ছবি: সংগৃহীত।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোক্ষম কথাটি বলিয়াছেন— জিএসটি লইয়া কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্বাসভঙ্গ করিল। শুধু রাজ্যগুলির সহিত নহে, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সহিত। অবশ্য, ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই যখন সংসদের সেন্ট্রাল হলে মধ্যরাত্রে জিএসটি ব্যবস্থা চালুর কথা ঘোষণা করিলেন প্রধানমন্ত্রী, এই বিশ্বাসভঙ্গের বীজ সে দিন বপন করা হইয়াছিল। পরোক্ষ কর আদায়ের সংবিধানসিদ্ধ অধিকারটি রাজ্য সরকারগুলি তুলিয়া দিয়াছিল জিএসটি কাউন্সিলের হাতে। পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল, ইহার ফলে রাজ্যগুলির যে রাজস্ব ক্ষতি হইবে, পরবর্তী পাঁচ বৎসর কেন্দ্রীয় সরকার তাহা পুষাইয়া দিবে। এই বৎসর রাজস্ব আদায়ের অবস্থা খারাপ— তাহার দায় ঈশ্বরের স্কন্ধে চাপাইয়া অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানাইয়াছেন, এখন ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হইবে না, রাজ্যগুলি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে টাকা ধার করিয়া লউক। সেই টাকা শোধ হইবে জিএসটি-র সেস বাবদ আদায় করা অর্থ হইতে। ঋণের উপর সুদ মিটাইবে কে, নির্মলা জানান নাই। পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় রাজ্য যেখানে পূর্ব হইতেই ঋণের দায়ে জর্জরিত, তাহাদের উপর এই জবরদস্তি বোঝা চাপাইয়া দেওয়া যে অন্যায়, বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলি সেই কথা বলিয়াছে। দাবি তুলিয়াছে, কেন্দ্রীয় সরকারই ঋণ করিয়া রাজ্যগুলির হাতে টাকা দিক। দাবিটি যথার্থ— কারণ, এই ঋণের বোঝা বহিবার কোনও নৈতিক দায় রাজ্যগুলির নাই। জিএসটি-র ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা রাজ্য সরকারের প্রাপ্য, এবং তাহা দেওয়া কেন্দ্রের কর্তব্য।
এক্ষণে বৃহত্তর প্রশ্ন, কেন্দ্রীয় সরকার কি চাহিলেই জিএসটি ক্ষতিপূরণ প্রদানের এই দায় অস্বীকার করিতে পারে? আইনের ফাঁকফোকর গলিয়া সেই পথ সরকার বাহির করিতে পারে কি না, তাহা গৌণ প্রশ্ন। আসল কথা হইল, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যগুলির যে অধিকার ছিল, তাহা কাড়িয়া লইবার সময় কেন্দ্র যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল, তাহা হইতে বিচ্যুতির মধ্যে অনৈতিকতা প্রকট এবং অনস্বীকার্য। অর্থমন্ত্রী যুক্তি দিতে পারেন, রাজস্ব যদি আদায়ই না হয়, তবে তাহা হইতে ক্ষতিপূরণ দিবার প্রশ্ন আসিতেছে কী ভাবে? আসিতেছে, কারণ রাজ্যগুলির কর আদায়ের ক্ষমতা কাড়িয়া লওয়ার অর্থ, তাহাদের এই ক্ষতিপূরণের উপর নির্ভরশীল করিয়া ফেলা। এই অতিমারি-বিধ্বস্ত সময়ে রাজ্যগুলির হাতে কর আদায়ের ক্ষমতা থাকিলেও তাহারা টাকা তুলিতে পারিত কি না, সেই প্রশ্ন অবান্তর— কেন্দ্র তাহাদের সেই ক্ষমতা হরণ করিয়াছে, ফলে ক্ষতিপূরণ না দিবার অর্থ, প্রতিশ্রুতিভঙ্গ। অথবা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাহা বলিয়াছেন— বিশ্বাসভঙ্গ। তাহা কখনও নৈতিক হইতে পারে না। এবং, নীতির প্রতি এই অবজ্ঞা, বিশ্বাস রক্ষায় এই অনীহা দেখিবার পর সন্দেহ অমূলক নহে যে, কাল এই ঋণের টাকা শোধ করিতেও কেন্দ্র অস্বীকার করিবে।
জিএসটি ব্যবস্থাটি প্রকৃত প্রস্তাবে একটি পরীক্ষা ছিল— কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ধর্মকে কতখানি সম্মান করে, তাহার। সেই সম্মান দাঁড়াইয়া ছিল বিশ্বাসের উপর— রাজ্যগুলির আর্থিক ক্ষমতা বজায় রাখিবার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও আপস করিবে না। নির্মলা সীতারামনরা প্রথম সুযোগেই বুঝাইয়া দিলেন, তাঁহাদের নিকট সেই বিশ্বাসের দাম কানাকড়িও নহে। প্রশ্ন হইল, রাজ্যগুলি যদি কেন্দ্রীয় সরকারকে আর বিশ্বাস না করিতে পারে, তবে যুক্তরাষ্ট্র বাঁধা থাকিবে কোন বাঁধনে? কিসের ভরসায় রাজ্যগুলি ভাবিবে যে, কেন্দ্র তাহাদের স্বার্থরক্ষা করিবে? বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলির মানুষ তবুও জানিবেন, কেন্দ্রের অন্যায়ের প্রতিবাদ করিবেন তাঁহাদের নেতা-নেত্রীরা। কিন্তু কর্নাটকের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মানুষের সেই ভরসাও নাই— কেন্দ্রে দল যতই মারাত্মক সিদ্ধান্ত লউক, রাজ্যের নেতারা প্রতিবাদ করিবেন না। মানুষকে অসহায় করিয়া তোলার ন্যায় বিশ্বাসভঙ্গ আর নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy