অতীত: সুখবীর সিংহ বাদল ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গুরদাসপুর, জানুয়ারি ২০১৯। পিটিআই
জয়ললিতাকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই বিপাকে পড়তেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। চেন্নাইতে বসে এডিএমকে-সুপ্রিমো এমন সব দাবি পেশ করতেন যে, বাজপেয়ীর পক্ষে এনডিএ সরকার চালানো মুশকিল হয়ে পড়ত। তখন তো আর নরেন্দ্র মোদী জমানার মতো বিজেপি একাই লোকসভায় ৩০৩ আসনে জিতে আসেনি। অগত্যা এনডিএ-র শরিক, সমর্থক দলগুলিকে তোয়াজ করেই চলতে হত।
বাজপেয়ীর হয়ে জয়ললিতার সঙ্গে দৌত্যের কাজটি করতেন সদ্য প্রয়াত যশোবন্ত সিংহ। যশোবন্তের কাছে জাদুকাঠি বলতে ছিল একই সঙ্গে রাজ্যসভায় থাকার সুবাদে পুরনো সখ্য এবং ফৌজি অফিসার-সুলভ ভদ্র ব্যবহার। তার ভরসাতেই তিনি চেন্নাই ছুটতেন। এক বার জয়ললিতা যশোবন্তকে নালিশ করলেন, বাজপেয়ী তাঁর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। সরাসরি অভাব-অভিযোগ জানানোর উপায় নেই। যশোবন্ত সঙ্গে সঙ্গে চেন্নাই থেকে দিল্লিতে ফোন করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জয়ললিতার কথা বলিয়ে দিলেন। ‘আম্মা’ও শান্ত হলেন।
জয়ললিতার জন্য যেমন যশোবন্ত ছিলেন, তেমনই শিরোমণি অকালি দলকে সন্তুষ্ট রাখার দায়িত্ব ছিল মদনলাল খুরানার উপরে। বিজেপির এই পঞ্জাবি নেতা বিজেপি-অকালি জোটে সমস্যা হলেই সরাসরি প্রকাশ সিংহ বাদলের শরণাপন্ন হতেন। বাজপেয়ী-বাদলের সময় দু’দলের সম্পর্ক এতটাই গাঢ় ছিল যে বলা হত, এ হল ‘নাহু-মাস দা রিস্তা’। শরীরের মাংসের সঙ্গে নখের সম্পর্ক।
‘জোট ধর্ম’ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা বাজপেয়ী ঠেকে শিখেছিলেন। ১৯৯৬-তে যখন প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে শুধু অকালি দল ও শিবসেনা। বাকিদের কাছে বিজেপি তখনও অচ্ছুৎ। লোকসভায় বিজেপি সর্বাধিক আসন জিতে এলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে ১৩ দিনের মাথায় বাজপেয়ীকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। শরিকদের নিয়ে এনডিএ-র মালা গাঁথার কাজটি তাই বাজপেয়ী শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার কাজটিও যত্ন সহকারে করতেন। এখন সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে। মোদী-শাহের অশ্বমেধের ঘোড়া এখন দেশ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাতে যে শুধু কংগ্রেস বা অন্য বিরোধীরাই কোণঠাসা, তা নয়; এনডিএ-র শরিকরাও এ দিক-ও দিক ছিটকে পড়ছে। বিজেপির সবচেয়ে পুরনো জোটসঙ্গী অকালি দলের এনডিএ ত্যাগ তার সর্বশেষ নমুনা।
বিজেপি নেতারা বোঝানোর চেষ্টা করছেন, পঞ্জাবের চাষিদের চাপেই অকালিদের এনডিএ ছাড়তে হয়েছে। নেহাত ‘রাজনৈতিক বাধ্যবাধ্যকতা’। ভাবখানা এমন, যেন চাষিদের আন্দোলন থামলেই তাঁরা আবার গুটিগুটি পায়ে ফিরে আসবেন! কিন্তু শুধু কৃষি বিলের বিরোধিতাই অকালিদের এনডিএ-ত্যাগের একমাত্র কারণ নয়। সম্পর্কে ভাঙন আগেই ধরেছিল। আসলে পঞ্জাবে অকালি দলকে বাদ দিয়েই বিজেপি দীর্ঘ দিন ধরে নিজের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছিল। অকালি দলের নিজস্ব শিখ ভোটব্যাঙ্কেও বিজেপি থাবা বসানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার জন্য অকালি দলের অধুনা প্রধান সুখবীর সিংহ বাদলের বিরুদ্ধ-গোষ্ঠীর সঙ্ঘে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করতেও বিজেপি পিছপা হয়নি।
এনডিএ ছাড়ার পরে সুখবীর অভিযোগ করেছেন, গত সাত-আট বছর ধরে নাম-কে-ওয়াস্তে এনডিএ রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার কোনও বৈঠক হয় না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কারও সঙ্গে কিছু আলোচনাও করেন না। সুখবীরের বাবা প্রকাশ সিংহ বাদল ছিলেন এনডিএ-র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সুখবীরের আপশোস, বাজপেয়ীর আমলে বিজেপি শরিকদের সঙ্গে ঠিকমতো সম্পর্ক রেখে চলত।
আপশোস হতেই পারে। কিন্তু বাস্তবে এমনটাই কি হওয়ার কথা ছিল না? ২০১৯-এ বিজেপি দ্বিতীয় বার একক নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ফেলার পরেই যে এনডিএ তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছিল, তা কি অস্বীকার করা যায়?
‘৩০৩’ সংখ্যার জোরে বিজেপির এখন লোকসভায় কাউকে প্রয়োজন নেই। অকালি, শিবসেনা, জেডি-ইউ’র মতো শরিকদের কাছে এমন কোনও বাড়তি ভোটব্যাঙ্ক নেই, যা বিজেপির খাতায় যোগ করলে বিরাট হেরফের হয়। উল্টে মোদী-শাহই শরিকদের টপকে সরাসরি তাদের ভোটব্যাঙ্ক জয়ের চেষ্টা করতে পারেন। এক সময় মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনা জোটে বালাসাহেব ঠাকরে ছড়ি ঘোরাতেন। কালের নিয়মে শিবসেনা বিজেপির ছোট শরিকে পরিণত হয়েছিল। তার পরেও যখন উদ্ধব ঠাকরে বুঝতে পারেন, বিজেপির চাপে তিনি মহারাষ্ট্রে মরাঠিদের চোখেই খাটো হয়ে যাচ্ছেন, তখন তিনি নিজের ভোটব্যাঙ্ক টিকিয়ে রাখতে এনডিএ ছেড়েছেন। কংগ্রেস, এনসিপি-র মতো পুরনো শত্রুর সঙ্গে হাত মেলাতেও দ্বিধা করেননি। পঞ্জাবে অকালি নেতারাও বুঝতে পারছিলেন, ২০২২-এ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপি ছোটভাই থেকে বড়দা-র ভূমিকা নিতে চাইছে। নিজের দুর্গে কোণঠাসা হওয়ার ভয়ে অকালি তাই আগেভাগেই বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করেছে।
২০১৪-তে অবশ্য বিজেপি এনডিএ শরিকদের এতখানি অনাদর করেনি। শরিকরা নামীদামি মন্ত্রক পেয়েছিল। ২০১৯-এ এসে ছবিটা বদলে গেল। মনপসন্দ মন্ত্রক না পেয়ে নীতীশ কুমারের জেডি-ইউ মন্ত্রিসভায় যোগই দিল না। প্রকাশ সিংহ বাদলের পুত্রবধূ হরসিমরত কউর বাদলকে কোন মন্ত্রক দেওয়া হবে, তা নিয়েও অকালিদের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনিশ্চয়তায় ভুগতে হয়েছিল।
নরেন্দ্র মোদী বরাবরই বলে এসেছেন, অনেক দল মিলেমিশে সরকার গড়লে সেই সরকার নড়বড়ে হয়। তাতে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি থমকে যায়। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে বিজেপির মোকাবিলায় একটা ‘মহাগঠবন্ধন’ তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে কলকাতায় ২৩টি বিরোধী দল এককাট্টা হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদী সংসদে দাঁড়িয়ে তাকে ‘মহাভেজাল’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। ১৯৭৭-এ মোরারজি দেশাইয়ের জনতা সরকার ছিল দেশের প্রথম জোট সরকার। তার পরে কখনও বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ, কখনও চন্দ্রশেখর, কখনও এইচ ডি দেবগৌড়া বা ইন্দ্রকুমার গুজরালের নেতৃত্বে জোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু বেশি দিন টেকেনি। বাজপেয়ীর এনডিএ সরকার প্রথম জোট সরকার হিসেবে পাঁচ বছরের ইনিংস শেষ করার রেকর্ড ঝুলিতে ভরেছিল। কিন্তু ২০১৯-এর নির্বাচনের আগে বর্তমানে কেন্দ্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এবার দেশে জোট রাজনীতিতে ইতি পড়বে। মানুষ জোট সরকারের সমস্যা বুঝতে পারছেন। তাই তাঁরা একটি দলকেই ক্ষমতায় আনতে চান।
হয়তো নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের এখন আর কেন্দ্রে জোটের শরিকদের প্রয়োজন পড়ছে না। কিন্তু ২০১৯-এর ভোটের সঙ্গে দেশে জোট রাজনীতির দিন শেষ হয়ে গিয়েছে বলে এখনই মেনে নেওয়া মুশকিল। মোদী সরকারের বিরুদ্ধেই সনিয়া গাঁধী বিরোধী জোটের সলতে পাকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই আর কংগ্রেসের হাতে বিরোধী জোটের নেতৃত্বের রাশ ছেড়ে দিতে নারাজ। রাজ্য স্তরে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের মতো আঞ্চলিক দলের স্থানীয় বিবাদও জাতীয় স্তরে জোটের পথে বাধা।
নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের হিসেবে একটু হয়তো গন্ডগোল হয়েছে। বিজেপি নেতৃত্বের ধারণা ছিল, শরিকদের আর যাওয়ার জায়গা নেই। অনাদর সয়েও তারা এনডিএ-তেই থেকে যাবে। এমনকি ওড়িশায় বিজু জনতা দল, অন্ধ্রে ওয়াইএসআর কংগ্রেস সরাসরি এনডিএ-র শরিক না হলেও কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধিতার জেরে তারা বিজেপির দিকেই ঝুঁকে থাকবে বলেও মোদী-শাহ নিশ্চিত ছিলেন। তাই রাজ্যসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও বিজেপি নেতারা মাথা ঘামাননি।
উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা এই হিসেব গুলিয়ে দিয়েছে। মতাদর্শগত ভাবে বিপরীত মেরুর কংগ্রেস, এনসিপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে শিবসেনা বুঝিয়ে দিয়েছে, রাজনীতিতে কোনও সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্য রাজ্যেও একই রকম সম্ভাবনা তৈরি হোক, বিজেপি নেতারা চাইবেন না। তাই মাঝেমধ্যেই মহারাষ্ট্রের মহাজোট ভাঙার চেষ্টা চলছে। রাহুল গাঁধীর কংগ্রেসের সামনে চ্যালেঞ্জ একটাই, মোদী-শাহের জুটির ‘তিনশো প্লাস’ সংখ্যার দাপটের মুখে প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে বিজেপি-বিরোধী জোট খাড়া করা। যেমন ভাবে বাজপেয়ী কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এনডিএ গড়ে তুলেছিলেন।
“সংখ্যার জোরে কাপুরুষের আনন্দ হয়। বীরপুরুষের গৌরব একার লড়াইতে”— মহাত্মা গাঁধী বলেছিলেন। আজ থেকে ৯৪ বছর আগে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy