অমিত শাহ।—ছবি পিটিআই।
গত সোমবারের পর বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার একটি দলীয় যন্ত্রে পরিণত হইয়াছে, যে দলের লক্ষ্য, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করিয়া তোলা। একটি গণতান্ত্রিক দেশের ‘কেন্দ্রীয় সরকার’ বলিতে যে সংবিধান-অনুগামী, সর্বজনীন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ প্রশাসনব্যবস্থা বোঝায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার প্রায় ঘোষিত ভাবেই সেই পথ হইতে অনেক দূরে সরিয়া আসিল। সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ করিবার সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ভাষা ও ভঙ্গি ব্যবহার করিলেন, দেশের ইতিহাসের যে ব্যাখ্যা দিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার যুক্তি যে ভাবে উড়াইয়া দিলেন, তাহাতে নিশ্চিত, দলীয় লক্ষ্যসাধনে একাগ্র বিজেপির রাজনৈতিক কৌশল। তাঁহাদের সাংসদ-সংখ্যার জোরের উপর ভর করিয়া কাহারও কোনও কথায় কান না দেওয়া। ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলিকে তাঁহারা লঙ্ঘন করিতেছেন, বিরোধীদের এই যুক্তি নিতান্ত অর্বাচীন ও ভিত্তিহীন বলিয়া দাবি করা। প্রতিবেশী দেশের অমুসলিম সংখ্যালঘু শরণার্থীরা এই দেশের নাগরিকত্ব পাইবেন, এমন একটি বিল রচনার সময়ে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়কে বিলের পরিধির বাহিরে রাখিবার মধ্যে সংবিধানের একটি গুরুতর নীতি পদদলিত হইল। সেই নীতি এই দেশে সর্বধর্মের প্রতি সমান দৃষ্টি রাখিতে বলিত। প্রত্যক্ষত ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরোধী এ-হেন আইন ইতিপূর্বে সংসদে পাশ হইয়াছে কি না, সন্দেহ। সুতরাং সংখ্যার লড়াইতে পরাভূত বিরোধী সাংসদরা যে গভীর দুঃখ ও হতাশার সঙ্গে বলিলেন, স্বাধীন ভারত এত দিনে ‘স্বাধীনতা’ হারাইল— এই খেদবাক্য আলঙ্কারিক হইলেও তাহাকে ভ্রান্ত বলা কঠিন।
ভারতীয় সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় বিভিন্ন রকম নির্দেশ ও প্রস্তাব রহিয়াছে। কোনও দল কিংবা কোনও রাজনীতিক যদি লক্ষ্যসিদ্ধির সঙ্কীর্ণ বাসনায় সেই সব বাক্যের সুকৌশলী স্বার্থমনস্ক চয়ন না করিতে পারে, তাহার কারণে ভারতীয় সংবিধানসভার বিবেচক নেতারা সংবিধানের একটি প্রস্তাবনা রচনা করিয়াছিলেন, এবং আশা রাখিয়াছিলেন যে সংবিধানের মূল ভাবটি প্রস্তাবনায় ধরা থাকিলে একাধিক ধারার ব্যাখ্যাসংক্রান্ত সমস্যা উপস্থিত হইলে সেই ভাবটি আলোকবর্তিকার কাজ করিবে। গত সত্তর বৎসর আইনবিভাগ ও বিচারবিভাগ সেই প্রস্তাবনাটিকে সমীহ করিয়া আসিয়াছে। সম্প্রতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেই ভাবটিকে পরিত্যাগ করিবার প্রবণতা দেখা যাইতেছে। নাগরিকত্ব বিলের ক্ষেত্রেও ঠিক সেইখানেই ব্যত্যয় ঘটিল। অর্থাৎ ইহা আকস্মিক বা বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপ নহে। একটি বিশেষ রাজনীতির অভিমুখের সহিত এই অসাংবিধানিক প্রচেষ্টা অঙ্গাঙ্গি। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই বলুন না কেন, সংবিধানের একাদশ ও চতুর্দশ ধারার মধ্যে বিরোধ আছে ইত্যাদি, বিষয়টি কিন্তু কোনও বিশেষ ধারাসংক্রান্ত নহে। সংবিধান অনুযায়ী এই দেশের সাধারণ আইনে ‘ধর্ম’ যে কোনও বৈষম্যভিত্তি হইতে পারে না, ইহা একটি সরল কথা— মাথার চুল ছিঁড়িয়া কূটবিচার করিবার মতো কিছু নহে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলিয়াছেন, যে দিন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হইয়াছে, সেই দিনই নাকি এই আইনের বীজটি উপ্ত হইয়াছে। মন্ত্রিবরের কিন্তু জানিবার কথা যে যে ঘটনাক্রমেই ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ ঘটিয়া থাকুক, স্বাধীন ভারত ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হিসাবে উত্থিত হয় নাই, ইসলামিক ও অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পাশে গৌরবান্বিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে তৈরি হইয়াছিল। অমিত শাহের নিনাদ ‘কংগ্রেস দেশভাগ করিয়াছে’, ইহাও ইতিহাসমতে চূড়ান্ত অসিদ্ধ। মুসলিম লিগের যে দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে দেশভাগ হইয়াছিল, তাহার সমর্থন কংগ্রেস করে নাই, এবং হিন্দু মহাসভা করিয়াছিল, তাহা সুপ্রতিষ্ঠিত। ইতিহাসের বিকৃত ও ভ্রান্ত উপস্থাপনা বিজেপির আমলে বহুপরিচিত হইলেও নাগরিকত্ব বিলের দৌলতে তাহা একটি নূতন মাত্রা অর্জন করিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy