ঋজু: ভাগবতচন্দ্র দাশ। ছবি লেখকের সৌজন্যে
শ্লেষ সহ্য হয় না রক্ষণশীলদের। তখনও নয়। এখনও নয়। প্রথমে তাঁরা ক্ষিপ্ত হন। তার পর সামাজিক আক্রমণ শানান। শেষে প্রাণনাশের হুমকি। কখনও কখনও প্রাণনাশও। তখন মানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সময়ে। রক্ষণশীল সমাজকে নাড়িয়ে দেওয়ার সাহস দেখালেন তিনি। একসময়ে কলকাতায় দেহরক্ষী নিয়ে ঘুরতে হয়েছিল তাঁকে। আর বিদ্যাসাগরের আদর্শকে মনে প্রাণে মেনে চলা ভাগবতচন্দ্রকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। কারণ তিনিও যে রক্ষণশীল সমাজকে প্রশ্ন করছিলেন। ব্যঙ্গ করছিলেন।
১৮৫৬ সাল। লর্ড ডালহৌসি পাস করলেন বিধবা বিবাহ আইন। এই আইনের তীব্র বিরোধিতা করেন রাধাকান্ত দেব ও রক্ষণশীলেরা। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে ওই বছরই শুরু হয়ে যায় বিধবা বিবাহ। সতীদাহ প্রথা বন্ধের পরে এটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ সমাজ সংস্কারের কাজ। এর প্রায় উনিশ বছর পরে ১৮৭৫ সালে মেদিনীপুর জেলার বর্তমান মোগলমারি বৌদ্ধ বিহারের কাছে তররুই গ্রামে জন্ম ভাগবতচন্দ্র দাশের। বাবার নাম ছিল হরপ্রসাদ দাশ। পরিবারটি রক্ষণশীল।
ভাগবতচন্দ্র মেধাবী ছিলেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভাল ফল করেন। ভর্তি হন মেদিনীপুর কলেজে। কলেজে পড়ার সময়ে তিনি বিদ্যাসাগরের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্রত গ্রহণ করেন। আইনের ডিগ্রি ছিল তাঁর। ফলে ওকালতি পেশা। মেদিনীপুর জেলা জজ কোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। পসার জমিয়েছিলেন অল্পদিনেই। পেশায় প্রতিষ্ঠা। সংসার ধর্ম অবশ্য আগেই। ঘটনাচক্রে মেদিনীপুরের মীর বাজারের পতি পরিবারের মেয়ে গিরিবালার সঙ্গে দেখা। পরে বিয়ে হয় তাঁদের। শহরের বিবিগঞ্জে পুরনো কোঠা বাড়ি কিনলেন। স্থায়ী বাসা হওয়ার পরে শুরু হল পূর্ণ উদ্যমে সমাজ সংস্কারের কাজ। ভাগবতচন্দ্র বুঝেছিলেন, মানুষের মধ্যে যুক্তিবোধ তৈরি না হলে শুধু আইন করে সমাজের পরিবর্তন সম্ভব নয়। বুঝেছিলেন আঘাতটা হানতে হবে আচার সর্বস্ব জীবনযাত্রার মূলে। ফলে শুরু হল ব্যঙ্গাত্মক রচনা লেখা। প্রথম দিকে ‘ধূর্যটি প্রসাদ বুদবুদ’ ছদ্মনামে লিখতেন। ১ বৈশাখ নতুন পাঁজি প্রকাশিত হয়। ভাগবতচন্দ্র ব্যঙ্গাত্মক লেখাগুলো সংকলিত করে ‘নব পঞ্জিকা’ নাম দিয়ে ১ বৈশাখ প্রকাশ করতেন। পরে অবশ্য নিজের নামেই ‘নব পঞ্জিকা’ প্রকাশ করেছেন। নবপঞ্জিকায় একটি বাক্য থাকত, ‘মূল্য চারি আনা অথবা পাঁচজনকে পড়াইবার প্রতিশ্রুতি’। তাঁর শেষ প্রকাশিত ‘নব পঞ্জিকা’য় এমন বিনিময়-বার্তা রয়েছে। ভাগবতচন্দ্রের শ্লেষাত্মক লেখা বহু মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখাত। কিন্তু রক্ষণশীল হিন্দুরা ক্ষিপ্ত হতেন। নানা ভাবে তাঁকে আক্রমণ করতেন। ভাগবতচন্দ্রকে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি অদম্য।
‘বর্তমান সমাজের ইতিবৃত্ত’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। এমন বই সেই সময়ে বাজারে ছিল না। এই বইয়ে তিনি সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর-কলি, এই চারটি যুগে ভারতীয় ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতির বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়া ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র, এই চার বর্ণের ইতিহাসের সঙ্গে বাংলার প্রায় সমস্ত জাতির বংশ বিবরণ শাস্ত্রীয় প্রমাণ-সহ লিপিবদ্ধ করেন। বইটি তৎকালীন বুধমণ্ডলীর কাছে সমাদর পেয়েছিল। ‘প্রবাসী’, ‘বঙ্গবাণী’, ‘সম্মিলনী’, ‘সত্যবাদী’ প্রভৃতি পত্রিকায় বইটির ইতিবাচক এবং উচ্ছ্বসিত সমালোচনা হয়েছিল। এ ছাড়াও ‘বিধবা বিবাহ’ নামে একটি পুস্তক রচনা করেন। বইয়ে বিবাহের ইতিহাস, আর্য সমাজের ক্রমবিকাশ, নারী স্বাধীনতা খর্ব করার ইতিবৃত্ত এবং বিধবা বিবাহের শাস্ত্রীয় প্রমাণ ও লৌকিক যুক্তি দিয়েছিলেন।
বিধবা বিবাহের বিপক্ষে কোনও পণ্ডিত কুযুক্তি আনলে বিদ্যাসাগর শাস্ত্রীয় উদাহরণ দিয়ে খণ্ডন করতেন। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পর পণ্ডিতেরা একটি নতুন আপত্তি তোলেন। তাঁদের মতে, হিন্দু বিবাহ আসলে আত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন। সুতরাং পতির আত্মা পরলোকগত হলেও বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয় না। অতএব বিধবার বিবাহ অসম্ভব। ভাগবতচন্দ্র ১৯২৯ সালে শাস্ত্রীয় যুক্তি দিয়ে এই কুযুক্তি খণ্ডন করে ‘নারী মঙ্গল’ নামে বই লেখেন। বইটির মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘বসন্তের মলয় হিল্লোল অপেক্ষা কাল-বৈশাখীকে আমি বাল্যকাল হইতে ভালোবাসি। উহা আমার স্বভাব। সেই স্বভাবের বশবর্তী হইয়া পুস্তকখানি লিখিয়াছি সুতরাং পাঠক সংখ্যা অধিক হইবে বলিয়া বোধ হয় না’। মাত্র ৪৮ পাতার ওই পুস্তকে যে কালবৈশাখীর ঝড় তিনি তুলেছিলেন তার তুলনা সমকালে খুব একটা দেখা যায় না। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন নারী অর্থাৎ মায়েরা যদি যথার্থ শিক্ষা না পান তবে তাঁদের সন্তানেরা কখনওই শিক্ষিত হবে না। মায়ের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার পুত্রের মনে ছেলেবেলায় প্রবেশ করবে এবং বয়সকালে তার যুক্তিবোধকে নষ্ট করবে। তাই ওই বইয়ে তিনি নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে শাস্ত্রীয় যুক্তিগুলো এমন ভাবে সাজিয়ে ছিলেন যা খণ্ডন করা কোনও সুপণ্ডিতের পক্ষেও অসম্ভব ছিল।
তবে ভাগবতচন্দ্রের নারী মঙ্গলের কথা শুধু সভা-সমিতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিদ্যাসাগরের পথ অনুসরণ করে ভাগবতচন্দ্র মেদিনীপুরে বিধবা বিবাহ দেওয়ার জন্য কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীকে নিয়ে ১৯২৩ সালে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। সমস্ত খরচ তিনিই চালাতেন। ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর মেদিনীপুর শাখার মুখপত্র ‘মাধবী’তে ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী লেখেন, ‘বিদ্যাসাগরের প্রতি সকলে সমারোহ করিয়া শ্রদ্ধা প্রকাশ করিতে পারেন না তবু মেদিনীপুরে দিন দুঃখীর কাজ করিবার মত আদর্শ দেখা যায়। এখানে অল্পবিত্ত অথচ মহাপ্রাণ লোক বহুকাল ধরিয়া লোকচক্ষুর অগোচরে কোথাও কোথাও নিঃশব্দে কাজ করিতেছেন। মেদিনীপুরের উপর দিয়া এত দুঃখ দুর্গতি গেলো তবুও এখনো এখানে উৎসাহের অভাব নাই। বিদ্যাসাগরের ভক্তেরা নির্ধন কিন্তু উৎসাহহীন নহেন। মেদিনীপুরে ভাগবত দাশ মহাশয় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে একটি বিধবা বিবাহ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করিয়া ষোল বৎসর যাবত ১৭৪টি বিধবা বিবাহ দিয়াছেন। অস্পৃশ্যতা নিবারণ সম্বন্ধেও ইঁহাদের কাজ চলিয়াছে। ঈশ্বরচন্দ্র আমাদের সবার চিন্ময় গুরু বলিয়া পিতৃবৎ পূজ্য’।
ঐতিহাসিকদের মতে, অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ অংশটি আগে উৎকল বা উত্তর কলিঙ্গ অর্থাৎ ওড়িশার অন্তর্গত ছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেও কাঁথি থেকে দাঁতন হয়ে গোপীবল্লভপুর পর্যন্ত একটি বড় অংশের মানুষের ভাষা ছিল উড়িয়া। এছাড়া ময়ূরভঞ্জ সংলগ্ন বিহারের সিংভূম প্রদেশের কিছু অংশে ওড়িয়া ভাষার প্রভাব ছিল যথেষ্ট। এই কারণে ওড়িশার কংগ্রেস নেতারা ১৯৩১ সালে মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম, গোপীবল্লভপুর, নয়াগ্রাম, কেশিয়াড়ি, দাঁতন, মোহনপুর, কাঁথি, এগরা, রামনগর প্রভৃতি থানাকে ওড়িশার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। ভাগবতচন্দ্র উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ওড়িয়া ভাষা ছিল তাঁর কাছে মাতৃভাষা স্বরূপ। তাই সেই সময়ে ওড়িশার কবি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পণ্ডিত গোদাবরীশ মিশ্রের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। তাঁদের দাবি প্রতিষ্ঠা করার কাজে তিনি বহু জায়গায় সভা করেন।
ওড়িশার দাবি বিচারের জন্য ব্রিটিশ সরকার স্যর স্যামুয়েল, ওডোনেল, এইচ এন মেটা এবং টি আর ফুকনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে। অন্যদিকে বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে মেদিনীপুরকে বিচ্ছিন্ন করার এই দাবির বিরোধিতা করে প্রবল আন্দোলন শুরু হয়। স্যামুয়েল ও ওডোনেল কমিটি মেদিনীপুরে ১৯৩১ সালে ৮, ৯ ও ১০ ডিসেম্বর উভয় পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। কমিটির সামনে ওই অঞ্চলগুলোর ওড়িশা ভুক্তির পক্ষে সওয়াল করেন ভাগবতচন্দ্র। বিপক্ষে সওয়াল করেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। উভয়পক্ষের কথা শোনার পর কমিটি মেদিনীপুরের বা সিংভূমের কোনও অংশ ওড়িশার সঙ্গে সংযুক্ত না করার কথা ব্রিটিশ সরকারকে জানায়। ভুবনেশ্বরের মহাফেজখানায় ভাগবতচন্দ্রের লেখা চিঠিগুলো রক্ষিত আছে। কিন্তু ভাগবতচন্দ্রকে লেখা গোদাবরীশ মিশ্রের চিঠিগুলোর হদিস আজ আর পাওয়া যায় না।
বিদ্যাসাগরের একনিষ্ঠ ভক্ত ভাগবতচন্দ্র নীরবে তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করতেন। তাই ১৯৩৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর মেদিনীপুর শহরে বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরের দ্বারোদঘাটন কালে রবীন্দ্রনাথ মেদিনীপুর এলে তাঁকে স্বাগত ভাষণ দিয়ে বরণ করার ভার দেওয়া হয় ভাগবতচন্দ্রের উপর। ওকালতিতে পসার জমিয়েছিলেন। প্রবল ব্যস্ত। কিন্তু সেই সঙ্গে মগ্ন পাঠক। আয়ের একটা বড় অংশই তিনি বই কেনায় খরচ করতেন। সংস্কৃত-বাংলা-ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, পুরাণ থেকে সমাজতত্ত্ব, সবই ছিল তাঁর আগ্রহের বিষয়। ১৯৫৭ সালের ৩ জানুয়ারি কোর্টে সওয়াল করার সময় ভাগবতচন্দ্র হৃদরোগে আক্রান্ত হন। সেদিনই তাঁর মৃত্যু হয়। ভাগবতচন্দ্রের মৃত্যুর পর ভ্রাতুষ্পুত্র তথা প্রখ্যাত ঐতিহাসিক বিনোদশঙ্কর দাশ তাঁর নামে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ এর মেদিনীপুর শাখায় দু’টি রানিং কাপ স্মৃতিতে চালু করেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক কৃতিত্বের জন্য এই কাপ দেওয়া হত। ভাগবতচন্দ্রের সংগৃহীত বইগুলো স্থানীয় রাজনারায়ণ বসু লাইব্রেরিতে দান করেন বিনোদশঙ্কর।
বিদ্যাসাগরের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী উদযাপন চলছে। সেই সঙ্গেই চলছে নাবালিকা বিবাহ। এখনও শুধুমাত্র বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক মেয়ের পড়া বন্ধ হয়ে যায়। নারী স্বাধীনতা খর্ব হয় বহু কারণে। কুসংস্কার এখনও মুছে ফেলা যায়নি সমাজ থেকে। রক্ষণশীলতার নানা বিপদে এখনও ব্যতিব্যস্ত হতে হয়।
অথচ প্রায় শত বর্ষ আগে মেদিনীপুরে বসে একজন বই লিখে সওয়াল করছেন নারীর স্বাস্থ্য, স্বাধীনতা, শিক্ষা নিয়ে! বিদ্যাসাগরের পথে।
লেখক শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy