Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

ইতিহাসের পাঠ

নির্বাচনে কে জিতিবে, ইস্তাহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হইবে কি না, তাহা ভিন্ন কথা। কিন্তু ইতিহাসের যে-অংশটি অপ্রিয় তাহাকে ঢাকিয়া-চাপিয়া রাখিবার অর্থ, ইতিহাসকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা।

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:২০
Share: Save:

ব্রিটেনের লেবার পার্টি নির্বাচনী ইস্তাহারে ঘোষণা করিয়াছে, ক্ষমতায় আসিলে তাহারা ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাসকে স্কুলপাঠ্য করিবে। শুনিয়া চমক জাগিতে পারে, এত দিন তাহা হইলে ব্রিটিশ শিক্ষার্থীরা এই ইতিহাস পড়ে নাই? না, সত্যই পড়ে নাই। ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে মনোযোগের কেন্দ্র ছিল নাৎসি জার্মানি, ইউরোপীয় ইতিহাস ও আমেরিকার গৃহযুদ্ধ। ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভূমিকা, দেশভাগের ন্যায় প্রসঙ্গগুলি ঊহ্য ছিল, যেন ওই ঘটনাগুলি ঘটে নাই! ফল যাহা হইবার তাহাই হইয়াছে। লন্ডনের কয়েকটি বিদ্যালয়ে পাঠরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত কিছু ছাত্রছাত্রী ভারতে আসিয়া জানাইয়াছে, জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তাহারা এই প্রথম শুনিল। কয়েক প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের নিকট এই ভাবেই ইতিহাসের নিরবচ্ছিন্ন ধারাটি অসম্পূর্ণ রহিয়া গিয়াছে।

নির্বাচনে কে জিতিবে, ইস্তাহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হইবে কি না, তাহা ভিন্ন কথা। কিন্তু ইতিহাসের যে-অংশটি অপ্রিয় তাহাকে ঢাকিয়া-চাপিয়া রাখিবার অর্থ, ইতিহাসকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা। এমন নহে যে ইহা প্রথম বার ঘটিল, যুগে যুগে দেশে দেশে এ-হেন কার্য বিরল নহে। শাসক চাহিলেই বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম হইতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানবিশেষের সুকৃতি বা কুকীর্তি বর্জন-গ্রহণ করিতে পারে, তাহাতে সাময়িক সাফল্য আসিলেও সুদূরপ্রসারী ফল লাভ হয় না। বঞ্চিত হইবার অনুভূতি কখনওই সুখপ্রদ নহে, আসল সত্য জানিবার পরে ছাত্রদের মনের অসন্তোষ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন, এমনকি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও ধাবিত হইতে পারে। ব্রিটেন বলিয়াই ব্যাপার আরও আশ্চর্য বোধ হইতেছে, কারণ রাজনীতি হইতে সংস্কৃতি, জীবনের সর্ব স্তরেই এই ভূখণ্ডে ভারতীয় বা উপমহাদেশীয় বংশোদ্ভূত মানুষের প্রতিপত্তি বিলক্ষণ। লন্ডন মহানগরীর মেয়র সাদিক খান ব্রিটিশ পাকিস্তানি পিতামাতার সন্তান, জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক নাসের হুসেনের জন্ম চেন্নাইয়ে। উপমহাদেশীয় শিকড় চারাইয়া গিয়াছে যে দেশের জনজীবনে, সেই দেশে ঔপনিবেশিক ইতিহাসকে পুস্তক হইতে নির্বাসন দেওয়ার অর্থ সর্বৈব আত্ম-অস্বীকার।

ব্রিটেনে যেখানে এই ‘ঐতিহাসিক’ প্রায়শ্চিত্তের কথা হইতেছে, ভারতে তখন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বলিতেছে ‘নতুন করিয়া’ ইতিহাস লিখিবার কথা। সেই ইতিহাস নাকি লিখিত হইবে ভারতীয়দের দ্বারা, ভারতীয়দের কল্যাণে। বলা হইতেছে, এত দিন যাবৎ পঠিত বা প্রচারিত ইতিহাস ভুল, বিখ্যাত ইতিহাস বইয়ের লেখকগণ একদেশদর্শী, পক্ষপাতদুষ্ট। নূতন শিক্ষাবর্ষে ইতিহাস বই হইতে পাছে সুলতানি আমল বিলুপ্ত হয়, মুঘলের হাতে রাজপুতের পরাভব বিজয়গাথায় বদলাইয়া যায়, প্রমাদ গনিতেছেন বহু শিক্ষাবিদ। ক্ষমতা কখনও নিজ স্বার্থে ইতিহাসকে লুকাইয়া রাখে, কখনও প্রয়োজন মতো ইতিহাসকে ভাঙিয়াচুরিয়া গড়িতে চায়। কিন্তু অপ্রিয় হইলেও যে তাহা সত্য, এবং সেই কারণেই অপরিবর্তনীয়, তাহা বুঝিবার মন শাসকের নাই। ব্রিটেনের পাঠ্যক্রমে ঔপনিবেশিক ইতিহাস ফিরিবার জেরে মহার্ঘ কোহিনুরও হয়তো কোনও দিন ভারতে আসিলেও আসিতে পারে, কিন্তু স্কুলপাঠ্যে রানা প্রতাপ সিংহকে অপরাজেয় বলিয়া চালাইলেই দেশাত্মবোধ ফিরিবে না।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy