কাশ্মীরের সঙ্গে পরিচয় বেশ কয়েক বছরের, তাই গত দুই দিন ধরে সংবিধান আর আইনের কচকচি ছাপিয়ে কয়েকটা ছবি সমানে জ্বালাতন করছে। ছবিগুলো যেন কিছুতেই খাপে খাপে মিলছে না। এই যেমন, প্রথম ছবি: স্কুল কলেজ অফিস দোকান বন্ধ, রাস্তাঘাট শুনশান। গলির মোড়ে প্রতি দিনের চেনা রাইফেল-উঁচানো উর্দিধারীদের পাশে হাজির কয়েক হাজার অতিরিক্ত সেনা, যাদের আনা হয়েছে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ সামলাতে। নেতারা বন্দি। জনহীন পথে পথে ব্যারিকেড প্রহরা। ইন্টারনেট, মোবাইল বন্ধ, তাই বাড়ির লোকও বাড়ির বাইরে থাকলে খবর জানার পথ নেই।
এর পর, দ্বিতীয় ছবি। শ্রীনগর শহরের রাস্তা জুড়ে দ্রুত হেঁটে চলেছেন হাজার হাজার যুবকযুবতী, আজানুলম্বিত ফিরন, উস্কোখুস্কো চুল, হাজার জোড়া গভীর জ্বলন্ত চোখ, অস্থির মুখে শুষ্কক্রন্দনরেখা, গলায় স্লোগান আর গান। সেনার গুলিতে নিহত জঙ্গি যুবার শেষকৃত্যে চলেছেন তাঁরা। ক্রমে তাঁরা কাঁধে তুলে নিলেন বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া তরুণ প্রাণহীন শরীর, শপথ নিলেন একাত্ম কণ্ঠে। সদ্যপুত্রহারা মা ভিড়ের দিকে ছুড়ে দিলেন প্রশ্ন: ‘বলো তোমরা কি সেনা বা পুলিশ হতে চাও?’ সহস্র কণ্ঠে চিৎকার উঠল: ‘না!’ ‘বলো তোমরা কি জঙ্গি হতে চাও?’ ‘হ্যাঁ!’ ‘জোরসে বলো কী চাও...’ আকাশবাতাস কাঁপানো উত্তর এল: ‘আজ়াদি!’
সম্প্রতি যে সব সাংবাদিক-প্রত্যক্ষদর্শী কাশ্মীর উপত্যকায় সময় কাটিয়েছেন, সকলেই এই দ্বিতীয় ছবির বর্ণনা দিয়েছেন। কয়েক বছর আগে যেখানে কোনও নিহত কাশ্মীরির শেষযাত্রায় মেরেকেটে একশো লোক হত না, গত তিন বছরে অন্তত দুই ডজ়ন সমাধি-যাত্রা হয়েছে লাখ লোকের অংশগ্রহণে। দ্রুতগতিতে বেড়েছে ভিড়ের পরিমাণ, এমনকি নিচু ক্লাসের পড়ুয়ারাও বেরিয়ে এসেছে নির্ভীক উচ্চারণে ‘জঙ্গি’ হওয়ার শপথ নিয়ে। উত্তরপ্রদেশের নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা থামিয়ে স্বভূমি-উপত্যকায় ছুটে এসে কাশ্মীরি যুবক দুই সপ্তাহের মধ্যে মিলিটারির হাতে প্রাণ দিয়েছেন, আজ়াদির জন্য শহিদ হয়েছেন। পরবর্তী কালে আততায়ীর গুলিতে নিহত এক সাংবাদিক এই পত্রিকাতেই লিখেছিলেন, চোখের সামনে তাঁর উপত্যকার ভোল বদলে দিয়েছে ‘ফিউনারাল’ রাজনীতি, সেনার গুলিতে যত বেশি ছেলের মৃত্যু হচ্ছে, তার কয়েক গুণ বেশি ছেলে ভারতের বিরুদ্ধে মৃত্যুকে পণ করছেন। আগের চেয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এখন অনেক জোরদার, অনেক বেশি ব্যাপ্ত।
এই দুটো ছবিকে দুই দিকে রাখলে দেখা যাবে, মধ্যিখানটায় একটা বিরাট গহ্বর। সেই হাঁ-করা গহ্বরটার কথাই ভাবছি দুই দিন ধরে। ভারতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবিধানিক কেরামতি দেখালেন, শোনা গেল সেটা ভারতীয় গণতন্ত্রের ‘মোমেন্টাস অকেশান’। দিল্লির সতর্ক ও সবল হস্তক্ষেপে সেই ‘মোমেন্টাস’ সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত কাশ্মীর নামক নতুন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বাস্তবায়িত হবে। শুনে পর্যন্ত ধন্দ লাগছে। বাস্তবকে বাদ দিয়ে কি কোনও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব? এই গহ্বর কী ভাবে বোজানো হবে? যে ছেলেরা এ ভাবে আজ়াদির জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত, জঙ্গি হতে প্রস্তুত, যে মায়েরা ছেলেদের প্রস্তুতিতে সর্বান্তঃকরণে রাজি, কী ভাবে তাঁদের মানানো যাবে যে, সংবিধান পাল্টে গিয়েছে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সব কাজ করেন ভেবেচিন্তে, আটঘাট বেঁধে। সুতরাং এই প্রশ্নের উত্তরও তিনি নিশ্চয় ভেবে রেখেছেন। কিন্তু মুশকিল এই যে, তাঁর ও তাঁর দলের কাজের ধরনধারণ দেখে প্রশ্নচিহ্নটা আরও মারাত্মক আকার নিচ্ছে। সংসদ, সংবিধান, আইন, ধারা, এ সব কিছুর উপরে তো আরও একটা গুরুতর জিনিস আছে— মানুষ। অথচ সেই বাস্তবটা যে তাঁদের ভাবনাচিন্তায় এক চিলতে জায়গা পায় না! কাশ্মীরকে না-হয় এই পরিকল্পনায় রাতারাতি ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দেওয়া গেল, কাশ্মীরিদের কী ভাবে ভারতীয় করা যাবে? বর্ষীয়ান নেতা ফারুক আবদুল্লা না কি কেঁদে ফেলে বলেছেন ‘ম্যায়নে কভি ইয়ে হিন্দুস্থান নহিঁ দেখা’। আমরা কি কল্পনা করতে পারছি, ফারুকও যাদের কাছে অত্যন্ত অবাঞ্ছিত পরিমাণে ‘হিন্দুস্থানি’, সেই কাশ্মীরিদের কোন উপায়ে ‘হিন্দুস্থান’ নিজের নাগরিক বানাতে চলেছে?
কাশ্মীরকে দেখে মনে হয়, তার তিনটে মন। একটা মন স্বস্তি পায় পাকিস্তানের সঙ্গে। একটা মন থাকে ‘আজ়াদ কাশ্মীর’-এর স্বপ্নে। আর একটা মন ভীরু শান্তিপ্রিয়, অন্য দুই মনের অশান্তিপ্রবণতার সঙ্গে মেলাতে পারে না একটুও। লক্ষণীয় যেটা— এমনকি এই তৃতীয় মনও নিজেকে নিখাদ ‘ভারতীয়’ ভাবে না। যেখানে তাঁদের বসবাস, সেটা যে ভারতেরই একটা রাজ্য এ কথা যত দূর সম্ভব ভুলে থাকতে চান তাঁরাও। কারণটা সহজ। ভারতের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক মাত্রেই অ-স্বাভাবিক: এক দিকে দমনপীড়ন, আর এক দিকে, দারিদ্রযন্ত্রণা সত্ত্বেও মেলে-ধরা ভূস্বর্গ-আবেদনে নিমজ্জিত টুরিস্ট-আমোদ। দুয়ের কোনওটাতেই কাশ্মীর তার স্বাভাবিক জীবনছন্দ খুঁজে পায় না। কাশ্মীরকে ভারতের মধ্যে সবলে ঢুকিয়ে আনার এই নতুন পদক্ষেপে প্রথম দুই মন যে বিদ্রোহীতর হয়ে উঠবেই, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তৃতীয় মনটিও যে এতে বেঁকে বসবে। যে মন ভারতের জন্য প্রস্তুত নয়, তাকে প্রস্তুতির অবকাশটুকুও দেওয়া হল না গোটা ঘটনায়। বরং পরিষ্কার বুঝিয়ে দেওয়া হল যে, কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নিয়ে কাশ্মীরিদের মতামত ভাবনাচিন্তা কোনও কিছুরই দাম নেই। তাঁদের প্রতিনিধি বা নেতাদেরও কোনও মূল্য নেই দিল্লির কাছে। দিল্লি যা বলবে, একমাত্র সেই পথেই তাঁরা বাঁচতে বাধ্য। বাধ্যতা উপেক্ষা করলে, তাঁদের জেলের বাইরে থাকা, এমনকি বেঁচে থাকারও দরকার নেই।
৩৭০ ধারা ভাল না মন্দ, ভারতের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমতার তাতে কী সুবিধে অসুবিধে, সংবিধান ঠিক কী বলেছে, সংবিধান সংশোধন করতে গেলে কী করা উচিত কী অনুচিত, এই সব নিয়ে বিস্তর আলোচনা এখন। অথচ কাশ্মীর সমস্যা থেকে বিলকুল বাদ পড়ে গিয়েছে কাশ্মীর নিজে। এক দিকে যেমন কোনও আলোচনা না করেই, গণতন্ত্রকে সমীহ না করেই সংসদে সংবিধান সংশোধনের পথ হল, তেমন এও তো ঠিক যে সংসদে যদি বিরোধীরা আরও আলোচনা করার সুযোগ পেতেন, তাতেও মূল সমস্যাটা মিটত না। কাশ্মীর নিয়ে বাকি দেশে সবার মত সবাই শুনছি, কেবল কাশ্মীরিদের মুখ বেঁধে রাখা হয়েছে— এমন একটা ব্যঙ্গছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘুরছে। কী ভয়ঙ্কর সত্য এটা, বোধ হয় টেরও পাচ্ছি না। কেবল শাসক কেন, কাশ্মীরের কথা কাশ্মীরের কাছ থেকেই শুনতে হবে, এমন দাবিতে হইচই ফেলে দিতে কি দেখা গিয়েছে বিরোধীদেরও?
সব মিলিয়ে এ বার কাশ্মীরিদের চোখের সামনেই উন্মোচিত কাশ্মীরিদের প্রতি ভারতের বিস্মৃতি, অবজ্ঞা, অবহেলা। শোনা যাচ্ছে কাশ্মীরে নতুন শিল্প-লগ্নির বন্দোবস্ত, ভিন্রাজ্যের লোকেদের সেখানে জমি কেনার সুবিধে ইত্যাদি। কাশ্মীরের মানুষ কি জানতেও পারছেন, ‘ভাইব্র্যান্ট কাশ্মীর’ বানানোর জন্য তাবৎ ভারত এমন উঠেপড়ে মেতেছে? এক সময় ঔপনিবেশিক শাসকরা আমাদের ভবিষ্যৎটা ছকে দিতেন। আজ কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ আমরা যে ভাবে ছকে দিচ্ছি, তাতে স্পষ্ট, কাশ্মীর আমাদের কাছে উপনিবেশেরই তুল্য।
তাই, যে গহ্বরের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাকে বোজানো অসম্ভব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটাই কথা বলার থাকে। সৈন্যবাহিনী দিয়ে দমননীতি চালিয়ে কাশ্মীরকে চেপেচুপে রাখুন, যত দিন সম্ভব! নয়তো, সমাজতাত্ত্বিক প্রতাপ ভানু মেহতা যেমন বলেছেন— যে প্রক্রিয়ায় কাশ্মীরকে ভারতে ঢুকিয়ে আনা হল, তাতে কাশ্মীরের বাঁধন খুলে দিলে, কে জানে, গোটা ভারতেই কাশ্মীর ছড়িয়ে পড়বে কি না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy