ফাস্টফুড খাচ্ছে বাচ্চারা। ফাইল চিত্র
সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনিসেফের ‘স্টেট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড চিলড্রেন, ২০১৯’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্ব জুড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যু-হারে এখনও উল্লেখযোগ্য হ্রাস ঘটেনি। কয়েকটি তথ্য দিলে এর ভয়াবহতা আন্দাজ করা যাবে। ২০১৮ সালে সারা ভারতে পাঁচ বছরের নীচে মোট শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ছিল আট লক্ষ ৮২ হাজার। নাইজেরিয়ায় সংখ্যাটি ছিল আট লক্ষ ৬৬ হাজার এবং পাকিস্তানে চার লক্ষ ন’হাজার।
এই মৃত্যু-মিছিলের জন্য প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী অপুষ্টি। প্রতি দু’টি শিশুর এক জন কোনও না কোনও ভাবে অপুষ্টির শিকার। এর মধ্যে ‘স্টানটিং’ অর্থাৎ বয়সের তুলনায় কম উচ্চতাযুক্ত শিশু রয়েছে ৩৫ শতাংশ। ১৭ শতাংশ ‘ওয়েস্টিং’ বা উচ্চতার তুলনায় কম ওজনসম্পন্ন। আর ২ শতাংশ শিশু অতিরিক্ত ‘ওভারওয়েট’ অর্থাৎ ওজনজনিত অপুষ্টির শিকার।
পাঁচ বছরের নীচের শিশুদের মৃত্যু-হার কমানোর জন্য বিশ্বজুড়ে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তা লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ‘স্টানটিং’ শিশুর সংখ্যা কিছুটা কমলেও অন্য অপুষ্টির লক্ষণ যথেষ্টই রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অণুখাদ্যের অভাবজনিত কারণে অপুষ্টি। তাই প্রতি পাঁচ জনে এক জন ভিটামিন এ-র অভাবে, তিন জনের একজন ভিটামিন বি১২-এর অভাবে এবং চার জনের দু’জন রক্তাল্পতায় ভুগছে।
গ্রামীণ পিছিয়ে পড়া এলাকা ও শহুরে বস্তিতেই অপুষ্টির ছবি দেখতে আমরা অভ্যস্ত। আমাদের দেশে অতিরিক্ত ওজনজনিত অপুষ্টি তেমন গুরুতর সমস্যা না হলেও সংখ্যাটা ক্রমবর্ধমান। ‘জাঙ্ক ফুড’ খাওয়ার প্রবণতা ও প্যাকেটজাত খাবার বা অন্য ফাস্টফুডের বাজার এখন শহর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে গিয়েছে। জঙ্গলমহলের যে কোনও গ্রামেও দেখা যাবে, যাঁদের মোটামুটি ক্রয়ক্ষমতা রয়েছে, তাঁরা সাধ্যের বাইরে খরচ করেও বাচ্চাদের চিপ্স জাতীয় প্যাকেটের খাবার, কেক-পেস্ট্রি বা ঠান্ডা পানীয় কিনে খাওয়াচ্ছেন। এ ছাড়া, কয়েকটি নামীদামি ব্র্যান্ডের শিশুখাদ্য ও স্বাস্থ্য-পানীয় দারুণ ভাবে জায়গা করে নিয়েছে নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে এমনকি দরিদ্র পরিবারেও।
পেশাগত কারণে খোঁজখবর নিয়ে প্রায়ই জানতে পারি, বাড়িতে তৈরি খাবারের বদলে বাচ্চাদের বিভিন্ন কৌটো বা প্যাকেটজাত খাবার খাওয়াতে বাবা-মায়েরা বেশি আগ্রহী। যে কোনও ভাবেই হোক এই ভুল ধারণার জন্ম হয়েছে যে, বাড়িতে তৈরি করা খাবারের তুলনায় এই খাবারগুলি অধিক পুষ্টিসম্পন্ন। তাই তাঁরা ছোট বাচ্চাদের হাতে বিভিন্ন স্বাস্থ্য-পানীয় ও নানা ধরনের প্যাকেটজাত ভাজাভুজি তুলে দিচ্ছেন। আশা এই যে, তাঁর বাচ্চাটিও বিজ্ঞাপনের বাচ্চাটির মতো টুকটুকে ফর্সা ও নাদুসনুদুস হবে। অথচ আদতে পুষ্টিকর সুষম খাদ্যের অভাবে বাচ্চাটি অপুষ্টই থেকে যায়।
যে সমস্ত বাচ্চা অপুষ্টিতে ভোগে, তাদের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ ঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না। ফলে ওই অপুষ্ট অবস্থাতেই তারা আরও ক্ষুধামান্দ্যর শিকার হয়। তার সঙ্গে ডায়রিয়া, আমাশয়, কৃমি সংক্রমণ ইত্যাদি ঘটলে বা হাম, রক্ত আমাশয়ের মতো অসুখ দেখা দিলে খিদে আরও কমে যায়। পাশাপাশি রয়েছে পরিবারের বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক ধারণা প্রসূত খাদ্যাভাস। ফলে শিশুটি পুষ্টিকর সহজপাচ্য সুষম খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে।
আমাদের দেশে ৬-২৩ মাস বয়সি বাচ্চাদের শতকরা ৪২ জন ঠিকমতো আহার পেয়ে থাকে। ৬-৮ মাস বয়সি শিশুদের ক্ষেত্রে তা ৫৩ শতাংশ। ছবিটা মোটেই উজ্জ্বল নয়। এই সময়ে দূষিত পানীয় জল, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পরিচ্ছন্নতার অভাব হলে শিশুটি নানা সংক্রমণের শিকার হয়, যা অপুষ্টির থাবা আরও চওড়া হয়।
শিশুর জীবনের প্রথম হাজার দিন (অর্থাৎ গর্ভাবস্থার ২৭০ দিন ও জন্মের পরে দু’বছর) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঝুঁকিবহুল। এই সময়ে যেমন তার মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে, তেমনই তাকে কিছু সন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়েও যেতে হয়। প্রথম ছ’মাস বুকের দুধ খাওয়ার পরে শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টি আর তা থেকে সম্পূর্ণ হয় না। দরকার পড়ে পরিপূরক খাবারের। কিন্তু বুকের দুধ থেকে একেবারে শক্ত আহারে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই শুরুতে নরম পাতলা খাবার দিয়ে শিশুকে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত করে তোলা দরকার। তার পরে আস্তে আস্তে পৌঁছতে হয় আধা শক্ত খাবারে। ৬-৯ মাসের মধ্যে এই ধাপগুলি সম্পূর্ণ যায়। এক বছর বয়সে বাচ্চাটি নরম খাবার চিবিয়ে খেতে পারে।
‘ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়ং চিলড্রেন ফিডিং, ২০১৬’-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী আদর্শ পরিপূরক খাবারগুলি হবে বিভিন্ন ধরনের সুষম খাদ্যের মিশ্রণ। দুধ বা দুধ জাতীয় সামগ্রী, প্রাণীজ খাদ্য, চিনি, গুড়, তেল, ঘি, মাখন ইত্যাদি অবশ্যই খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ঋতু অনুযায়ী বিভিন্ন শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি। বাড়িতে বানানো স্বাস্থ্যকর টাটকা খাবার, যাতে চাল ও ডালের অনুপাত ২:১ শিশুকে দিতে হবে। চাল-ডাল, শাকসবজি-সহ হালকা তেল বা ঘি দিয়ে বানানো খিচুড়ি পরিপূরক আহার হিসাবে খুবই কার্যকরী।
বাস্তবে দেখা যায়, পরিপূরক আহার দেওয়ার সময়ে বাবা-মায়েরা বিজ্ঞাপনী মোহে আকৃষ্ট হয়ে কৌটোর শিশুখাদ্যের উপরে বেশি ভরসা করে ফেলেন। অনেকে এক বছর বা তারও বেশি বয়স পর্যন্ত কৌটোর শিশুখাদ্যেই চালিয়ে যান। ঘরে তৈরি খাবার খাওয়ানোর কথা বললে তাঁরা সরাসরি বলে দেন, ‘আমার বাচ্চা খেতে চায় না! থু থু করে ফেলে দেয়!’ আসলে বাচ্চারা হঠাৎ করে কোনও নতুন জিনিস খেতে চায় না। কয়েক দিন ধরে চেষ্টা চালালে তবে ওই খাবারে অভ্যস্ত হয়। এই পর্যায়ে অনিবার্য ভাবে যুক্ত হয় কিছু স্বাস্থ্য- পানীয়ও। এই দুইয়ের সম্মিলিত কুফল হল সামর্থ্য বা আর্থিক সচ্ছলতা সত্ত্বেও সুষম পুষ্টিকর আহার থেকে শিশুর বঞ্চিত হওয়া, যার পরিণাম অপুষ্টি। তাই শুধু গরিব নয়, সচ্ছল পরিবারেও অনেক শিশু এখন অপুষ্টির শিকার।
অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়তে হলে সমাজের সর্বস্তরে ঠিক বৈজ্ঞানিক ধারণা তৈরি করতে হবে। অন্যথায় আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অপুষ্টিতে
ভুগতেই থাকবে।
প্রাক্তন জেলা মাতৃত্ব ও শিশুস্বাস্থ্য আধিকারিক, পুরুলিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy