Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
‘এই ভার সংরক্ষণের পক্ষে বহন করা অসম্ভব’

তাই বলে এমন বুদ্ধিনাশ?

সংরক্ষণ নিয়ে চিরকালই রাজনীতিকরা বাড়াবাড়ি করেছেন। সমাজ, অর্থনীতি, নৈতিকতা কিছুর তোয়াক্কা না করে রাজনীতি করেছেন। যে রাজনীতিটা ঠিক যখন করলে সুবিধে, সেটাই করেছেন।

ভরসা-ফুর্তি: সংসদে সংরক্ষণ বিল পাশের পর সামাজিক ন্যায় দফতরের মন্ত্রী গহলৌত ও বিজেপি সাংসদদের সন্তোষ প্রকাশ, ৮ জানুয়ারি। পিটিআই

ভরসা-ফুর্তি: সংসদে সংরক্ষণ বিল পাশের পর সামাজিক ন্যায় দফতরের মন্ত্রী গহলৌত ও বিজেপি সাংসদদের সন্তোষ প্রকাশ, ৮ জানুয়ারি। পিটিআই

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

সমর্থকরা বললেন, ‘গেম-চেঞ্জার’, খেলা পাল্টে দেওয়ার জন্য এক চালেই একশো। বিরোধীরা বললেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি দলের আখের গোছানো! ভেতরকার কথাটা মনে হল— মোদী সরকারের অবস্থা একেবারে ছিলে-ছেঁড়া, যে কোনও চাল চেলে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগর পেরিয়ে তারা দলের নৌকো ২০১৯-এ তীরে ভিড়াতে চায়। তার জন্য সংরক্ষণ আইনের সাংবিধানিক সংশোধন ‘সংবিধানসম্মত’ না হলেও অসুবিধে নেই। দরিদ্র উচ্চবর্ণ মানুষের সংরক্ষণ করতে গিয়ে ‘দারিদ্র’ কথাটার সংজ্ঞা বিলকুল বদলে দিতেও অসুবিধে নেই। ‘দশ শতাংশ’-র মধ্যে বহু গুণ দেশবাসীকে ঢোকানোর আজগুবি চেষ্টাতেও কুছ-পরোয়া নেই।— বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ বলে শুনেছি। বুদ্ধিনাশের চিহ্ন দেখে এ বার যেন সত্যিই প্রত্যয় হচ্ছে, বিনাশকালটাও তা হলে এসেই গিয়েছে!

সংরক্ষণ নিয়ে চিরকালই রাজনীতিকরা বাড়াবাড়ি করেছেন। সমাজ, অর্থনীতি, নৈতিকতা কিছুর তোয়াক্কা না করে রাজনীতি করেছেন। যে রাজনীতিটা ঠিক যখন করলে সুবিধে, সেটাই করেছেন। সংরক্ষণ মানেটাই সামাজিক ন্যায়ের বদলে হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোটের হিসেব। এ সব নতুন কথা নয়। বিজেপির বিশেষত্বও নয়। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের সময়ে মণ্ডল কমিশন রিপোর্ট যখন দেশে আক্ষরিক অর্থে অগ্নিসংযোগ করেছিল, তা কি ভোটমনস্ক ছিল না? রাজ্যে রাজ্যেও এমন দেখেছি। কেরলে বাম সরকারের আমল (২০০৮), রাজস্থানে কংগ্রেস সরকারের আমল (২০০৮), মায়াবতী-শাসনাধীন উত্তরপ্রদেশ (২০০৭) স্মরণ করা যেতে পারে। তিন জমানাতেই আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা শ্রেণিগুলিকে কোনও না কোনও সংরক্ষণ পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। মায়াবতী এমনকী ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে একটি চিঠিও লিখে ফেলেছিলেন যে উচ্চবর্ণের জন্য প্রস্তাবিত সংরক্ষণকে যেন নবম তফসিলে ফেলা হয়, যাতে আদালতে এর বৈধতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন না উঠতে পারে। আজ ঠিক সেই কারণেই কোনও দল বুক ঠুকে বিজেপি-বিরোধিতায় মুখ খুলতে পারল না, সুড়সুড় করে লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিলটিকে পাশ করিয়ে দিতে বাধ্য হল।

কিন্তু এ সব মনে রেখেও বলতেই হয়, এই সপ্তাহে ভারতীয় সংসদে সংরক্ষণ নিয়ে যে কাণ্ডটা হয়ে গেল, তার মধ্যে একটা নির্লজ্জতা আছে, ভয়াবহ দুঃসাহসিকতা আছে, সংবিধানকে কলা দেখানোর স্পর্ধা আছে। সংবিধানে বলা আছে, পঞ্চাশ শতাংশের বেশি সংরক্ষণ করা যাবে না? এখনই উনপঞ্চাশকে দশ বাড়িয়ে উনষাট করে দাও, দেখি কে কী করতে পারে! কিসের ভিত্তিতে দশ শতাংশ নতুন সংরক্ষণের প্রস্তাব? জনসংখ্যার হিসেব আছে কোনও, জাত-ভিত্তিক? না, নেই, জাত-পরিচয়ে ভেঙে দেশের জনসংখ্যার ছবিটা কী রকম, ২০১১ সাল থেকে তা জানার সুযোগ ঘটেনি এ দেশে, কোনও পরিসংখ্যানই প্রকাশিত হয়নি মোটে। তাতে কী হয়েছে, দাও করে দশ শতাংশ, কার সাধ্য দেখি এমন একটা বিষয়ে প্রশ্ন তোলে।

সত্যিই দেখা গেল, প্রশ্ন উঠল না, উঠলেও সে সব নেহাত নির্বিষ প্রশ্ন। কাজের বেলায় সকলেই বিলের সপক্ষে ভোট দিলেন, এত বড় একটা ‘ঐতিহাসিক’ অনাচার প্রায় কোনও সংসদীয় আলোচনা বা বিতর্ক ছাড়াই এক দিনের মধ্যে পাশ হয়ে গেল। বিজেপি সরকার যে সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক রাস্তায় হাঁটছে, তা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু বিরোধী দলগুলি? তাদের কাণ্ডকারখানা নিয়েও কি একটু মৃদুমন্দ প্রশ্ন তুলতে পারি? এটা কি সংসদ না নাট্যশালা, যে সংবিধানে যা আছে তা কেন কিসের জন্য আছে সে সব না ভেবেই সংবিধান সংশোধনী পাশ করে ফেলা যায়? বিজেপি স্বার্থপরতার রাজনীতি করছে। আর বিরোধীরা? জনতার মন রাখা রাজনীতি?

কেন এই আইন ঐতিহাসিক অনাচার, সেটা একটু খুলে বলা দরকার। অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর উচ্চবর্ণকে সংরক্ষণের আওতায় আনতে হলে প্রথমেই মনে হওয়া উচিত— কেন আর্থিক অনগ্রসরতাকে এ দেশের সংবিধান আগেই সংরক্ষণের যোগ্য বলে মনে করেনি? দরিদ্র মানুষের বিষয়ে আমাদের সংবিধান একেবারেই ভাবেনি, এই সরকারই প্রথম ভাবছে, এটা তো মেনে নেওয়া মুশকিল! এই প্রসঙ্গে ইন্দ্র সাহনে মামলার রায়টি উল্লেখ করব, কেননা ১৯৯২ সালে আর্থিক ভিত্তিতে সংরক্ষণের প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছলে যখন এই মামলা শুরু হয়, সর্বোচ্চ আদালত তখন রীতিমতো বিস্তারিত আলোচনা করেছিল এই নিয়ে। সংবিধান পরিষদের আলোচনা ও বিতর্কের উপর নির্ভর করে যে কোনও (অর্থাৎ উচ্চবর্ণের) ক্ষেত্রে কেন অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার ভিত্তিতে সংরক্ষণ করা উচিত নয়, তা নিয়ে ওই মামলার রায়ে বিস্তারিত যুক্তি আমরা পড়তে পারি।

জানতে পারি যে, সংবিধান-রচয়িতাদের মতে, কোনও জাত, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের কিছু সদস্য পশ্চাৎপদ থাকলেই তার ক্ষেত্রে সংরক্ষণের কথা উঠতে পারে না। সংরক্ষণের কথা ভাবা যায় একমাত্র যদি কোনও জাত, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় সামগ্রিক ভাবে পশ্চাৎপদ বলে জানা যায়, এবং সেই পশ্চাৎপদতার পিছনে একটা ঐতিহাসিক কারণ থাকে, অর্থাৎ ‘সামাজিক বৈষম্যের দীর্ঘ ইতিহাস’ থাকে। এই শেষ শব্দবন্ধটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে ছাড়া সংরক্ষণ বিষয়টাকেই ভাবা যায় না। আর তাই যে কোনও অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার ক্ষেত্রে সংরক্ষণের চেষ্টা ‘অসাংবিধানিক’, সুতরাং ‘অগ্রহণযোগ্য’ ঘোষিত হয়। একাধারে অম্বেডকর এবং কে এম মুন্সির বক্তব্য উদ্ধৃত হয় এই রায়ে। দু’জনেই বলেছিলেন, যে হেতু দীর্ঘ সময় ধরে জাত ভারতে সামাজিক ও শিক্ষাগত বৈষম্যের হেতু ও অস্ত্র হয়ে থেকেছে, ‘সংরক্ষণ’ বিষয়টি নিচু-জাতের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক, কিন্তু উঁচু-জাতের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার ক্ষেত্রে তা নয়।

সুপ্রিম কোর্ট আর একটি স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিল সেই রায়ে। সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মানদণ্ডটি এক ভাবেই আনা যেতে পারে: বিয়োগাত্মক (exclusionary) ভাবে। যোগাত্মক (inclusionary) ভাবে নয়। তার অর্থ হল— সামাজিক ভাবে যারা ‘পিছিয়ে’, সেই তফসিলি জাতি-জনজাতির বৃত্ত থেকে ক্রিমি লেয়ার কিংবা অর্থনৈতিক ভাবে ‘এগিয়ে থাকা’ শ্রেণিকে বাদ দেওয়ার জন্যই একমাত্র অর্থনৈতিক মানদণ্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু সামাজিক ভাবে যারা ‘এগিয়ে’, তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক ভাবে ‘পিছিয়ে থাকা’ শ্রেণির জন্য এই ব্যবস্থা চালু করা সঙ্গত নয়।

সংবিধানের এত বড় একটা নির্দেশ ও সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট রায় সত্ত্বেও এই বিল আনা হল। পাশও হয়ে গেল। এর পর সুপ্রিম কোর্টে এই আইনকে চ্যালেঞ্জ জানানো হলে কী হবে, তা দেখার বিষয়। কিন্তু সংবিধান ও আদালতকে উপেক্ষা করে যে বিল আনা যেতে পারে, এবং বিল আইনে পরিণত করতে পারে, এ তো অবশ্যই ভারতীয় গণতন্ত্রের সত্তর বছরের অন্যতম উজ্জ্বল কৃতিত্ব!

নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে মোদী নিশ্চয়ই বলবেন যে গরিব মানুষের দুঃখে তাঁর ঘুম হচ্ছিল না বলেই সংবিধান ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক বস্তুর পাশ কাটিয়ে তাঁকে এই কাজটা করতে হল। প্রসঙ্গত জেনে রাখা ভাল যে, ভারতের সংবিধানে ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি যোগ করার অনেক আগে থেকেই ভারতীয় রাষ্ট্র দারিদ্রের মোকাবিলাকে তার অন্যতম বৃহৎ কর্তব্য হিসেবে দেখে এসেছে। সেই লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে অনেক কিছু করতে দেখা গিয়েছে, তার আরও অনেক কিছু করার অবকাশ আছে বলে মনে করা হয়েছে। তবে কিনা, উচ্চশিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে সংরক্ষণ সেই সব কর্তব্যের মধ্যে পড়েনি, পড়ে না। কেন পড়ে না, তার নানা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে। তার মধ্যে না গিয়ে বরং সমাজতাত্ত্বিক প্রতাপভানু মেটার একটি উদ্ধৃতি মনে করা যেতে পারে: ‘‘দ্য পারপাস অব রিজ়ার্ভেশন হ্যাজ় বিন স্ট্রেচড বিয়ন্ড কমব্যাটিং ডিসক্রিমিনেশন অ্যান্ড এমপাওয়ারিং দ্য ট্রুলি মার্জিনালাইজ়ড (দ্যাট ইজ় দ্য ওনলি থিং ইট ডাজ় নট ডু), টু নাউ অ্যান অ্যান্টি-পভার্টি মেজার, আ লোড ইট ক্যানট বেয়ার’’, অর্থাৎ সংরক্ষণ বস্তুটির অর্থ এখন বৈষম্যের প্রতিরোধ আর সত্যিকারের প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়ন (একমাত্র যে কাজটা আজকাল সংরক্ষণ করে না) থেকে টেনে-হিঁচড়ে দারিদ্র মোকাবিলাতেও নিয়ে আসা হচ্ছে— অথচ এই ভার সংরক্ষণের পক্ষে বহন করা অসম্ভব!

‘এই ভার সংরক্ষণের পক্ষে বহন করা অসম্ভব’ বলে অম্বেডকরও মনে করতেন, আর তাই সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ‘সামাজিক বৈষম্যের’ প্রশ্নটির উপর এতটা জোর দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, এবং পরবর্তী প্রায় সব সমাজতাত্ত্বিকের মতে, এ দেশের জাতভিত্তিক বৈষম্য আর পাঁচটা বৈষম্যের সঙ্গে তুলনীয়ই নয়।— এবং সেটাই সংরক্ষণের প্রথম ও প্রধান সূত্র।

শুধু তো সংরক্ষণকেই টেনেহিঁচড়ে রাজনীতির অস্ত্র করে তোলা হচ্ছে না, অম্বেডকরের মতো মানুষগুলোকে নিয়েও চলছে একই রকম টানাহেঁচড়া। তাই মঙ্গলবার সন্ধেবেলায় বিজেপি মুখপাত্রদের বলতে শুনলাম, আজ তাঁদের হাতে সংরক্ষণের প্রসার ঘটতে দেখে আকাশে বসে অম্বেডকরের মুখে হাসি আর ধরে না। হায় অম্বেডকর। হায় ভারতবর্ষ!

অন্য বিষয়গুলি:

Reservation Upper Caste Central Government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE