Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

গল্পটা পালটে গেল!

বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং বৃহত্তম ফিল্ম-উৎপাদক রাষ্ট্র হিসেবে এই সাফল্য ভারতের ন্যায্য পাওনা। ভারতীয় অর্থনীতি ও কূটনীতির দিকে তাকিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেও বলিউডের এই শক্তির দিকটা দিন দিন গুরুত্ব পাচ্ছে।

নরম-শক্তি: চিনের বাজারে সম্প্রতি দারুণ ব্যবসা করেছে আমির খানের দঙ্গল ছবিটি। পৃথিবী দ্রুত পালটাচ্ছে বইকি।

নরম-শক্তি: চিনের বাজারে সম্প্রতি দারুণ ব্যবসা করেছে আমির খানের দঙ্গল ছবিটি। পৃথিবী দ্রুত পালটাচ্ছে বইকি।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৭ ১১:২০
Share: Save:

অল্প কিছু দিন আগে অবধিও হিন্দি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে বলিউড বলে ডাকাটা অনেকেই পছন্দ করতেন না। হলিউডের তুতো ভাই হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে যে দীনতা প্রকাশ পায়, সেটা স্বাভাবিক ভাবেই এড়িয়ে চলার ভাবনা তাঁদের মনে কাজ করত। কিন্তু দুনিয়ার বাজারে এই তুতো ভাইটির জনপ্রিয়তা কালে-দিনে যে ভাবে বাড়ল, তাতে বলিউড শব্দটির মধ্যে ধ্বন্যাত্মক লেজুড়টুকুই রয়ে গেল শুধু, সে নিজে হয়ে উঠল একটি ভিন্ন সংস্কৃতির বাণিজ্যসফল অভিজ্ঞান, বিশ্বসংসারে ভারতের অন্যতম সফট পাওয়ার। সম্প্রতি দঙ্গল যে ভাবে চিনে রেকর্ড ব্যবসা করল এবং সামগ্রিক ভাবে অ-হলিউডি ছবির বাজারে যে ভাবে দঙ্গল আর বাহুবলী টু (ভারতের বাইরের দর্শকের কাছে কিন্তু বাহুবলীও বলিউড) ছড়ি ঘোরাল, তাতে এই সত্যটাই আরও এক বার প্রমাণিত।

বৃহত্তম গণতন্ত্র এবং বৃহত্তম ফিল্ম-উৎপাদক রাষ্ট্র হিসেবে এই সাফল্য ভারতের ন্যায্য পাওনা। ভারতীয় অর্থনীতি ও কূটনীতির দিকে তাকিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেও বলিউডের এই শক্তির দিকটা দিন দিন গুরুত্ব পাচ্ছে। তাতে এমনিতে আপত্তির কিছু নেই। শুধু সংশয় আছে গুটি কয়। কারণ বলিউডের এ জয়যাত্রা সরাসরি কোনও রাষ্ট্রনীতির হাতে তৈরি নয়। রাষ্ট্র যদি খুব বেশি করে তার ঘাড়ে চেপে বসতে চায়, তাতে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি। কারণ তখন তুমি সফট-পাওয়ারের তল্পিবাহক, নও শুধু ছবি। আরও মুশকিল আছে। তবে সে প্রসঙ্গে আসার আগে বলিউডের যাত্রাপথটির দিকে এক বার তাকানো যাক।

পঞ্চাশের দশক থেকেই সোভিয়েত, চিন এবং আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে হিন্দি ছবি ভাল রকম জনপ্রিয় ছিল। রাশিয়ায় রাজ কপূরের সমাদর তো কিংবদন্তি। বলিউড বুম, ইন্ডিয়া’জ রাইজিং সফট পাওয়ার বইটিতে রূপা স্বামীনাথন সম্প্রতি দেখিয়েছেন, আফ্রিকায় ‘রাগী’ অমিতাভ আর ‘ডিস্কো ডান্সার’ মিঠুন কী তুমুল ভালবাসাই না পেয়েছেন। নব্বইয়ের দশকে উদার অর্থনীতির হাত ধরে বিশ্ব বাজারের ধারণা এবং আয়তন দুই-ই বিপুলা হল। পাল্লা দিয়ে বাড়ল বলিউডের রমরমা। লম্বালম্বি এবং আড়াআড়ি।

সফট-পাওয়ার শব্দবন্ধটির জন্মও নব্বইয়ের দশকেই। জোসেফ নায়ি মার্কিন প্রতিপত্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, শুধু হার্ড-পাওয়ারই (সামরিক শক্তি আর অর্থনৈতিক শক্তি) সব নয়। একটা দেশের সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং বিদেশ নীতি যখন আপনাআপনি আর পাঁচ জনের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ধরা দেয়, তার জোর সাংঘাতিক। এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতির ভূমিকায় খুব গুরুত্ব দিলেন নায়ি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিসরে সংস্কৃতির এই জায়গাটা কিন্তু বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমেরিকা-চিন পিংপং কূটনীতির কথা মনে পড়বে। শোনা যায়, পল ম্যাকার্টনিকে মিখাইল গর্বাচেভ বলেছিলেন, আপনারা (অর্থাৎ বিটলস) না থাকলে পেরেস্ত্রৈকা আসত না। সোভিয়েতের পতন, বিশ্বায়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের জমানায় সংস্কৃতির ক্ষমতা আরও বাড়বে বুঝেই
সফট-পাওয়ারের তত্ত্ব জনপ্রিয় হতে শুরু করে।

বলিউড এতে দু’ভাবে উপকৃত হয়েছে। এক, বিশ্বায়নের জেরে অনাবাসী ভারতীয় তথা দক্ষিণ এশীয়দের একটা বড় অংশ ভিন্‌দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। তাঁদের কাছে দেশীয় বিনোদনের একটা বড় বাজার তৈরি হয়েছে। আবার তার পরের ধাপে সেই বাজারটাই আড়ে-বহরে বেড়ে বিদেশি দর্শকদেরও একটা অংশকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছে। সেটা কী ভাবে?

প্রথমত, পশ্চিমি দুনিয়ার খাস তালুকের বাইরের যে পৃথিবী, তার বড় অংশে বলিউড সহজে জনপ্রিয় হল। বিশেষত এশিয়া ও আফ্রিকার বৃহদংশে সমাজ পশ্চিমের তুলনায় অনেক রক্ষণশীল। অর্থনীতিতেও পিছিয়ে। তাদের কাছে বলিউডি ছবির মূল্যবোধ, সাবেকিয়ানা আর সমসাময়িকতার মধ্যেকার টানাপড়েন অনেক বেশি কাছের মনে হল। কেউ কেউ এমনও বলছেন যে, ৯/১১-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের জেরে পশ্চিমের সঙ্গে ইসলামি দুনিয়ার মানসিক দূরত্ব অনেকখানি বেড়ে যায়। হলিউডের বদলে বলিউডি বিনোদনের গ্রহণযোগ্যতা সে দিক থেকেও বাড়ে। কূটনৈতিক মহলে মনেই করেন, সফট-পাওয়ার হিসেবে বলিউডই পারে নতুন সাঁকো গড়তে।

অন্য দিকে, পশ্চিমও বলিউড থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেনি। রংবাহারি নাচগান সমন্বিত মেলোড্রামা তাদের জন্যেও একটা নতুন আস্বাদ নিয়ে আসে। বলিউড সংক্রান্ত একটি তথ্যচিত্রে এক শ্বেতাঙ্গ মহিলাকে বলতে শুনেছিলাম, হিন্দি ছবির উচ্চকিত আবেগের ফোয়ারা তাঁর বড় ভাল লাগে। কারণ পশ্চিমি ছবিতে সেটা তিনি পান না। বলিউডি ঘরানা এ ভাবেই ক্রমশ একটি স্বতন্ত্র আঙ্গিক হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নেয়। এর সঙ্গে যোগ হয়ে যায় বিশুদ্ধ অর্থনীতি। বিনোদনের ব্যবসা, প্রযুক্তির ব্যবসা, পর্যটনের ব্যবসা।

ফল? ভিন্‌দেশের বক্স অফিসে বলিউডের মারকাটারি সাফল্য, নেটফ্লিক্সে নজরকাড়া সমাদর, অস্কার মঞ্চে স্লামডগ মিলিয়নেয়ার-এর জয়জয়কার, বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তায় টম ক্রুজকে ছাপিয়ে শাহরুখ খান...

বলিউডের এই শক্তির দিকটা গত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেও পরিষ্কার। মনমোহন সিংহের মতোই নরেন্দ্র মোদীও মনে করেন, বিশ্ব অর্থনীতি এবং কূটনীতির ময়দানে বলিউডি সফট-পাওয়ার ভারতের জন্য উপযোগী ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু পাশাপাশি আরও কিছু জিনিস মনে রাখাও জরুরি। কিন্তু সেটা তেমন হচ্ছে বলে মনে হয় না, অন্তত অভিজ্ঞতা সে কথা বলছে না।

সংস্কারী সেন্সর বোর্ডের দাপাদাপির কথাই ধরুন। যে সরকার সফট-পাওয়ারকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে, সেই সরকারের সেন্সর বোর্ডই সফট পাওয়ারের পা টেনে ধরছে! পহলাজ নিহালনি ক’মাস একটু চুপ থাকার পরে এখন আবার জব হ্যারি মেট সেজল নিয়ে পড়েছেন। সংলাপে ‘ইন্টারকোর্স’ শব্দটা কেন থাকবে, তা-ই নিয়ে তাঁর আপত্তি। আবার পাকিস্তানি কলাকুশলীদের নিয়ে গত বছর যে ঝামেলা বাধল, তার কোনও সুষ্ঠু ফয়সালা এখনও অবধি হয়নি। অর্থাৎ যে
সফট-পাওয়ার ব্যবধানমুক্তির কাজে লাগার কথা, তাকে দিয়ে ব্যবধান আরও উসকে দেওয়া হল। অথচ, আগেই বলেছি, বলিউডের আন্তর্জাতিক সাফল্যের একটা বড় কারণই হল মিশ্র সংস্কৃতির অভিজ্ঞান হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পারা। এক দিকে লাগাতার অসহিষ্ণুতা আর গো-সন্ত্রাসের খবর ভারতের নামের সঙ্গে জুড়তে থাকবে আর অন্য দিকে বলিউড নেচেগেয়ে ভালবাসার বাণী ছড়াবে এবং তার গ্রহণযোগ্যতায় বিন্দুমাত্র আঁচ পড়বে না— এমনটা ভাবা বাড়াবাড়ি নয় কি?

এমতাবস্থায় বিশ্ব দরবারে সে নিজেকে ঠিক কোন চেহারায় মেলে ধরতে চায়, সেটা বলিউডকেই স্থির করতে হবে। একদা ব্যাটলশিপ পোটেমকিন থেকে প্রাণিত হয়েই কিন্তু নাতসি জমানার ট্রায়াম্ফ অব দ্য উইল তৈরি হয়েছিল। সফট-পাওয়ারের ইতিহাস কম বিপজ্জনক নয়!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE