একেই কি উন্নয়ন বলে?
পরিচ্ছন্নতা, নামান্তরে স্বচ্ছতা, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংশয় নেই। ভারতের মতো দেশে স্বচ্ছতা সুনিশ্চিতকরণ কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা যে রয়েছে, তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু স্বচ্ছতা বলতে ঠিক কী বুঝি আমরা? কোন কোন ক্ষেত্রকে আবর্জনামুক্ত করতে পারলে নিজেদের পরিচ্ছন্ন বলতে পারব আমরা? এই প্রশ্নগুলোর জবাব আগে পাওয়া জরুরি। না হলে অভিযানের বৃহত্তর উদ্দেশ্যটাই ব্যাহত হয়।
সসম্মানেই গাঁধী জয়ন্তী পালিত হল গোটা দেশে। প্রধানমন্ত্রী প্রথামাফিক রাজঘাটে গেলেন, শ্রদ্ধা জানালেন মহাত্মার সমাধিতে। ভারত শুধু নয়, গোটা বিশ্ব শ্রদ্ধায় স্মরণ করল অহিংসার উজ্জ্বলতম দিশারীকে। কিন্তু পরিহাসই হোক বা বৈপরীত্য, হিংসা-ঘৃণা-বর্ণবিদ্বেষ যেন হাত মিলিয়ে হানা দিল এই দিনটাতেই, অন্য কোথাও নয়, গাঁধীর নিজের দেশেই, গাঁধীর নিজের রাজ্যেই।
গরবার আসরে কেন পদার্পণ দলিতের? কোন অধিকারে ‘উচ্চতর’ বর্ণের পাশে? গুজরাতের আনন্দে প্রশ্ন তুলল একদল। প্রশ্ন তুলেই থামল না, শারীরিক আক্রমণ হল, মারণ নিগ্রহ হল, চিরঘুমে শুইয়ে দেওয়া হল দলিত তরুণকে।
আরও পড়ুন:গরবায় তোরা কেন? দলিত যুবককে পিটিয়ে খুন গুজরাতে
এই একটা মাত্র ঘটনাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না। কিন্তু এই একটা মাত্র ঘটনাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরার প্রয়োজনও নেই। দলিত নিগ্রহ আর সংখ্যালঘু নিগ্রহের একের পর এক ঘটনায় সম্প্রতি গোটা দেশ যে রক্তাক্ত, সে কথা এ দেশের কোনও নাগরিকেরই অজানা নয় সম্ভবত। ভারতের বহুত্বের উপরে তো বটেই, মানবতার উপরেও এ এক ভয়ঙ্কর আক্রমণ। আর এ ধরনের আক্রমণের প্রবণতা এতই বেশি আজ এ দেশে যে, গাঁধী জয়ন্তীও পার পায় না তার হাত থেকে।
স্বচ্ছ ভারত অভিযান নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের কর্মসূচি। স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জাতীয় উপলব্ধি জাগাতে গাঁধীর সাহারাই নিয়েছেন মোদী। গাঁধীর জীবনচর্যায় পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব কতখানি ছিল, প্রচারে-প্রয়াসে-বিজ্ঞাপনে বার বার সে কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু গাঁধীর জীবনচর্যা বা জীবনাদর্শের এই অনুসরণ কি পরিচ্ছনতা বা স্বচ্ছতা সংক্রান্ত প্রক্ষিপ্ত অংশটিতেই সীমাবদ্ধ? গাঁধীর সামগ্রিক রাষ্ট্রভাবনা বা সমাজভাবনার প্রতি কি মোদী শ্রদ্ধাশীল নন? এই প্রশ্নটা খুব বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। ভারতীয় সমাজের উপর বার বার মারণ আঘাতগুলো নামছে বলেই প্রশ্নচিহ্নটা বড় হচ্ছে।
রাজপথ-রেলপথ, মাঠ-ময়দান, অফিস-কাছারি, বাজার-হাট, গঙ্গার ঘাট— ঝাড়ু হাতে প্রতীকী সাফাই অভিযানে নেমে পড়ছেন মন্ত্রী-আমলা, রথী-মহারথী, কেউকেটারা। স্বচ্ছতার প্রকাশ যে শুধু আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকছে, তেমনও নয়। আবর্জনার বিরুদ্ধে অভিযান নিয়মিতই হয়তো বহাল থাকছে দেশের নানা প্রান্তে। কিন্তু এ তো বহিরঙ্গের আবর্জনা। অস্তিত্বের অন্তরঙ্গে যে জঞ্জালের স্তূপ, তার সাফাই কী ভাবে হবে?
জাতিভেদ, বর্ণবিদ্বেষ, সামাজিক অসাম্যকেও আবর্জনাই মনে করতেন মহাত্মা গাঁধী। ভারতীয় সমাজ থেকে সে সবের সাফাইয়ের জন্য জীবনভর নিরন্তর লড়াই ছিল তাঁর। যে বিদ্বেষ, যে সংকীর্ণতা আজ দেখছি, তা আসলে সমাজের অন্দরমহলের ময়লা। সে ময়লাকে সাফ করে অন্তরকে স্বচ্ছ করে তুলতে না পারলে স্বচ্ছতার প্রয়াস আন্তরিক হয় না। ভারতীয় সমাজ থেকে আবর্জনার সাফাইটাও তাই চেয়েছিলেন গাঁধী। সত্যিই যদি স্বচ্ছ ভারত চান, তা হলে এই আবর্জনাগুলো সাফ করতে সক্রিয় হতে হবে মোদীকেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy