখানে বড়দিন পালন করা না হয়, কারণ ক্রিসমাস উদ্যাপন হল হিন্দুদের খ্রিস্টান করার একটি কৌশল। মধ্যপ্রদেশের সাতনায় থানার মধ্যে পুলিশের সামনে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের মারধর করেছে গুন্ডারা, তাঁদের গাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। অভিযোগ, তারা বজরং দলের লোক। রাজ্যের বিজেপি সরকার সে অভিযোগ মানবে কি না তারাই জানে, তবে তার পুলিশ ওই আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই এফআইআর করেছে। শোরগোল উঠেছে, তাঁরা নাকি হিন্দুদের জোর করে খ্রিস্টান বানানোর চক্রান্ত করছেন! তাঁদের অপরাধ, তাঁরা, প্রতি বছরের মতোই, ক্রিসমাসের আয়োজন করছিলেন। যেমনটা এই সময়ে প্রতি বছরই হয়, কেবল মধ্যপ্রদেশে নয়, ভারতের নানান অঞ্চলে, এই পশ্চিমবঙ্গেও। বড়দিনের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলে। অনেকে মিলে একসঙ্গে গান গাওয়া, বার বার অভ্যেস না করলে কথায় সুরে মেলে না, বাজনার সঙ্গে তাল কেটে যায়, কারও গলা বেশি উঁচু হয়ে যায় তো কারও বেশি নিচু, মাস্টারমশাই বকুনি দেন, মন দিয়ে না তৈরি হলে উৎসবের দিন সকলের সামনে ঠিকঠাক গাইবে কী করে, জিভ কেটে ফের শুরু করে ছাত্রছাত্রীরা... ভয়ংকর চক্রান্ত বইকি!
সর্বভারতীয় ক্যাথলিক বিশপ সংগঠনের সভাপতি উদ্বিগ্ন হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন, খ্রিস্টান তথা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার আশ্বাস চেয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, তার বেশি কিছু দিতে পারবেন বলে ভরসা হয় না। সংখ্যালঘুকে ভয় দেখানোই যদি ক্ষমতার স্বার্থ হয়, তবে তার নিরাপত্তার ভিতটাই বিনষ্ট হয়, কারণ রক্ষকই তখন ভক্ষক।
এবং বাস্তব অভিজ্ঞতাও কিছুমাত্র ভরসা দেয় না। বড়দিনের সময় এই উৎপাত ও আক্রমণ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। খ্রিস্টধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদের প্রচার এ দেশে অনেক কাল ধরেই চলে আসছে। কিন্তু প্রথম এনডিএ জমানায় ক্ষমতার প্রশ্রয়ে শুরু হয় সংগঠিত আক্রমণের একটা নতুন ধারা। গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইনস ও তাঁর দুই সন্তান তারই বলি হয়েছিলেন। তার পর দিল্লিতে জমানা বদল হয়েছে, কিন্তু ইউপিএ-র দশকেও উপদ্রব বন্ধ হয়নি— গুন্ডারা সক্রিয় ছিল, বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের পৃষ্ঠপোষকদের হাতে প্রভূত রাজনৈতিক ক্ষমতাও ছিল। তবে এখন তাদের দাপট চরমে উঠেছে। একটি হিসেব অনুসারে, দু’বছরে খ্রিস্টধর্মের মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হাজারখানেক আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, অন্তত ছ’জনের মৃত্যু হয়েছে, কয়েকশো গির্জা আক্রান্ত হয়েছে, কয়েকশো মানুষ জোর করে খ্রিস্টান করানোর অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। আর একটি পরিসংখ্যান বলছে, গোটা ২০১৬ সালে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে যত আক্রমণ ঘটেছিল, এ বছরের প্রথম ছ’মাসের সংখ্যাটা তাকে ছাড়িয়ে গেছে।
হিসেবের খুঁটিনাটি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, সব পরিসংখ্যানই খতিয়ে দেখা দরকার। কিন্তু এ দেশের বহু অঞ্চলে সংখ্যালঘুরা যে গভীর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন সেটা জানার জন্যে পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হয় না। ক্রিসমাস ক্যারল গাইলে মার খেতে হবে, জেলও হতে পারে, বড়দিনের আয়োজন করতে চাইলে গুন্ডারা হুমকি দেবে, মারধর, খুনজখম, ভাঙচুর এবং লুটতরাজ করে, আগুন জ্বালিয়ে পার পেয়ে যাবে, বড়জোর তাদের দু’চারটেকে নাম-কা-ওয়াস্তে গ্রেফতার করে অবিলম্বে জামিন দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে, যাতে তারা আবার গুন্ডামি করতে পারে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘রাজ্যের সঙ্গে কথা বলব’ আশ্বাস দিয়ে তিন বার গঙ্গাজলে মুখ ধুয়ে নেবেন এবং পুতুলনাচের সর্বশক্তিমান কারিগর মুখে রা-টি কাড়বেন না— এরই নাম তবে নতুন ভারত?
হবেও বা। তবে এই আধুনিক একুশ শতকে বসে একটা পুরনো ভারতের কথা মনে পড়ে। সেই সময়ের কথা, সংঘ পরিবারের মহাপণ্ডিতরা যাকে এ দেশের অন্ধকারতম অধ্যায় বলে দু’বেলা গাল পাড়ছেন। সুনীল খিলনানির ইনকারনেশনস (পেঙ্গুইন) বইতে পড়েছি, মুঘল সম্রাট আকবর— অহো, কী দুঃসহ স্পর্ধা— গুজরাত জয় করে এসে ফতেপুর সিক্রিতে বুলন্দ দরওয়াজা বানিয়েছিলেন। তার খিলানে ফারসি ভাষায় খোদাই করা আছে সেই বিজয়গৌরবের কথা। আর তার পাশে আছে একটি বাক্য, যার অর্থ: মেরির পুত্র জিসাস বলেছেন, ‘পৃথিবী একটি সেতু, তাকে পার হয়ে যাও, কিন্তু সেখানে ঘর বসিয়ো না।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy