কালো ধোঁয়া উড়িয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে যে লজঝড়ে বাসটা পাশ দিয়ে চলে গেল, তাকে দেখে যে কেউ বুঝবে— এই কালো ধোঁয়া কখনওই বাসের সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ হতে পারে না। শহরের বাতাস আজ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে এ রকমই কালো ধোঁয়ায়। কিন্তু কী অদ্ভুত! ট্রাফিক পুলিশ যদি পলিউশন সার্টিফিকেট দেখতে চান? দেখা যাবে হয়তো এই বাসের থেকে নির্গত ধোঁয়ায় দূষণ নেই। এই ম্যাজিকের রহস্য বুঝতে আলোচনাটা শুরু থেকে শুরু করাই ভাল।
শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও শহরতলীর অনেক বাসই কিন্তু এখন চলছে কেরোসিনে। কেরোসিনের সঙ্গে ইঞ্জিন ওয়েল, ডিজেল মিশিয়ে বা পুরোটাই কেরোসিন দিয়ে চালানো হচ্ছে বাস। কৃষ্ণনগরের এক বাস মালিকের সাফাই, ‘‘উপায় নেই। বাসে প্যাসেঞ্জার হয় না আগের মতো। কর্মচারীদের বেতন দিয়ে, বাসের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ সামলে হাতে প্রায় কিছুই আসছে না। সে কারণেই ডিজেলের বদলে কেরোসিনে বাস চালিয়ে কিছুটা সাশ্রয়ের চেষ্টা।’’ এক লিটার কেরোসিনের দাম এক লিটার ডিজেলের চেয়ে প্রায় ২০ টাকা কম। দিনে গড়ে কম করেও ৪০ থেকে ৫০ লিটার তেল লাগে এক একটা লোকাল বাসে। যদিও এ কথা ঠিকই যে কেরোসিন ব্যবহারে গাড়ির ইঞ্জিন আর পাম্পের ক্ষতি হয় অনেক বেশি। যেমন, কেরোসিনে চালালে গাড়ির একটা পাম্প যদি ৬ মাস যায়, ডিজেলে তা চলে এক থেকে দেড় বছর। তা হলে লাভটা হয় কোথা থেকে? আসলে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেরোসিনে চলা গাড়িতে ডিজেল চলা গাড়ির থেকে বছরে পনেরো, কুড়ি হাজার টাকা বেশি খরচ হলেও তা সারা বছরের ডিজেলের দামের চেয়ে অনেকটাই কম হয় বলে মত বাস মালিকদের। এ ভাবে বাস চালিয়েও তা হলে গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষার সার্টিফিকেট ঠিক থাকছে কী করে? বছর শেষে গাড়ি ফিট সার্টিফিকেটই বা পাচ্ছে কী করে?
মজা এখানেই। সব গাড়িকেই ছয় মাস পর পর গাড়ির ধোঁয়া পরীক্ষা আর কমার্শিয়াল নম্বরের গাড়ির জন্য বছরে এক বার ফিটনেস পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষার এই সময় দুটোয় অনেক বাসই পাম্প বা ধোঁয়ার কারণের সঙ্গে যুক্ত যন্ত্রাংশগুলি সাময়িক ভাবে পাল্টে নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে। তার পর সুস্থতার সার্টিফিকেট পাওয়ার পর আবার তা খুলে পুরনো যন্ত্রাংশ লাগিয়ে নেয়। এখন ধোঁয়া পরীক্ষা ব্যবস্থা অনলাইন হয়ে যাওয়ায় কারচুপি করা সহজ নয় বলেই মত ধোঁয়া পরীক্ষকদের। তবুও পুরনো বাইকের নম্বর প্লেট খুলে ভাল বাইকের পিছনে ধরে তার ছবি নিয়ে ভাল বাইকের পরীক্ষা করা ধোঁয়ার মাপ নিয়ে পুরনো বাইকও দূষণ মুক্ততার সার্টিফিকেট পেয়ে যাচ্ছে অনেক সময়। ফিটনেস পরীক্ষার সময় এত কিছু কারসাজির পরেও যদি গাড়িতে কোনও গোলমাল থেকে থাকে, তা কিছুটা ম্যানেজ হয়ে যায়।
‘‘মানে, ইয়ে, বোঝেনই তো সব,’’ হাত কচলে মুচকি হেসে বলেন এক বাসমালিক। প্রশাসন সবটাই জানে। মাঝে মাঝে রাস্তায় গাড়ি ধরে দূষণ পরীক্ষাও করে প্রশাসন। জরিমানা করা হয়। তবে তা নিয়মিত নয়। তাই এ ভাবেই প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে এই কালো ধোঁয়ার ম্যাজিক। ফলাফল— পরিবেশের হাল কেরোসিন। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাস্তা জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো কেরোসিন বা ডিজেলে চলা মোটর ভ্যান, সময়মতো গাড়ির সার্ভিসিং না করা, বহু দিনের পুরনো গাড়ি ব্যবহার করার মতো নানা কারণে গাড়ি থেকে মাত্রাতিরিক্ত দূষিত কালো ধোঁয়া বাতাসে মেশে। অনেক সময় আবার ওভারলোড ট্রাকগুলোয় ওভারলোডের কারণে ইঞ্জিনে অতিরিক্ত চাপ পড়ার গাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া বেরোয়।
এই ধোঁয়ার মধ্যে কী কী থাকে? আর তা কতটাই বা ক্ষতিকারক? চেন্নাইয়ের শ্রী রামচন্দ্রা ইনস্টিটিউট অফ হায়ার এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের ডিপার্টমেন্ট অফ এনভায়রনমেন্টাল হেল্থ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গবেষক তথা পরিবেশবিদ দীপ চক্রবর্তীর মতে, ‘‘উন্নত আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হল গাড়ির ধোঁয়া। এই ধোঁয়ার মধ্যে পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫ মাইক্রন, ওজোন, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেনের নানা অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড ছাড়াও আরও কিছু ক্ষতিকারক গ্যাসীয় উপাদান থাকে। যার মধ্যে ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড (VOC) আর পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন (PAH) খুব ক্ষতিকারক।’’
তিনি আরও জানান, পেট্রল বা ডিজেলের চেয়ে অনেক বেশি VOC বা PAH উৎপন্ন হয় জ্বালানি হিসাবে কেরোসিন ব্যবহারের ফলে। PAH-এর মধ্যে সব চেয়ে ক্ষতিকারক উপাদান হল ন্যাপথালিন আর বেনজোএপাইরিন। VOC-র মধ্যে সব চেয়ে ক্ষতিকারক বেঞ্জিন, টলুইন, জাইলিন। এই সব উপাদান গ্যাসীয় অবস্থায় আমাদের শরীরে ঢোকে। এদের কারসিনোজেনেসিটি আর মিউটাজেনেসিটি ধর্ম থাকায় এই উপাদান শরীরে প্রবেশ করলে আমাদের ক্যানসার বা মিউটেশনের কারণ হতে পারে। ন্যাপথালিন ফুসফুস ও মূত্রনালির সমস্যা তৈরি করে। বেঞ্জিন স্নায়ুতন্ত্রের নানান সমস্যার কারণ ঘটায়। PM 2.5(পার্টিকুলেট ম্যাটার)-এ ভারী ধাতু ও বিভিন্ন হাইড্রোকার্বন থাকায় তারা প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে বড়দের ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD), ছোটদের অ্যাকিউট লোয়ার রেসপিরেটরি ইনফেকশন (ALRI) রোগের কারণ হয়।
গাড়ির ধোঁয়ার একটা বড় উপাদান কার্বন মনোক্সাইড। কোনও জ্বালানি সম্পূর্ণ না জ্বললে কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হয়। কার্বন মনোক্সাইড শরীরে প্রবেশ করে রক্তে মিশলে রক্তে কার্বোক্সি হিমোগ্লোবিন তৈরি করে। যার পরিমাণ রক্তে বেড়ে গেলে মানুষের মৃত্যুও ঘটতে পারে। এ ছাড়া কার্বন মনোক্সাইড মস্তিস্ক, হৃদ্পিণ্ড সহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলির ক্ষতি করে। ওজোন শরীরে প্রবেশ করলে ফুসফুসের প্রদাহ, কাশির কারণ হয়। নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড ফুসফুসীয় সংক্রমণের অনাক্রমতা (ইমিউনিটি) কমিয়ে দেয়। ফলে, নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো অসুখ সহজেই শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। এত কিছুর শেষেও আমরা সচেতন নই। ভাবতে কষ্ট হয়, যে আগামী প্রজন্মের জন্য ঘন কালো ধোঁয়ায় ঢাকা ধোঁয়াশার চাদর জড়ানো কোন পৃথিবী উপহার দিতে চলেছি আমরা? যেখানে এক ফোঁটা বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য ছটফট করবে মানুষ! বাঁচার পথ জনসচেতনতা আর বেশি বেশি করে গাছ লাগানো। তবেই এই পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy