১ বৈশাখ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ। উদয়নের দোতলা থেকে বয়সের ভারে ক্লান্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নামিয়ে আনা হল একতলায়। আশি বছর পূর্তি উৎসব। অভিভাষণটি লিখেছেন। কিন্তু পড়তে পারলেন না। পড়তে দিলেন পাশেই থাকা ক্ষিতিমোহন সেনকে। অভিভাষণে স্পষ্ট জানালেন, এক দিন ‘মানবমৈত্রীর বিশুদ্ধ পরিচয়’ পেয়ে ইংরেজকে ‘হৃদয়ের উচ্চাসনে’ বসিয়েছিলেন। কিন্তু তার চরিত্রে ‘সাম্রাজ্যমদমত্ততা’ ছিল না। জন্ম নিল ‘সভ্যতার সংকট’।
এই সঙ্কট কি শুধুই সভ্যতার? যে কোনও ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি বা ‘আইডিয়া’কে নির্মাণ করে গোষ্ঠী ও ব্যক্তি মানুষের স্মৃতি। সেই স্মৃতির সঙ্গে বর্তমান যখন খাপ খায় না, তখনই উপস্থিত হয় বৃহত্তর পরিসরে ব্যক্তির ভাবনা-সঙ্কটজনিত অসহায়তা।
এই অভিভাষণের অনতিপূর্ব কাল থেকে আমৃত্যু রবীন্দ্রনাথ দেখলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও বাংলায় তার অভিঘাত। বাড়ছে ক্ষুধার পরিসর। ধ্বস্ত পদক্ষেপে গ্রাম এগিয়ে আসছে শহরে। অদূরে মন্বন্তরের পদধ্বনি। ভাঙছে মধ্যবিত্তের কাঠামো। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, ‘‘..রণদানব পাক দিয়ে নাচছে, গায়ে লেখা ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩।... ধোঁয়ায় সূর্য দেখা যায় না, সমস্ত ঝাপসা। নীচে লেখা নববর্ষ— ১৯৪৩।’’ (মন্বন্তর)
কিন্তু ধোঁয়ার মধ্যেও সূর্যের সন্ধান জরুরি। তাই, ১৩৪৮ নববর্ষেই, শুধু নাতি সৌম্যেন্দ্রনাথের অনুরোধে নয়, গভীর বিশ্বাসে রবীন্দ্রনাথ শুনলেন, ‘ওই মহামানব আসে…’। অগস্ট আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, আইএনএ-এর লড়াই, দাঙ্গা, দেশভাগ পেরিয়ে এই সময়পর্বের মহামানব স্বাধীনতা।
আরও পড়ুন: বাবা-মা কলকাতায়, স্ত্রী আমেরিকায় আর আমি এখানে, খুবই চিন্তায় আছি
তবে বাঙালির সমকালের সঙ্কট কোথায়? স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচতে ভালবাসে সে, মনে হয় আরও বেশি পছন্দ করে বিস্মরণকে। এই বিস্মরণেরও নিজস্ব যুক্তি আছে। ‘কু’ ও ‘সু’ যুক্তি। সে যুক্তি অনেকাংশেই অস্বীকারের ধারণার উপরে তৈরি। সেখানেই সঙ্কট।
প্রথমত, এ বিষয়ে যেটা মনে আসে, তা হল বাংলা ভাষার বিকৃত রূপের বাড়বাড়ন্ত। চতুর্দিকে ‘কেন কি’, ‘ও বলল কী’, ‘উও বলল’ জাতীয় জগাখিচুড়ি ভাষার প্রাধান্য। ‘লোন ওয়ার্ড’ ভাষার সম্পদ। কিন্তু তার যাতায়াতের নির্দিষ্ট চলন-পর্ব রয়েছে। জগাখিচুড়ি ভাষা বাংলা ভাষাটিকেই ওলোটপালট করে দিচ্ছে। এবং বহু বাঙালি ভাবনার স্তরে এই বিকৃতিকেই গর্বিত মান্যতা দিচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, এই মান্যতার স্পর্ধা তৈরি করে অর্থনীতি। বাংলা ভাষার সঙ্গে বৃহত্তর অর্থনীতির পরিসরের যোগ নেই বা খুবই কম। এর জন্য অনেকাংশে দায়ী রাষ্ট্র ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা। কোনও ভাষার সঙ্গে বিরোধ না রেখেও বলা যায়, ‘রাজভাষা’ হিসাবে বিশেষ একটি ভাষাকে উঁচুতে দেখানোর প্রবণতাকে অবলীলায় স্বীকার করেন বড় অংশের বাঙালি। বহু অভিভাবক দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে সন্তানের জন্য ‘রাজভাষা’টিই বেছে নেন। অথচ রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে তা স্থানীয় স্তরেও কিছু পরিবর্তন ঘটাতে পারে। উদাহরণ: আসানসোল পুরসভার সমস্ত দোকান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নাম বাধ্যতামূলক বাংলায় লেখার নির্দেশ।
আরও পড়ুন: সামনে কঠিন পথ, প্রশাসনের মানবিক মুখ জরুরি
তৃতীয়ত, বাঙালির সঙ্কটের আর একটা কারণ, ইদানীং সে সব বিষয়েই খিল্লিপ্রবণ। সেই প্রবণতা দোল উৎসবে রবীন্দ্রভারতী-কাণ্ডে বা করোনাভাইরাস ও গৃহান্তরিন অবস্থার মতো গুরুতর পরিস্থিতিতে ‘মিম-সংস্কৃতি’র ঠেলায় উৎকট মাত্রায় প্রকট। তার ঠেলায় টেনিদা, বাঁটুল, ভানু-জহরে মজে থাকা বাঙালির হিউমারের মুনশিয়ানা সঙ্কটের মুখে। এমনকি, বাঙালির নিজস্ব সম্পদ ‘চর্যাপদ’-এর সিদ্ধাচার্যদের নাম নিয়েও খিল্লি চলে। অথচ, পক্ষান্তরে তামিল জনজীবন, রাজনীতিতে আজও সমাদৃত তিরুবল্লুবরের লেখা তিরুক্কুরল। তেলুগু সাহিত্যেও বইটির অনুবাদ ভীষণ প্রাসঙ্গিক। এই চেতনা নিয়ে খিল্লি করা হয় না বলেই তেলুগু ও তামিলে তৈরি হয় ‘বাহুবলী’, যা শাসন করে ভারতের চলচ্চিত্র-অর্থনীতি। কোনও বাংলা ভাষার সিনেমার সাম্প্রতিক সময়ে এমন সাফল্যের নজির নেই।
এত নেতির কারণ হয়তো যুক্তিহীন ভাবে কোনও কিছুকে গ্রহণ করার অভিপ্রায়। অথচ, বাঙালি তো প্রবল যুক্তিবাদীও বটে। এ প্রসঙ্গে সেরা দৃষ্টান্ত বোধহয় বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিহাস। চান্দ্র-হিসাবে নিষ্পন্ন হিজরি বছরের সঙ্গে ঋতুর যোগ নেই। কিন্তু ভারতে খাজনা আদায়ের জন্য ঋতু বিশেষ জরুরি। আকবর রাজকার্যের জন্য গ্রহণ করেন পারস্যের সৌর-বর্ষপঞ্জি। নাম হল ‘তারিখ-ই-ইলাহি’। তৈরি হল ‘ইলাহি অব্দ’ বা ‘আকবর সাল’। এই বর্ষপঞ্জিতে মাসের দিন-সংখ্যা ঠিক হল ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’ অনুযায়ী। কিন্তু বঙ্গদেশে আগে থেকেই প্রচলিত ছিল সৌর বর্ষপঞ্জি। ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি কিন্তু ইলাহি অব্দ গ্রহণ করল না। নতুন সৌর অব্দ গ্রহণ করে নাম দিল ‘বঙ্গাব্দ’।
এই যুক্তিপূর্ণ গ্রহণের জন্যই বাঙালি শিল্পীর জাত। বনফুল লিখেছিলেন, “বাঙালী বারংবার বিপন্ন হইয়াছে কিন্তু তাহার আদর্শ উদ্বুদ্ধ শিল্পচেতনা তাহাকে বারংবার সঞ্জীবিত করিয়াছে।’’
সঞ্জীবনের প্রত্যাশা রেখেই স্বাগত ১৪২৭। সঙ্গে থাক ‘হালখাতার মিঠাই’। সে-মিষ্টিও অবশ্য বিস্মৃত!
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy