Advertisement
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

ধর্মের হাত ধরে এখানে বেঁচে আছে জীববৈচিত্র

এখনও পলসোনা, মুসুরি, দুই পোষলা গ্রামেই ঝঙ্কেশ্বরীর মন্দির ও সাপের অবাধ বিচরণ লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দিরটি আছে মুসুরি গ্রামে। সেখানে বাৎসরিক উৎসবে মেলা হয়। বছরে এক দিন উৎসবে আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। লিখছেন শুভঙ্কর দেএখনও পলসোনা, মুসুরি, দুই পোষলা গ্রামেই ঝঙ্কেশ্বরীর মন্দির ও সাপের অবাধ বিচরণ লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দিরটি আছে মুসুরি গ্রামে। সেখানে বাৎসরিক উৎসবে মেলা হয়। বছরে এক দিন উৎসবে আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। লিখছেন শুভঙ্কর দে

ঝঙ্কেশ্বরী মন্দির। নিজস্ব চিত্র

ঝঙ্কেশ্বরী মন্দির। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৯ ০০:৪৯
Share: Save:

আশপাশে ঘুরে বেড়াছে সাপেরা। রান্নাঘর, গোয়ালঘর, স্নানের ঘর, শোওয়ার ঘর, বাগান, রাস্তায় অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। কেউ ভ্রূক্ষেপও করছে না। এই গ্রামের বাসিন্দারা কেউ সাপুড়ে বা ওঝাও নন, সকলেই সাধারণ মানুষ। কিন্তু এতে তাঁদের বিশেষ ভয়ডর নেই। কেউ ভ্রূক্ষেপও করছে না। শোনা গেল, মাঝেমধ্যে পায়ের উপর দিয়ে, ঘুমের সময়ে বুকের উপর দিয়ে দিব্যি চলে যায় সাপেরা। রূপকথার গল্প নয়, পূর্ব বর্ধমানের ভাতারের বড়পোষলা, ছোটপোষলা, মুসুরি, পলসোনা গ্রামে গেলে এ দৃশ্য সবার চোখে পড়বে। বর্ধমান স্টেশন বা গোলাপবাগ থেকে কাটোয়া লাইনের বাস ধরে প্রায় ৩০-৩২ কিলোমিটারের রাস্তা পেরলেই এসে যাবে মুসারু গ্রামের স্টপেজ। মুসারু নামটি লোকমুখে মুসুরিতে পরিণত হয়েছে। এখান থেকে টোটোতে মিনিট দশেক দূরে পলসোনা গ্রাম। বাঙালির সবচেয়ে বড়ো উৎসব দুর্গাপুজো। কিন্তু এ চারটি গ্রামের সবচেয়ে বড়ো উৎসব ঝঙ্কেশ্বরীদেবীর পুজো। কী ভাবে এখানে এই ঝঙ্কেশ্বরী পুজো শুরু হল? না কোনও প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তবে লোকমুখে শোনা যায়, প্রায় ৫০০ বছর আগে এই অঞ্চলে এই পুজো শুরু হয়েছিল। এখানকার কোনও এক রাজা না কি স্বপ্নাদেশ পেয়ে খুনগড়ের মাঠে প্রথম এই পুজো শুরু করেন। এই দেবীকে নিয়েও নানা জনশ্রুতি রয়েছে। কেউ বলেন, দ্বাপরে কৃষ্ণ যে কালীয় নাগকে দমন করেছিলেন সেই নাগই এই ঝঙ্কেশ্বরী। আবার অনেকের মতে, ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে বাসররাতে লখিন্দরকে যে কালনাগিনী দংশন করেছিল বেহুলার অভিশাপে সেই কালনাগিনীই বিষহীন অবস্থায় বংশবিস্তার করে এই গ্রামগুলিতে অবতরণ করছে। আবার অনেকে এর সঙ্গে গঙ্গার সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। ঝঙ্কার করে গঙ্গা নেমে আসে। সেই ঝঙ্কারিনী শব্দ থেকেই দেবী ঝঙ্কেশ্বরী।

সাপের দেবী হলেও এই পুজোর নিয়ম কিন্তু মনসাপুজোর সঙ্গে মেলে না। এই অঞ্চলের কেউ নাগপঞ্চমী তিথি পালন করেন না। কেন? না সে বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ওই অঞ্চলে গিয়ে জনৈক বিমান সামন্তের লেখা পয়ার ছন্দের একটি চটি বই পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে লেখা রয়েছে, ‘জরৎকারু মুনী জায়া ঝঙ্কেশ্বরী নাম/ বাসুকী ভগ্নি আস্তিক মাতা করি প্রণাম’। এখানে কবি সময়সীমার উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘ন শো এগারো সালে কৃষ্ণা প্রতিপদে/ প্রথম বরিখা কালে পড়িয়া বিপদে/ আগমন হন দেবী খুনগড় ডাঙ্গায়’। এই গ্রামে সাপকে ঝাঁকলাই বলে ডাকা হয়। এই নিয়েও নানা মত রয়েছে। স্বপন ঠাকুরের লেখা থেকে জানা যায়, ঝাঁকলাই শব্দটি এসেছে জঙ্গুলি শব্দ থেকে। জঙ্গুলি এক ধরনের ক্যাকটাস। জাঙ্গুলি দেবী আবার বৌদ্ধদের দেবী। সেখানে সাপের পুজো হয়। ফলে ঝঙ্কেশ্বরী মন্দিরের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের যোগ থাকলেও থাকতে পারে।

গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, প্রথমে সাপের এমন অবাধ বিচরণ দেখা যেত পলসোনা, মুসুরি, বড় পোষলা, ছোটপোষলা, শিকত্তর, ময়দান এবং নিগন— মোট পাঁচটি গ্রামে। কিন্তু মানুষের আচরণ বিশেষ করে চাষের জমিতে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া-সহ নানা কারণে কয়েকটি গ্রামে সাপের সংখ্যা কমেছে। এখনও পলসোনা, মুসুরি, দুই পোষলা গ্রামেই ঝঙ্কেশ্বরীর মন্দির ও সাপের অবাধ বিচরণ লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দিরটি আছে মুসুরি গ্রামে। সেখানে বাৎসরিক উৎসবে মেলা হয়। বছরে এক দিন উৎসবে সকাল থেকেই আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। প্রথমেই একটি সাপকে দুধ, ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। সেই পুজো দেখতে গ্রামবাসীদের ঢল নামে। এর পরে গ্রামের সকল বর্ণের মানুষ নৈবেদ্য নিয়ে আসেন। কিন্তু সবার পুজো এক সঙ্গে হয় না। কারণ, এখানে বর্ণভেদ রয়েছে। পুজোর শেষে বলি হয়। বলির পরে হোম। তার পরে সন্ধ্যায় চার গ্রামের চার জন পুরোহিত ক্ষীর কলসি নিয়ে যান খুনগড়ের মাঠে। সেখানে কলসিতে কলসিতে ঠোকাঠুকি করে মন্দির ফিরে আসা হয়। মন্দিরের সামনে সেই কলসি ভাঙা হয়। গ্রামবাসীরা কলসির ভাঙা টুকরো বাড়িতে রেখে দেন। জনশ্রুতি, ওই ভাঙা টুকরো বাড়িতে রাখলে কোনও বিষাক্ত সাপ আসে না। পোষলার দেবীমন্দিরে আছে কষ্টি পাথরের শিলা, ওটাই ঝঙ্কেশ্বরী দেবী। পলসোনা মন্দিরের ভিতর রয়েছে লৌকিক নারীর শিলা মূর্তি, তাঁর এক চোখ কানা। অথচ মনসাদেবীর সঙ্গে তুলনা করা হয় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলামের বিস্তারের সময়ে প্রান্তবাসী হিন্দুরা গৌণ দেবদেবীদের প্রতিষ্ঠা করছেন। ধীরে ধীরে তা মূল ধর্মের মধ্যে অঙ্গীভূত হয়ে যাচ্ছে।

জলবায়ুর পরিবর্তনে অনেক প্রাণীই বিপন্ন। সাপেরাও ব্যতিক্রম নয়। সেখানে এই ক’টি গ্রামে সাপেদের যে যত্ন করা হয় তা দেখে সত্যই অবাক হতে হয়। সাপেদের অবাধ বিচরণ। কেউ বিরক্ত করেন না। অযথা সাপ মেরা ফেলার মতো ঘটনা এখানে দেখা যায় না। সাপ মারা গেলে তাকে কলসিতে ভরে রেখে দেওয়া হয়। সাত দিনের মাথায় তা গঙ্গাতে ভাসিয়ে দিয়ে আসা হয়। আজকের দিনে যেখানে আস্তে আস্তে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক জীব, সেখানে শুধু মাত্র ভক্তির জোরে ভয়কে উপেক্ষা করে কয়েক’শো বছর ধরে এ ভাবে জীববৈচিত্রকে টিকিয়ে রাখার কাজ সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

গবেষক, বাংলা বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Religion Biodeversity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy