রাষ্ট্রের কাছে পরাজিত হলাম। টেলিফোনের অন্য প্রান্তে হাউ হাউ করে কেঁদেই চলেছে যে ছেলেটি, তার বয়স ত্রিশের কোঠায়। কর্পোরেট। পরিচিত সমাজের পরিসরে নিজেকে সমকামী বলতে অসুবিধা হয় না।
কাশ্মীরের সঙ্গে তার পরিচয় বেশি দিনের নয়। মাস কয়েক আগে প্রথম আলাপের সময়, উত্তেজনার চোটে ছেলেটি একের পর এক ভালবাসার কবিতা পাঠাচ্ছিল বহু দূরে বসে থাকা তারই মতো আর এক ঝকঝকে কর্পোরেটকে। সেই উচ্চশিক্ষিত কাশ্মীরি যুবক দেশ ছেড়েছে কিছু কাল আগে। লিডার নদী, ডাল লেক, বরফ আর উপত্যকার অনিশ্চয়তাকে উপেক্ষা করে চলে গিয়েছে রুক্ষ মরুভূমির দেশে। শান্তি আর নিরাপদ জীবিকার আশ্রয়ে। সেখানেই নিজেকে সমকামী ভাবার ‘পাপবোধ’ থেকে মুক্তি পেয়েছে নেশায়-কবি কাশ্মীরি।
আলাপ ফেসবুকে। কাশ্মীরকে সাক্ষী রেখে কলকাতার প্রেম পৌঁছে গিয়েছে সুয়েজের ধারে-কাছে। গল্প জমেছে। কমেছে দূরত্ব। একে অপরকে ভালবেসে ফেলেছে দুই সমকামী। সঙ্গে বেড়েছে দুশ্চিন্তা। ইসলাম তো মেনে নেবে না এই প্রেম! কাশ্মীরি বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতার প্রেমিককে কী বলে আলাপ করানো যাবে?— বাধা অনেক, তবু কাশ্মীরের বোনের বিয়েতে নিমন্ত্রণ পেয়েছিল কলকাতা। যাওয়ার আগেই খবর, গভীর রাতে উপত্যকায় কার্ফু জারি হল। শুরু হল সেনা টহল। কাশ্মীর কলকাতাকে জানিয়ে দেয়, সে তাকে আর চায় না, তাকে সন্দেহ করে। প্রেমের আবেগে কিছু দিন আগেই যে প্রেমিক নতুন নাম পেয়েছিল শায়েরিতে, সে-ই এখন ‘বিশ্বাসঘাতক ইন্ডিয়ান’।
তবু কলকাতা যেতে চেয়েছিল বিয়েতে, এই ভয়াবহ সময়ে বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে। কাশ্মীর জানিয়েছে, আর সম্ভব নয়। জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক পদক্ষেপে বোনের বিয়ে বাতিল হয়েছে। বাড়ির সঙ্গে একটি বারের জন্যও যোগাযোগ করতে পারেনি সে। বন্ধুদের মারফত শুধু জানতে পেরেছে, সকলে বেঁচে আছে। শুধু মা নির্বাক হয়ে গিয়েছেন।
তার পর থেকে রাত নেই, দিন নেই বিশ্বাসঘাতক কলকাতাকে একের পর এক খবর পাঠিয়ে চলেছে কাশ্মীর। মাঝ রাত্তিরের মিছিল। পেলেট। আহত রক্তাক্ত যুবক হাসপাতালে শোয়া। নিহত এক শিশু। এই শোনো, কী বলছেন সন্তান হারানো মা...
কোথা থেকে পাচ্ছ এ সব খবর? টেলিভিশনে, খবরের কাগজে এত সব দেখতে পাচ্ছি না তো? কলকাতার প্রশ্নে ফের ইন্ডিয়াকে গালি দেয় কাশ্মীর। হতভম্ব কলকাতা সাংবাদিক বন্ধুদের দরজায় দরজায় ঘুরতে থাকে কিছু খবর নিয়ে। সত্যি? সব সত্যি?
মার্ক্সীয় তত্ত্বে নাকি থিসিস আর অ্যান্টিথিসিসের পর সিন্থেসিস হয়। বদলায় সমাজ। আন্তোনিয়ো গ্রামশি লিখেছিলেন, বর্তমান সময়ে তার চরিত্র বদলেছে। এখন থিসিসের সঙ্গে অ্যান্টিথিসিসের বিক্রিয়ায় আবার নতুন থিসিস এবং অ্যান্টিথিসিস তৈরি হয়। ঘটমান বর্তমান ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছয় না। কাশ্মীরও তেমনই। কোনও ক্লাইম্যাক্স নেই। যখনই সকলে ভাবতে শুরু করেন এই বুঝি অন্তিম দৃশ্যে পৌঁছল গল্প, কাশ্মীর নতুন বাঁকে ঢুকে পড়ে।
কিন্তু প্রেমের গল্পে ক্লাইম্যাক্স থাকে। মাস কয়েক আগে কলকাতাকে কাশ্মীর বলেছিল, সে দেশ ছেড়েছে দুটো কারণে— ভাল রোজগার আর প্রেমের জন্য। না, কোনও দিন সে পাকিস্তান যেতে চায়নি। কলকাতাকে বলেছিল, তার পরিবারও কোনও দিন ছাড়তে চায়নি উপত্যকা। বরাবর বাঁচতে চেয়েছে নিজেদের মতো করে। কিন্তু কাশ্মীরে থাকলে যে লড়াইয়ে থাকতে হয়! সে আর পারছিল না লড়াই করতে। সে তো জানে, উপত্যকায় বসে নিজের যৌন অবস্থানের কথা কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়।
কেন নয়? গোঁড়ামি এতটাই? কলকাতাকে থামিয়ে দিয়ে কাশ্মীরের উত্তর— এটা লড়াইয়ের সময়। ব্যক্তিগত কথা বোঝানোর সময় নয়। তাই তো ছেড়ে এলাম সব কিছু।
কর্মসূত্রে কলকাতা যাচ্ছে বিদেশ। কাশ্মীর সে কথা শুনে বলেছিল, ভালই হল, বোনের বিয়েতে মোলাকাতের পর, আবার দেখা হবে বিদেশে। হয় তুমি আমার কাছে আসবে, নয় আমি তোমার কাছে। কেউ জানতেও পারবে না।
আচমকা তৈরি হওয়া ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে সেই কাশ্মীরই এখন বলছে, নাহ বিশ্বাসঘাতক ভারতীয়, দেখা হবে না তোমার সঙ্গে। আমি পাকিস্তানে চলে যাব। সে দেশের নাগরিকত্ব নেব। পরিবার নিয়ে চলে যাব। দেখা করার চেষ্টাই কোরো না। আসলে আমাদের দেখা হওয়ার কথাই ছিল না। আমরা তো এক রকম নই! তোমাদের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘এক দেশ, মহান দেশে’র কথা। বলতে পারো, কেমন সেই দেশ, যেখানে কাশ্মীরের ঘোষণায় শুধুমাত্র কাশ্মীরই অনুপস্থিত থাকে! বন্দুকের নলের সামনে ভয়ে অপমানে গুটিয়ে থাকে আমার পরিবার অন্ধকার ঘরে? তাঁদের সঙ্গে কী বলে আলাপ করাব তোমায়? ইন্ডিয়ান? তাঁরা তো ধরেই নেবেন তুমি বিশ্বাসঘাতক! কিসের প্রেম, কিসের রোম্যান্স? আগে তো বাঁচতে হবে ভাই! অনেক হয়েছে। ধরে নাও আমাদের কখনও দেখাই হয়নি।
সাংবাদিকতার পেশায় আসার পর অগ্রজ দীক্ষা দিয়েছিলেন— শকুন হতে শেখো। ভাগাড়েও খবর ওড়ে। খবরই তো! কলকাতা যখন সাংবাদিকদের দরজায় দরজায় ঘুরছে, সে সময়েই ‘খবর’ হয়ে এল দুই প্রেমিকের এই উপাখ্যান।
আচ্ছা, তোমাদের নাম লিখতে পারব তো? রাতারাতি সেলেব্রিটি হয়ে যাবে কিন্তু! আচমকা ঝলসে উঠল স্বর, শেষ বারের মতো— বিশ্বাসঘাতকতা কোরো না! আর নেওয়া যাচ্ছে না। শুধু জানিয়ে দাও— আমরা রাষ্ট্রের কাছে পরাজিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy