এ বছর এই ছবি দেখা যাবে না। ফাইল চিত্র।
ছোটবেলা থেকে পয়লা বৈশাখ মানেই ছিল আনন্দ। আমরা যেখানে থাকতাম, যে ছোট পাড়ায়, সেখানেও আমাদের বয়সি ছেলেমেয়েদের কাছে পয়লা বৈশাখ বিশেষ আনন্দ বহন করে আনত। আমাদের ঠিক পাশেই ছিল এক মস্ত চারতলা বাড়ি। সে বাড়ির মালিকের বড় একটি কাপড়ের দোকান, স্টেশন বাজারের জমজমাট এলাকায়। এ ছাড়াও তাঁর ছিল একটি গেঞ্জির কল। সে বাড়ির ছেলেমেয়েরা সব আমাদের বিকেলবেলার খেলার সঙ্গী। পাড়ার সব বালকবালিকার নিমন্ত্রণ হত সে কলের পয়লা বৈশাখ উদযাপনে। আমরা বিকেলবেলা সেজেগুজে দল বেঁধে সেই বস্ত্রালয়ে গিয়ে হাজির হতাম।
দোকানের পরিসরটি বেশ বড়। সেখানে তখন অবিরাম বানানো চলছে ঘোলের শরবত। এক গ্লাস করে পেতাম প্রত্যেকে। আর একটি প্লেটে পেতাম দু’টি করে দরবেশ আর একটি শিঙাড়া। সেই বাড়ির যে ছেলেটি আমাদের খেলার সঙ্গী ছিল, তার নাম মোটা বাবু। তাকে অকারণেই মোটা বাবু বলা হত। কারণ, আমাদের খেলার সঙ্গীদের ভিতরে আরও এক জন বাবু নামধারী বালক ছিল। তার খুব ছোটখাটো চেহারা। তাকে ডাকা হত পুঁচকে বাবু বলে। আইডেন্টিটি পৃথক করে বোঝানোর জন্য স্বাভাবিক চেহারা সত্ত্বেও মোটা বাবুকে ওই ডাক সহ্য করে নিতে হত। মোটা বাবুদের বাড়িতে পয়লা বৈশাখের তিন-চার দিন আগে থেকেই ময়রা এসে ভিয়েন বসাত তাদের প্রশস্ত উঠোনে। মিষ্টি তৈরির গন্ধ সেই বাড়ি থেকে সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ত। সবচেয়ে বেশি গন্ধ পেতাম আমরা। কারণ একেবারে পাশের বাড়ি তো। আমার বয়সি সকল বালকের মুখেই একটা খুশির আমেজ এসে ভর করত।
মোটা বাবুদের দোকান থেকে বেরিয়ে আসার পরে আমাদের ছেলেপুলেদের দলটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেত। কারণ প্রত্যেকেরই বিভিন্ন দোকানে বার্ষিক নিমন্ত্রণ রক্ষা করার দায়িত্ব তাদের বাবা-মায়েরা সন্তানদের হাতে দিয়ে দিতেন। কোনওটা মুদির দোকান, কোনওটা স্টেশনারি দোকান। এমনকি, সোনার দোকানও বাদ যেত না। প্রত্যেক দোকান থেকেই বালকদের দেওয়া হত একটা গোল করে মোড়ানো, রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো, সে বছরের বাংলা ক্যালেন্ডার এবং সঙ্গে এক বাক্স মিষ্টি। দোকানে দোকানে ঘুরে মিষ্টির প্যাকেট ও ক্যালেন্ডারসমুহ সংগ্রহ করে মহা ফুর্তিতে আমরা বাড়ি ফিরতাম।
আরও পড়ুন: নববর্ষকে বরণ করার মতো অবস্থাই যে আমাদের এবার নেই
এ বছরের জন্য তোলা থাক দোকানে হালখাতার এই ছবি। ফাইল চিত্র।
এ তো হল শৈশবের কথা। পরিণত বয়সে যখন লেখা কর্মে নিয়োজিত হলাম, তখন পয়লা বৈশাখে এসে পড়ল অন্য জাতের উৎসাহ। তখন আর কাপড়ের দোকানের নিমন্ত্রণ নয়, একেবারে প্রকাশকদের ছাপানো চিঠি এসে বাড়িতে পৌঁছে যেতে লাগল। সঙ্গে ফোন, ‘পয়লা বৈশাখ কিন্তু আপনাকে আসতেই হবে।’ যাই তো বটেই। কখনও কখনও পয়লা বৈশাখে নতুন কবিতার বই বেরোয়। আমার ‘ঘুমিয়েছো, ঝাউপাতা’ নামক একটি বই বেরিয়েছিল এই পয়লা বৈশাখেই। তার পরেও বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে আমার আরও কয়েকটি কবিতার বই বেরিয়েছে। গত বছরের আগের বছরই তো বেরোল একখানি। কিন্তু বই যদি নাও বেরোয়, তা হলেও আনন্দ পাবলিশার্সের দফতরে পয়লা বৈশাখে গেলে কত কবি-লেখকের সঙ্গে দেখা হয়, আড্ডা হয়। সকলেই ওই দিনটিতে উপস্থিত হন। গত বছরের আগের বছরেও গিয়েছিলাম। সেখানেও কত কবি-লেখক-প্রবন্ধকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ। দে’জ পাবলিশিংয়ে ওরা একটা খাতা রাখেন। যেখানে সকলে ওই পয়লা বৈশাখে উপস্থিত হয়ে কেমন লাগছে, তা লিখে দিয়ে যান। দে’জ-এর পয়লা বৈশাখের আড্ডাটিও আনন্দ পাবলিশার্সের জমায়েতের মতো অনেক বছর ধরে চলে আসছে।
আরও পড়ুন: সামনে কঠিন পথ, প্রশাসনের মানবিক মুখ জরুরি
এ বছর সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে হবে আমাদের। সকলের সঙ্গে দেখাশোনা, মিষ্টান্নগ্রহণ ও কোল্ড ড্রিঙ্কসের আপ্যায়ন থেকে একেবারেই দূরে সরে থাকতে হবে আমাদের সকলকে। কারণ, এই করোনা নামক মারণ ভাইরাসের হাত থেকে আত্মরক্ষার কারণে সরকার থেকে লকডাউনের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তার মেয়াদ চলবে অন্তত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। তবে আমার মনে একটা আশা আছে। এই লকডাউন উঠে যাওয়ার পরে, যদি লকডাউন সঙ্গে সঙ্গে আবার চালু না করা হয়, তবে অবস্থা স্বাভাবিক হলে, নিশ্চয়ই পয়লা বৈশাখের এই উদযাপনটির জন্য প্রকাশকেরা অন্য কোনও তারিখ ধার্য করবেন। আপাতত সকলের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার কারণে, পয়লা বৈশাখের আনন্দ স্থগিত থাকলেও কাছাকাছি সময়ে কোনও একটা দিন প্রকাশকেরা লেখকদের আমন্ত্রণ করবেন তাঁদের দফতরে, এই আশা আমি রাখি। যে সব বই বেরনোর কথা আছে, সেগুলি পয়লা বৈশাখে না হলেও অন্য একটি দিনে প্রকাশ পাবে। এ বার পয়লা বৈশাখেও ঘরবন্দি থাকতে হবে ভেবে একটু বিষণ্ণতা আছেই। কিন্তু এই গৃহবন্দি অবস্থা এখন সকল নাগরিকের ক্ষেত্রেই খুব দরকারি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy