n আসানসোলের শিশু সাহিত্য পত্রিকা। ছবি: পাপন চৌধুরী
কয়লা, লোহা আর রেলের শহরের পাশাপাশি আসানসোলের আরও একটি পরিচয় রয়েছে। এ শহর শিল্পের, সাহিত্যের অন্যতম পীঠস্থান। খনিগর্ভের কয়লা, ব্লাস্ট ফার্নেসের গলন্ত লৌহপিণ্ডের বা রেলের ঘুরন্ত চাকার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্যও জড়িয়ে রয়েছে শহর আসানসোলকে। বহু খ্যাতনামা সাহিত্যিক যেমন আসানসোলে পায়ের ধুলো দিয়েছেন, তেমনই এই শহর তৈরি করেছে অসংখ্য সাহিত্যিককেও। এই সাহিত্যিকদের কলম উঠে এসেছে আসানসোলের যাপনকথা।
মূল ধারার সাহিত্যের পাশাপাশি, আসানসোলের শিশুসাহিত্যের চর্চার ইতিহাসও নিতান্ত তুচ্ছ নয়। তবে এখানে আসানসোল বলতে কিন্তু বৃহত্তর আসানসোলকে বোঝানো হচ্ছে। আসানসোল পুরসভার ভৌগলিক এলাকার বাইরেও যে সব মানুষেরা রয়েছেন তাঁদের রচনাতেও দিনের পর দিন সমৃদ্ধ হয়েছে শিশু সাহিত্যচর্চার ধারা। এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে, ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ‘আলোক’ পত্রিকাকেই আসানসোল শিল্পাঞ্চলের প্রথম সাহিত্যপত্রিকা বলা হয়। এই মাসিক পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যায় কাজী নজরুল ইসলামের কিছু কবিতাও প্রকাশিত হয়েছিল।
‘আলোক’ এর পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ সাহিত্যপত্রিকা আত্মপ্রকাশ করেছে। মৃত্যু হয়েছে অধিকাংশেরই। এতগুলি পত্রিকার মধ্যে ছোটদের জন্য পত্রিকা কিন্তু হাতে গোণা। সাকুল্যে এক ডজনও নয়। বিস্তৃত এই শিল্পাঞ্চলে মাত্র দু’টি ছোটদের পত্রিকা এখনও পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ‘তবুও টুকুন’ এবং ‘আবার ক্ষীরের পুতুল’। ত্রৈমাসিক ‘তবুও টুকুন’ পত্রিকাটি গত ২৮ বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ছ’বছর বয়সী ষান্মাসিক ‘আবার ক্ষীরের পুতুল’-এর নির্ধারিত সব সংখ্যাই প্রকাশিত হয়েছে।
তবে বর্তমান প্রজন্মের এই শিশু পত্রিকাগুলিকে পথ দেখিয়েছিল সত্তরের দশকে প্রকাশিত একটি পত্রিকা। ১৯৭২ সালে শুভদীপ বসুর সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘কিশলয়’ নামে একটি ছোটদের পত্রিকা। এটি প্রায় তিন বছর স্থায়ী হয়েছিল। এই পত্রিকার কতগুলি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। এর পরে ১৯৮০-র দশকে বার্নপুর থেকে সীতারাম উপাধ্যায়ের সম্পাদনায় শিশু ও কিশোর বিষয়ক পত্রিকা ‘কেকা’ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রায় একই সময়ে রূপনারায়ণপুরের দুই তরুণ ছাত্র, ‘কিশোর প্রতিভা’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার মাত্র তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে উখড়া থেকে মলয় বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিনিময় সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘মৌটুসী’ পত্রিকাটি। এই পত্রিকাও দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। হিরাপুর থেকে উদয় মজুমদার ও চণ্ডী চট্টরাজ প্রকাশ করতেন ‘হৈ-হুল্লোড়’।
২০০৫, ২০০৮ এবং দীর্ঘ বিরতির পরে ২০১৯-এ একটি করে সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে ‘তা তা থৈ থৈ’ পত্রিকার। নিয়ামতপুর থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদনা করতেন দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনটি সংখ্যাতেই বড়রা কম, ছোটরা সংখ্যায় বেশি লিখেছে।
তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা যাচ্ছে, প্রবল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ছোটদের জন্য প্রকাশিত একটি পত্রিকাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অনেক চেষ্টায় যে কয়েকটি সংখ্যা সংগ্রহ করা গিয়েছে সেগুলিও লেখার মানের দিক থেকে খুব একটা আহামরি নয়।
কেন ছোটদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকার এই দুরবস্থা? কেউ কেউ জানান, বড়রা ছোটদের জন্য লিখতে চান না। আবার কারও মতে, ছোটরা এ সব পড়তে চায় না। এ বিষয়ে ‘আবার ক্ষীরের পুতুল’ পত্রিকার সম্পাদক মুনমুন দাশগুপ্ত বলেছেন, ‘‘আমরা অভিভাবকেরাই ওদের পড়তে দিই না। নাচের ক্লাস, গানের স্কুল, সাঁতারের ট্রেনিং, ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্প... ওদের আমরা ছুটিয়ে মারি। এ ছাড়া টিউশন, স্কুল। দু’দণ্ড শ্বাস নেওয়ার জো নেই ছোটদের।’’
শিশুসাহিত্যের চর্চা বন্ধ হওয়ায় বিপদ সম্পর্কে বাসুদেব মণ্ডল বলেছিলেন, ‘‘শিশুদের যদি সাহিত্য পড়তে না দেওয়া হয় তা হলে ওদের কল্পনাশক্তি হারিয়ে যাবে। ওরা স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাবে। আর কল্পনা করতে না পারলে, স্বপ্ন দেখতে না পারলে ওদের মধ্যে থেকে শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক বেড়িয়ে আসবে কি করে?’’ বাসুদেববাবুর সম্পাদনায় গত ৩৫ বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে ‘আজকের যোধন’ পত্রিকাটি। বড়দের এই পত্রিকাটি ইতিমধ্যেই ছোটদের জন্য কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ করেছে।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, আসানসোলের মতো শিল্প সাহিত্যে সমৃদ্ধ এলাকায় ছোটদের সাহিত্যচর্চায় আজকের যুগের ইঁদুর দৌড়ের কারণে যেমন ভাঁটা পড়েছে, তেমনই ভাঁটা পড়ছে ছোটদের উপযোগী গল্প রচনা, সাহিত্য রচনার সঙ্গে যুক্ত আঞ্চলিক মানুষজনকে কিঞ্চিৎ তুচ্ছতাচ্ছিল্যের কারণেও। কেন না অনেকেই ছোটদের উপযোগী কবিতা বলতে ছড়াকেই বুঝে থাকেন। কিন্তু ছড়ার বাইরেও একটা বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে রয়েছে। কল্পবিজ্ঞান, রহস্যগল্প প্রভৃতি বিষয়কে ছোটদের মতো করে উপযোগী করে পরিবেশন করার নিবিষ্ট চর্চা না থাকলে কিন্তু শিশু সাহিত্য পত্রিকার বিষয়গত অবনমন হতে বাধ্য। আবার যে শিশুরা এই শিশু পত্রিকাগুলিতে লেখালেখি করেছে, তাদের প্রতিভাকে বাঁচিয়ে রাখতেও কোনও সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। ওদের লেখা একটু সম্পাদনা করে প্রকাশ করলে ওরা উৎসাহিত হবে। কিন্তু সেই পরিচর্যার ছাপ সব জায়গায় বড় একটা পাওয়া যায় না।
তবে এই শিল্পাঞ্চলেরই কয়েক জন সাহিত্যকর্মী ধারাবাহিক ভাবে মূল ধারার সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি নিয়মিত ভাবে ছোটদের উপযোগী লেখা লিখে গিয়েছেন। ৭০ পেরনো সাহিত্যিক সমীপেন্দ্র লাহিড়ী ন’বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। এগারো বছর বয়সে তাঁর লেখা ‘আনন্দমেলা’-য় প্রকাশিত হয়। পরে তিনি নিয়মিত সন্দেশ, কিশোরভারতী, শুকতারা প্রভৃতি পত্রিকায় লিখেছেন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সমীপেন্দ্রবাবু ছোটদের জন্য লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছিলেন। সত্তরের দশকে রমেন আচার্য ও মণীন্দ্র চক্রবর্তী ছোটদের জন্য বেশ কিছু ছড়া ও কবিতা লিখেছিলেন। ‘তবুও টুকুন’ এর সম্পাদক তারকনাথ মণ্ডল এবং ‘আবার ক্ষীরের পুতুল’-এর সম্পাদক মুনমুন দাশগুপ্ত দু’জনেই পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে সঙ্গে ছোটদের জন্য লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছিলেন।
মৌলিক লেখালেখির পাশাপাশি ছোটদের জন্য বিভিন্ন লেখা বাংলায় অনুবাদের কাজ করছেন দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়। তিনি ইদানিং মৌলিক গল্প লেখার সঙ্গে সঙ্গে টলস্টয়, হিচকক প্রমুখদের লেখা অনুবাদও করছেন। অনুবাদ, মৌলিক রচনার মিশেলেই পরিপুষ্ট করতে হবে শিল্পাঞ্চলের শিশু সাহিত্যধারাকে। তারই সঙ্গে চাই ছোটদের প্রতিভাকে বিকশিত হতে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনাও। কারণ, ছোট থেকেই গল্প পাঠের অভ্যাস ভবিষ্যতে এক জন সহৃদয় পাঠক ও সমাজ সচেতন মানুষ তৈরি করতে পারে।
আসানসোলের সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy