দর-কষাকষি: প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী স্বয়ং এসেছেন গোর্খাল্যান্ডের দাবির মীমাংসা করতে, পাশে সুবাস ঘিসিঙ্গ, লেবং, দার্জিলিং, ১৯৮৯
আমার সামনেই কথাটা বলেছিলেন রাজীব গাঁধী। জ্যোতি বসুকে। ১৯৮৯ সালের ১৯ মে রাজভবনের মধ্যাহ্নভোজনে। রাজীব বলেছিলেন, ‘বাসুজি, দুশ্চিন্তা করবেন না। বাংলা আর ভাগ হবে না। আমরা এক থাকব। তবে ঘিসিঙ্গকে পাহাড়ের জন্য আরও টাকা দিতে হবে। দিল্লি থেকে রাজীবের সঙ্গে গিয়েছিলাম পাহাড়ে। জ্যোতিবাবু মাছভাত খাচ্ছিলেন ব্যুফে থেকে নিয়ে টেবিল-চেয়ারে বসে। রাজীব তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কিছু স্যালাড আর একটা পাপড় ভাজা খেতে খেতে কথা বলছিলেন। অনেক আন্দোলনের শেষে ’৮৮-র ২২ অগস্ট ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সই হয়। দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ গঠন হয় ১৫ অক্টোবর।
ইতিহাসবিদ ই এইচ কার বলেছিলেন, ইতিহাস অতীতের সঙ্গে বর্তমানের কথোপকথন। প্রায় সাতাশ বছর পর সুবাস ঘিসিঙ্গের বদলে বিমল গুরুঙ্গ। গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এ-বার চাইছে পৃথক রাজ্য। কই, ঘিসিঙ্গ এত আন্দোলনের পর জ্যোতিবাবুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথে তো যাননি। তবে গুরুঙ্গ ভোটের সময় এত দিদি দিদি করে এখন এমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন কেন? এর আসল কারণ একটাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য যে টাকা দেওয়া হয়েছে তার হিসাব চেয়েছেন। ঘিসিঙ্গের জমানায় জ্যোতিবাবু কখনওই এই কাজটি করেননি। টি ভি রাজেশ্বর গোয়েন্দা কর্তা ছিলেন। গোয়েন্দারা জ্যোতিবাবুকে বলেছিলেন, ওদের টাকা খরচ করতে দিন, হিসেব চাইবেন না। আমাদের কিছু করতে হবে না। ওদের মধ্যেই লড়াই শুরু হবে। ঘিসিঙ্গের বিরুদ্ধে জন্ম নেবে আরও এক নেতা।
এই কৌশলের মধ্যে একটা সিনিসিজম আছে। স্বাধীনতার আগে কমিউনিস্টরা গোর্খাস্তানের দাবি তোলেন। পরে রতনলাল ব্রাহ্মণ আর আনন্দ পাঠকের নেতৃত্বে সুর বদলে সিপিএম পৃথক রাজ্যের বদলে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে। ’৭৭ সালে সিপিএম ক্ষমতাসীন হলে যে চা বাগানে ছিল বাম দাপট, সেখানেই সিপিএম কর্মীরা নিহত হতে শুরু করে। ’৮৭ সালে রাজীব গাঁধী দার্জিলিঙে গেলে জ্যোতিবাবু তাঁর সফরসঙ্গী হতে রাজি হননি। পাহাড়ে তখন আগুন জ্বলছে। রাজীবের জনসভা চূড়ান্ত ফ্লপ হল। তখন কংগ্রেস হাইকম্যান্ডও প্রথম দিকটায় ঘিসিঙ্গকে উসকে জ্যোতিবাবুকে বিপাকে ফেলতে চান। রাজীব জ্যোতিবাবুকে বোঝান ঘিসিঙ্গকে কিছু না দিলে ‘গোর্খা-বিচ্ছিন্নতার’ বিপদ থেকেই যাবে।
সে এক ভয়ংকর সময়। জ্যোতিবাবু ’৮৭ সালের ডিসেম্বরেই চুক্তিটি চূড়ান্ত করতে চান। কিন্তু ঘিসিঙ্গ তখনও ডুয়ার্স আর সমতলের কিছু এলাকা চাইছিলেন। তবে রাজীব গাঁধী বুঝেছিলেন পাহাড় নিয়ে ভোট রাজনীতি করতে গেলে বিপন্ন হতে পারে জাতীয়তাবাদ। ’৮৭ সালের ডিসেম্বরের শীতের রাতে শেষ ত্রিপাক্ষিক বৈঠকটি হয়েছিল বুটা সিংহের বাড়িতে। সার্কুলার রোডের বঙ্গভবনে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আমরা কতিপয় সাংবাদিক জ্যোতিবাবুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। জ্যোতিবাবু এলেন। গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে দোতলার শোওয়ার ঘরে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তিনটি প্রশ্ন করলাম, ত্রিপাক্ষিক চুক্তি কবে? সর্বদলীয় বৈঠক কবে? আপনি কি তৃপ্ত? তিনটি প্রশ্নের একটাই জবাব, ‘আই ডোন্ট নো।’ তার পর একটু থেমে বললেন, ওই যে সোমাইয়া না ফোমাইয়া এক জন স্বরাষ্ট্রসচিব আছেন। উনি বিবৃতি দেবেন। এই বলে ঘরে ঢুকে গেলেন। প্রচণ্ড টেনশন। এত রাতে কপি ধরাতে হবে। কিন্তু জানি না কিছুই। অফিসে এসে ফোন করলাম হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎকে। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আরে বাবা! ঘিসিঙ্গ একটু দর কষাকষি করছে। কিন্তু সমতলের কোনও জায়গা দেওয়া যাবে না। তাই আজ ফাইনাল হল না। ফোন করলাম ঘিসিঙ্গের মধ্যস্থতাকারী সাংবাদিক ইন্দরজিৎকে। বললেন, ‘জ্যোতিবাবু বিরক্ত। আজই চুক্তি চূড়ান্ত করতে চান। কিন্তু সময় নেওয়া ভাল। রাজীব-বুটার মতেও তাতে ঘিসিঙ্গের ধৈর্য্যচ্যুতি হবে। কম প্রাপ্তিতেও রাজি হয়ে যাবে। অনেক রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দু’লাইনের বিবৃতি এল, ‘দ্য মিটিং ইজ ফ্রুটফুল। ফারদার ডিসকাশন উইল কন্টিনিউ।’
রাজীব কিন্তু দার্জিলিং প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত জ্যোতি বাসুজির পাশে এসে দাঁড়ান। আজ এত বছর পর সে দৃশ্য দেখতে পারছি না। কেন্দ্র আর বিজেপির ভেদজ্ঞান হল মায়া। সেই কোন ১৭০৬ সালে সিকিমের রাজার সঙ্গে ভুটানের রাজার যুদ্ধ হয়। সিকিম ব্রিটিশ সাহায্য নিয়ে ভুটানকে পরাস্ত করে জমি উদ্ধার করে। তার পর বেন্টিঙ্ককে দার্জিলিং উপঢৌকন দেন। তার পর দার্জিলিঙের বিকাশ। রেলপথ-সড়কপথ-চা বাগান। আর বাড়তে থাকে নেপালি শ্রমিক। শুধু গোষ্ঠী তো নয়, লেপচা, ভুটিয়া, কত সম্প্রদায় আছে। তবু আজ আন্দোলনে গোষ্ঠীদের আধিপত্য।
২০১৪ সালে বিজেপির লোকসভা ভোটের মূল নির্বাচনী ইস্তাহারে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবির স্বীকৃতি না থাকলেও পৃথক একটি নথিতে সেটি সংযুক্ত করা হয়, তা না হলে গুরুঙ্গ দার্জিলিঙে বিজেপি প্রার্থীকে সমর্থন করতেন না। এখন এটাই বিজেপির গলার কাঁটা। দলের সভাপতি নিজে কিন্তু এখনও বলেননি বিজেপির পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের বিরুদ্ধে। উল্টে মমতার বাংলা ভাষা প্রসারের বিরুদ্ধেও বিজেপি নেতারা পাহাড়ে সরব। অথচ মমতা বাংলা ভাষাকে পাহাড়ে বাধ্যতামূলক করলেন কোথায়? ত্রিভাষা সূত্রে বাংলা ভাষাকে একটি সম্ভাব্য ভাষা হিসেবে রাখা হবে। তাতেও এত আপত্তি? বিকল্প হিসেবেও বাংলাকে রাখা যাবে না?
আসলে তৃণমূলের রাজনৈতিক সম্প্রসারণের চেষ্টা এতটা আক্রমণাত্মক হওয়া উচিত নয়। বরং গুরুঙ্গকে স্থানীয় পুর প্রশাসনের চৌহদ্দিতে বেঁধে রাখতে পারলেই লাভ বেশি শাসক গোষ্ঠীর।
সমস্যা হল, বিজেপি অখণ্ড ভারতের অটুট অঙ্গ কাশ্মীরকে রক্ষা করার জন্য যতটা জাতীয়তাবাদী, বাংলাকে অখণ্ড রাখতে এখনও ঠিক ততটা জাতীয়তাবাদী নয়। সাধু সাবধান। বৃহত্তর নেপাল গঠনের চেষ্টা চলছে অনেক দিনই। তাই গোর্খাল্যান্ড উসকে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে মমতা সরকারকে হেনস্তা করার চেষ্টা আর যা-ই হোক আঞ্চলিক সত্তার রাজনীতি নয়। আর যদি সত্যিই বিজেপি নেতৃত্ব গোর্খাল্যান্ড চান তবে বুক ঠুকে বলুন, হ্যাঁ, আমরা বাংলাকে আবার ভাগ করতে চাই। হ্যাঁ, আগুন নিয়েই খেলতে চাই।
বাঙালির বাংলা ব্রিটিশরা এক বার ভেঙেছে। বাঙালি আবার তা ভাঙতে দেবে না। রাজীব গাঁধী করেননি শেয পর্যন্ত। মোদীজি! দোহাই, আপনিও সে চেষ্টা করবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy