—ফাইল চিত্র।
সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর জীবনস্মৃতিতে চমকের কোনও ঘাটতি নাই। আদিপর্ব হইতে এই প্রদোষকাল অবধি তিনি দেশ ও দুনিয়ার মানুষকে রকমারি চমক ভিন্ন আর কিছু দিয়াছেন কি না, তাহাই বরং কঠিন প্রশ্ন। বস্তুত, তাঁহার নিজস্ব মাপকাঠিতে জাতীয় সঙ্গীত ‘সংশোধন’ করিবার প্রস্তাবটিকে চমকপ্রদ বলিলে অত্যুক্তি হয়, তিনি আস্ত একখানি গান লিখিয়া তাহাকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে প্রবর্তনের দাবি পেশ করিলেই হয়তো মানানসই হইত। তিনি ভারতীয় সংসদে বিজেপির অন্যতম প্রতিনিধি। প্রাণিজগতের নিয়মে তাঁহারও ক্রমে বয়স বাড়িয়াছে, তিনিও ‘প্রবীণ’ সাংসদ হইয়াছেন। কিন্তু এই প্রবীণ সাংসদের দাবি, তাঁহার প্রস্তাবের পিছনে দেশের তরুণ সমাজের চিন্তাভাবনার একটি ভূমিকা আছে। অনেক ভারতীয় তরুণ নাকি জাতীয় সঙ্গীতের দ্বিতীয় পঙ্ক্তির ‘সিন্ধু’ শব্দটি লইয়া বিভ্রান্তি বোধ করিয়া থাকে, কারণ তাহারা যে ভারতের অধিবাসী, সিন্ধু তো তাহার মানচিত্রে আর নাই! মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর এই সংস্কার অভিযানকে তাঁহার ব্যক্তিগত চপলমতির নর্তনকুর্দন বলিয়াই তুচ্ছ করা চলিত। কিন্তু পরিবেশ এবং পরিপ্রেক্ষিতের কারণে এমন উদ্ভট প্রস্তাব লইয়াও কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তার কারণ ঘটিতেছে। এই প্রস্তাবটিতে ভারতীয় রাজনীতির ঘোলা জলকে আরও কিছুটা ঘোলা করিবার দুরভিসন্ধি লুকাইয়া নাই তো? সংশোধনী প্রস্তাবটি পত্রাকারে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠাইয়া সুব্রহ্মণ্যম স্বামী নাকি দ্রুত ‘সাড়া’ পাইয়াছেন। দুর্লক্ষণ বইকি। বিশেষত, সিন্ধু প্রদেশটি যে হেতু পাকিস্তানের অন্তর্গত, সুতরাং এই প্রসঙ্গটিকে ব্যবহার করিয়া ‘বৃহত্তর ভারত’ পুনর্নির্মাণের অতিজাতীয়তাকে— বিপরীত দিক হইতে— খুঁচাইয়া তুলিবার আশঙ্কা থাকিয়াই যায়, তাহাকে তরুণের স্বপ্ন বলিয়া চালাইবার প্রবণতাও অ-সম্ভব নহে। ইহাও লক্ষণীয় যে, বিকল্প জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে আজাদ হিন্দ ফৌজের গৃহীত গানটি ব্যবহারের প্রস্তাবও স্বামীর চিঠিতে রহিয়াছে— সেখানে সিন্ধু-র উল্লেখ সত্ত্বেও! ইহা কি নিছক অজ্ঞতার পরিচায়ক, না কি রাজনীতির প্রয়োজনে সুভাষচন্দ্র বসুকে ব্যবহার করিবার নূতন চাল? নেহরুর ‘প্রতিপক্ষ’ হিসাবে তাঁহাকে ব্যবহারের চেষ্টা বর্তমান শাসকদের আচরণে নূতন নহে।
এবং রবীন্দ্রনাথ। এই মানুষটিকে লইয়া সঙ্ঘ পরিবারের অনুগামীদের সমস্যার শেষ নাই। পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের মন রাখিতে প্রধানমন্ত্রী ইতস্তত ‘গুরুবর’কে স্মরণ করিয়া থাকেন। কিন্তু তাঁহারা ভালই জানেন, গুরুবরের দর্শন এবং মানসিকতা তাঁহাদের বিপরীত মেরুতে। বিশেষত সংখ্যাগুরুর আধিপত্যে নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে। জাতীয় সঙ্গীতটি তাঁহার যে কবিতার প্রথম স্তবক হইতে আহৃত, তাহারই দ্বিতীয় স্তবক শুরু হইয়াছে ‘অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী/ হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী’-র কথা বলিয়া, যাহার মর্মবাণী নাগপুরি রাষ্ট্রভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত। সুব্রহ্মণ্যম স্বামী সেই প্রসঙ্গে যান নাই, কিন্তু তাঁহার প্রস্তাবের সমর্থনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য জুড়িয়াছেন। তাঁহার বক্তব্য: দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ বলিয়াছিলেন, জাতীয় সঙ্গীতের সংশোধন করা যাইতে পারে। রাষ্ট্র যাঁহারা চালাইতেছেন, তাঁহাদের নিকট জাতীয় সঙ্গীত বা রবীন্দ্রনাথ, কোনও কিছুরই যথার্থ কোনও মূল্য নাই, রাষ্ট্রক্ষমতাই একমাত্র মূল্যবান। জল ঘোলা করিলে মাছ ধরিবার সুবিধা হইলে তাঁহারা প্রবল উৎসাহে সমুদ্র মন্থনে নামিবেন। ‘রবীন্দ্রনাথের অসম্মান’ করিলে পশ্চিমবঙ্গে ভোট হারাইতে হইবে— ভাবিয়া হয়তো তাঁহারা আপাতত স্বামীর পথ পরিহার করিবেন। কিন্তু তাহার সহিত গুরুবরের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধার কিছুমাত্র সম্পর্ক নাই। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথের সম্মান লইয়া বাঙালি আজ কতটুকু মাথা ঘামায় থাকে, তাহাও গবেষণার বিষয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy