নিশান্তে খসে পড়া শিউলির মতো নিবিড় মেঘের আঁচল জুড়ে ঝরে পড়ছে ‘মন কেমন করা’ বৃষ্টির শব্দসুখ।
আষাঢ়ের অলস সন্ধ্যার লিলুয়া বাতাস চাকদহ শহরকে আলিঙ্গন করে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটার গায়ে গায়ে বুনে চলেছে নানা স্বরবিন্যাসের প্রক্ষেপিত সংলাপের কলস্বর। যেন ছন্দ ভেঙে দুলে দুলে উঠছে নিশিডাকা কুহকরাত। কোথাও বন্দি শাজাহানের আর্তস্বরে প্রাচীন পরাগের মতো ঝরে পড়ছে বিষণ্ণ সংলাপ— ‘‘হায়, ভারতসম্রাট শাজাহান, তোমার চারিদিকে এখন শুধু অন্ধকার। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস।’’
প্রতারিত রাত আর বিবর্ণ অন্ধকারের পাশে শুয়ে থাকা নিঃসঙ্গ শাজাহানের পাঁজরের সন্ধিক্ষণে পুশে কোনও আলোকিত শ্রাবণ–সন্ধ্যা হয়তো সেই মুহূর্তে উঁকি দিয়েছিল অতীতের জীর্ণ বাকলের ফাঁক দিয়ে। কোথাও আবার কৃষ্ণের সাক্ষাৎ না পেয়ে হতাশাক্লিষ্ট সুবল দ্বারকার রাজপ্রাসাদ থেকে ফিরে আসছে হৃদয়সমুদ্রের ভগ্নকুল বেয়ে বেয়ে। কৃষ্ণসখা সুবলের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসছে বিরহের লগ্নকথামাখা দরবারি কানাড়ার স্বরলিপিতে মথিত স্বপ্নভাঙা খণ্ডিত বেদনা— ‘‘আমার চলে না চরণ কেঁদে ওঠে প্রাণ/ কে যেন আমায় পিছু ডাকে/ বলে আয় তুই ফিরে আয়।’’
জনমনে লোকায়ত বিনোদনের অনবদ্য শিল্পমাধ্যম ‘যাত্রা’র জগতে ‘মিনি চিৎপুর’ নামে খ্যাত চাকদহ শহরের আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্রের যাত্রা গানের বর্ণনা এটি। চাকদহ স্টেশন চত্বরে অন্তত ২৪টি ঘরে এই মহলা চলত ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে। ছড়িয়েছিটিয়ে দু’একটি দল আগে-পরে তাদের নতুন পালার মহলা শুরু করলেও মূলত রথযাত্রার শুভ সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হত সব দলের মহলা। রথযাত্রার সকাল এক নতুন উষ্ণতার সান্নিধ্য বয়ে আনত যাত্রাদলগুলির গদিঘরে। চাকদহ প্লাটফর্মের উপর পর পর সব গদিঘরগুলোয় সে দিন চোখে পড়ার মতো ব্যস্ততা। পুষ্পে-পর্ণে সুসজ্জিত গদিঘরে ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে শোভিত মালিকেরা গভীর আন্তরিকতা আর হার্দিক আপ্যায়নে অন্তরঙ্গ হয়ে চলেছেন নায়েকদের সঙ্গে। হাসিমুখে হাতে তুলে দিচ্ছেন মিষ্টির প্যাকেট। নদিয়া তো আছেই, তা ছাড়া চব্বিশ পরগণা, হাওড়া, হুগলি সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নায়েকরা চলে আসতেন ভোর-ভোর। আগের দিন বিকেলেও অনেকে এসে যেতেন। থাকার ব্যবস্থা হতো মালিকের বাড়িতে কিংবা গদিঘরের চৌকিতে। এ দিন বায়না করতে পারলে কিছুটা ছাড় মেলে। তাই নায়েকদের আগ্রহের এই আতিশয্য।
কাব্যিকতার মূল অভিমুখ যেমন হৃদয়, যাত্রার অভিমুখ তেমন লোকমানস। মূলত ধর্মোৎসবে নাট্যগীত অনুষ্ঠানে দেশজ প্রচেষ্টার পরিণতি হিসেবেই এক সময়ে যাত্রাগানের উদ্ভব ঘটেছিল। চাকদহের যাত্রাদলগুলি লোকমানসের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তন্ত্রীগুলিকে ছুঁয়ে দিয়েছিল লোকজ বিনোদনের অমোঘ আকর্ষণে। দুর্গাপুজোর পর পরই প্রান্ত থেকে প্রান্তরে মঞ্চের পর মঞ্চ মাতিয়ে যাত্রাশিল্পের গ্রহণযোগ্যতাকে অনন্য মাত্রাদানে সার্বিক সফলতা লাভ করেছিল এই যাত্রাদলগুলি।
চাকদহ রামলাল একাডেমির প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক বিপুল রঞ্জন সরকার স্মৃতির অতল থেকে টুকরো টুকরো শৈশব তুলে এনে তালুর স্পর্শে সাজিয়ে দিলেন রোদ-সহচর শীত-বাতাসের পরতে-পরতে— “যাত্রাশিল্পের আভিজাত্যের গায়ে শীত-রোদ্দুরের উষ্ণতা মেখে চাকদা হয়ে উঠত ‘যাত্রা-চঞ্চল জনপথ’। প্রতি শীতেই যাত্রার আসর বসত গণেশ জননী মেলার মাঠে। চলত তিন-চার সপ্তাহ ধরে। কলকতার নামীদামি যাত্রাদলের পাশাপাশি চাকদার দলগুলিও নিপুণ অভিনয়ের মুন্সিয়ানায় প্রায় একই মূল্যমানে উত্তরিত হত। কখনও কখনও জনপ্লাবন এমন পর্যায়ে পৌঁছত যে, উদ্যোক্তারা প্যান্ডেলের টিনের ব্যারিকেড খুলে দিতে বাধ্য হতেন।”
চাকদহের নাট্যশিল্পের গোড়াপত্তন ঘটেছিল বিশ শতকের দুই-এর দশকের গোড়ার দিকে। সুরেন্দ্রনাথ সরকার তাঁর কয়েক জন পরিচিত বন্ধুকে নিয়ে ‘শ্রীগৌরাঙ্গ নাট্যসমিতি’ নামে একটি থিয়েটারের দল তৈরি করেন এবং যশড়ার অচিন্ত্য মিত্রের উদ্যোগে তৈরি হয় ‘ব্রাদার্স হ্যাপি ক্লাব’ নামের নাট্যদল। কিন্তু সখের দলের পরিণতি যা হয় আর কী। দু-তিন বছর পর ‘নিভল বাতি, পড়ল ঝাঁপ।’ এর কিছুকাল পর ঘুগিয়ার সন্ন্যাসীচরণ বিশ্বাস, চাকদহের পাঁচুগোপাল সাধুখাঁ, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, অজিত সাধুখাঁ এবং জকপুরের কয়েক জনের উদ্যোগে একটি যাত্রাদল তৈরি করে তাঁরা একটি পালাই মঞ্চস্থ করেছিলেন, সেটি ‘রাজা সাগর’। সময়টা ১৯৪৩-এর শেষের দিকে। এই দলটি ভেঙে যাওয়ার পর এঁদেরই উদ্যোগে চাকদহ পুরাতন বাজারে ‘গণেশ জননী ক্লাব’ তৈরি হয় ১৯৪৪-এ। নামে ক্লাব হলেও এটি মূলত যাত্রাদল। মূল উদ্যোক্তা সন্ন্যাসীচরণ বিশ্বাস ছিলেন একাধারে নৃত্য ও গানের শিক্ষক, পঞ্চাঙ্ক যাত্রাপালার নির্দেশক এবং চাকদহ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক।
চাকদহের যাত্রাশিল্পের উত্তরণে স্বর্ণাভ সোপান গড়ার পিছনে অনন্য ভূমিকা ছিল ‘ঝাউচর মহামায়া অপেরা’র। চাকদহ সংলগ্ন এই ঝাউচরের মঞ্চেই ‘মিলনশঙ্খ’ পালায় প্রথম অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত নট তারাপদ মুখোপাধ্যায়। চরিত্র ছিল বৃষপর্ব। পরে দলটি ‘চাকদহ নাট্যসমাজ’-এর সঙ্গে মিশে যায়। তখন সব যাত্রাদলই সমকালীন প্রথিতযশা পালাকারদের লেখা পালাই পরিবেশন করতেন। কিন্তু চাকদহের যাত্রাদলগুলির প্রয়োজনে এবং জনমনের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রথম যাত্রাপালা লিখতে শুরু করেন চাকদহের নিমাই মণ্ডল। সমাজ মনস্তত্ত্বের গভীরে ডুব দিয়ে দৈনন্দিন চলমানতার দ্বন্দ্ব-জটিল জীবন প্রবাহ সুখ-দুঃখের রৌদ্রছায়ায় সেঁকে নিয়ে তিনি নাক্ষত্রিক বৈচিত্রে সাজিয়ে দিয়েছেন পালায় পালায়। তাঁর লেখা ১১টি পালার মধ্যে ‘সতীর সমাধি’, ‘অত্যাচারীর শৃঙ্খল’, ‘বড়দা’, ‘রক্ত দিয়ে স্বামী বরণ’, ‘রমজানের চাঁদ’ প্রভৃতি পালাগুলি ছুঁয়ে গিয়েছিল মানুষের হৃদয়। পালাকার হিসাবে আরও যিনি সাফল্য লাভ করেছিলেন তিনি ঝাউচরের তারকচন্দ্র মণ্ডল। কর্মজীবনে বিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও লোকায়ত সংস্কৃতির আস্বাদে নিজেকে তৃপ্ত করার বাসনা ছিল দুর্নিবার। চৈতন্যদেবের পাদস্পর্শধন্য অধ্যাত্মবাদ তাঁর সারস্বত ভাবনার গভীরে সংগোপনে রোপন করে দিয়েছিল ভক্তিবাদের এক চিরসবুজ অনাবিল ক্ষেত্রবীজ। তাই হৃদয়ের রসায়নে তিনি কখনও জারিত করে নিয়েছেন পৌরাণিক কাহিনির শিল্পরূপ।
কখনও ইতিহাসকে আশ্রয় করে লৌকিক পরিকাঠামোয় বুনে দিয়েছেন নিখাদ সমাজ মনন। তাঁর রচিত সাতটি যাত্রাপালার মধ্যে ‘রামী চন্ডীদাস’, ‘শ্রীকৃষ্ণ সুধামা’, ‘রাজ্যহারা রাণা’, ‘কবি বিদ্যাপতি’ পালা চারটি ‘চাকদহ নাট্যসমাজ’ কলকাতা বেতারে পরিবেশন করেছে। অত্যন্ত সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী তারকচন্দ্র মণ্ডল নিজেও অভিনয় করেছেন এই পালাগুলিতে। চাকদহের বীরেন্দ্রকুমার রায়ও বেশ কিছু পালার রচয়িতা। তাঁর লেখা ‘কুরুক্ষেত্রের আগে’, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘মালা বদল’ বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
(উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত)
লেখক সরিষাডাঙ্গা ড. শ্যামাপ্রসাদ হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy