অতিমারি দমনের লকডাউন-জনিত আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলায় দরিদ্রকে সরাসরি নগদ অনুদান দিচ্ছে বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশ। ভারতে অবশ্য তা দেওয়া হয়েছে সামান্যই। যেহেতু আমি বছর দশেক ধ’রে সব নাগরিকের জন্য ন্যূনতম আয়ের পক্ষে সওয়াল করে আসছি, এই প্রশ্নটা আজকাল প্রায়ই শুনছি— এখনই কি তা হলে সার্বিক ন্যূনতম আয় শুরু করার ঠিক সময়? যদি দরিদ্র দেশগুলিতে সাময়িক অনুদান শেষ অবধি সার্বিক ন্যূনতম আয় প্রকল্পে পরিণতি লাভ করে, তাতে অবশ্যই আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা যখন ন্যূনতম আয়ের পক্ষে সওয়াল করেছিলাম, তখন কিন্তু আরও দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রকল্প হিসেবে, অর্থনীতির আরও স্বাভাবিক অবস্থায় এর রূপায়ণের কথাই ভেবেছিলাম। এমন সময়ের কথা ভেবেছিলাম, যখন এই রকম একটি প্রকল্পের জন্য রাজনৈতিক সমর্থন, প্রশাসনিক পরিকাঠামো এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য ব্যবস্থা সবই মজুত থাকবে।
দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য ন্যূনতম সরকারি অনুদানের ধারণাটার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে পশ্চিমের চিন্তাধারায়। সম্প্রতি ইরান, মঙ্গোলিয়া, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা রাজ্য একে বাস্তবে কাজেও লাগিয়েছে। কিন্তু সাধারণত অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এর খরচ অত্যন্ত বেশি, বিশেষ করে ধনী দেশে। ও সব দেশে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) ব্যবহার বাড়ার জন্য কাজ হারানোর ভয় যত বাড়ছে, ন্যূনতম আয়ের পক্ষে সমর্থনও তত বাড়ছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অনেক অর্থনীতিবিদ ন্যূনতম আয়কে দারিদ্র-অপসারণের প্রকল্প বলে দেখেন। বর্তমানে দরিদ্রদের যে সব সহায়তা প্রকল্প চলছে, ন্যূনতম আয় তার চাইতে সহজ বিকল্প হতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন। আবার কেউ বলেন, অন্য প্রকল্পগুলোর সঙ্গে ন্যূনতম আয়কেও জুড়ে দিলেই ভাল। সে ক্ষেত্রে অবশ্য নানা প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হয়। যেমন, সবাইকে না দিয়ে কেবল দরিদ্রের জন্য অনুদান দিলে টাকাটা কি আরও যথাযথ ব্যবহার হত না? যারা গরিব নয়, তাদেরকেও টাকা দেওয়ার দরকার কি? এর উত্তরে বলা হয়, মধ্যবিত্তকে বাদ না দিলে তাদের রাজনৈতিক সমর্থনটা পাওয়া যায়, যেটা দরকারি। তাছাড়া কে গরিব আর কে নয়, তার তো কোনও পাকাপাকি বিভাজন নেই। ফসল মার খেলে, অসুস্থ হলে, কাজ হারালে স্বল্পবিত্ত মানুষও দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যান। বিপিএল কার্ড দিয়ে দরিদ্রের সহায়তা করতে গেলে বহু গরিব বাদ পড়ে যায়। সবার জন্য ন্যূনতম আয় চালু করলে এই ঝুঁকিটা কমবে। দারিদ্রসীমার ঠিক উপরে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ বেঁচে রয়েছেন, তাঁদেরও আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন কম নয়। কেবল দরিদ্রদের নিশানা করার বিরুদ্ধে এটা আমার একটা প্রধান যুক্তি।
ন্যূনতম আয়কে অামি নাগরিকের মৌলিক অধিকারের অংশ বলে দেখি। মনে রাখতে হবে, ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার অন্তর্গত ছিল সামাজিক সুরক্ষার অধিকার। সাম্প্রতিক কালে ধনী দেশগুলোতেও বিশ্বায়নের ফলে, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ার ফলে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। সর্বত্র শ্রমিক সংগঠনগুলো দুর্বল হয়েছে, ব্যয়-সঙ্কোচনের নীতি নেওয়ার ফলে জনপরিষেবায় খরচ হচ্ছে কম। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে বেশি। এখন অতিমারির মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব লোকে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মতো দেশে, যেখানে জনস্বাস্থ্য পরিষেবা যথেষ্ট জোরালো নয়।
ধনীদের কেন ন্যূনতম আয় দেওয়া হবে, এই প্রশ্নটা অবশ্যই ওঠে। আমার উত্তর, ধনীও নাগরিক, সুতরাং সেই অধিকারেই সে তা পাবে। তার যেমন পুলিশি সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে, তেমনই সামাজিক সুরক্ষার অধিকারও আছে। কেউ যদি নিজে থেকে তা ছেড়ে দেন, বা কোনও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে যদি কিছু শ্রেণিকে বাদ দেওয়া যায় (একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের উপরে আয়কর দিলে, কিংবা গাড়ির মালিক হলে), তাতে আমার আপত্তি নেই। সর্বজনীন ন্যূনতম আয় প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য আর্থিক নিরাপত্তা। অসাম্য দূর করা নয়।
শ্রমের বাজারের দৃ্ষ্টিতেও সর্বজনীন ন্যূনতম আয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কাজ হারালেও শ্রমিক আর্থিক সুরক্ষা সম্পূর্ণ হারাবেন না। সকলেরই যদি একটা গ্রহণযোগ্য আয় থাকে, তা হলে চাকরি বা কাজ হারানো শ্রমিকের কাছে অত মারাত্মক হবে না।
এ ছাড়া আমাদের মতো দেশে বিশেষ কিছু যুক্তি আছে। যেমন, দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় মেয়েদের অধিকাংশই যেহেতু গৃহকাজ, অন্যদের পরিচর্যার কাজ করেন, তাঁরা এমন কোনও কাজে যোগ দিতে পারেন না যাতে অর্থ রোজগার হয়। । প্রতি মাসে তাঁদের অ্যাকাউন্টে যদি ন্যূনতম আয়ের টাকা পৌঁছয়, পরিবারে তাঁদের সম্মান ও স্বাতন্ত্র বাড়বে। সেই রকম, যাঁরা সেপটিক ট্যাঙ্ক, নিকাশি নালা সাফ করা, আবর্জনা কুড়নোর বা বেশ্যাবৃত্তির মতো কাজ করতে বাধ্য হন শুধু জীবিকার তাড়নায়, তাঁরা একটা ন্যূনতম আয়ের ভরসা পেলে অন্য কাজ খুঁজে নেওয়ার সুযোগ পাবেন। দিনমজুর, খেতমজুর, পরিযায়ী শ্রমিকরা ঠিকাদার, কারখানা মালিক বা জমির মালিকদের সঙ্গে আর একটু দরদস্তুর করতে পারবেন। সেই সঙ্গে, দরিদ্রদের সরকারি প্রকল্পের সুবিধে “পাইয়ে দিয়ে” জনসমর্থন আদায়ের যে রাজনীতি চলে, যা গণতন্ত্রকে বিকৃত করে, তার থেকেও রেহাই মিলবে। ন্যূনতম আয় গণতান্ত্রিক নাগরিকের অধিকার, নেতাদের দানসামগ্রী নয়।
আর একটা বিশেষ যুক্তি উঠে আসে শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রটি থেকে। শ্রমিক ইউনিয়নগুলি প্রধানত বড় কারখানা বা আপিসের কর্মচারীদের নিয়ে আন্দোলন করে। তাতে বিপুলসংখ্যক অসংগঠিত শ্রমিকদের লাভ হয় না। সংগঠিত-অসংগঠিতের বিভাজন বহু দিন ধরে আমাদের শ্রমিক আন্দোলনের দুর্বলতার একটি বড় কারণ। সর্বজনীন আয়ে কিন্তু দুই ধরনের শ্রমিকেরই লাভ, এর দাবি তাই শ্রমিক আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করতে পারে।
ন্যূনতম আয়ের বিরুদ্ধে প্রধানত চারটি যুক্তি দেওয়া হয়। এক, ঘরে বসে টাকা পাওয়ার ফলে মানুষ অলস হয়ে যাবে, টাকাটা মদ-গাঁজায় খরচ করবে। দুই, এত বড় আর্থিক বোঝা চাপলে দেশের বাজেট ভেঙে পড়বে। তিন, এ হল আসলে বর্তমান জনকল্যাণ প্রকল্পগুলি তুলে দেওয়ার চেষ্টা— সেগুলো মোটামুটি ভাল চললেও। চার, বাড়তি টাকা যদি থাকেই তবে তা শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিকাঠামোর উন্নয়নে খরচ করা উচিত। এই যুক্তিগুলি একটু খতিয়ে দেখা দরকার।
গরিবকে টাকা দিলে সে কাজ করতে চাইবে না, এই যুক্তি গরিবের যে কোনও আয়বৃদ্ধি প্রকল্পের বিরুদ্ধেই খাড়া করা সম্ভব। গত কয়েক বছরে নানা দেশে পরীক্ষামূলক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, অনুদানের টাকা হাতে এলে মানুষ কাজ বড় একটা কমিয়ে দেয় না। নেশা বাড়িয়ে দেয়, এমন সাক্ষ্যও মেলেনি। এছাড়া আমার মনে হয়, দরিদ্ররা যে হাড়-ভাঙা পরিশ্রম করে তা একটু কমলেই ভাল। (চলবে)
অর্থনীতি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy