Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
Poila Baisakh Special

সব বিষয় সব রকম বাঙালিকে বাংলা ভাষায় বোঝানো চাই

বাংলা ভাষা, কাজের বাংলা ভাষা তার জায়গা সংকুচিত করছে। এ মোটেই ভাল কথা নয়। লিখছেন বিশ্বজিৎ রায়বাংলা ভাষা, কাজের বাংলা ভাষা তার জায়গা সংকুচিত করছে। এ মোটেই ভাল কথা নয়। লিখছেন বিশ্বজিৎ রায়

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহারের কথা বলেছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহারের কথা বলেছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৯ ২০:৫৮
Share: Save:

বাঙালি কে? যে বাংলা ভাষায় কথা বলে সেই বাঙালি। বিশ্বের যে কোনও দেশে সে থাকতে পারে। তবে তার সাজের কাজের ভাবনার ভালবাসার মধ্যে যেন বাংলার একটু ছোঁয়া থাকে। সে বাংলা ভাষা বাঁচে কেমন করে? ভাষা বাঁচে ব্যবহারে। ভাষা তো আর বাহারি ঠুনকো গয়না নয় যে তাকে আতু-পুতু করে তুলোর আরামে বন্দি করে রাখতে হবে! ভাষা হচ্ছে শ্রমিক মানুষের মতো। তার পায়ে লাগবে ধুলো, তার গায়ে বইবে ঘাম, সে ইচ্ছে হলে একলহমায় ভাড়া বেয়ে উঠবে সাতমহলায়,আবার নামবে টালির ঘরে। যেখানে খুশি যেতে পারে যে-ভাষা, যেখানে খুশি কাজে লাগতে পারে যে-ভাষা সে ভাষার তত বোল-বোলাও। এই যে ইংরেজি ভাষার আজকাল এতো রমরমা তার কারণ কী? কারণ, সে ভাষাকে যা-ইচ্ছে-তাই কাজে লাগানোর কলকব্জা দ্রুত তৈরি করে ফেলা হচ্ছে। আগে তাও রানির ইংরেজি বলে আভিজাত্যের বালাই ছিল। এখন ইংরেজি হরেক-রকম। সাহিত্যের অলংকৃত ইংরেজির দিন গিয়েছে, কাজের ইংরেজির পালে হু-হু করে হাওয়া লাগছে, নানা দেশে নানা-রকম ইংরেজির চল।সব মিলিয়ে ব্যবহারে ব্যবহারে ইংরেজি তার রাজ্যপাট বিস্তার করেই চলেছে।

ব্যবহারের খাল-বিল নদী-নালা দিয়ে ভাষার নৌকা বাইতে পারলেই যে বাঙালির পোয়াবারো এই সত্যটা উনিশ শতকের বাঙালি বেশ বুঝেছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘নূতন কথা গড়া’ নামে এক প্রবন্ধে সে-কথা ব্যাখ্যা-বিস্তার করেছিলেন। ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে আমরা তখন নতুন-নতুন বিষয়-আশয় ভাব-ভাবনার মুখোমুখি হচ্ছি। বাংলা ভাষায় তা প্রকাশের জন্য উপযুক্ত শব্দ চাই। শব্দ যদি থাকে তো ভাল, না থাকলে শব্দ গড়ে নিতে হবে, এ-ই শাস্ত্রী মশাইয়ের অভিমত। সংস্কৃত থেকে শব্দ নেওয়া যেতে পারে, দিশি শব্দকে কাজে লাগানো যেতে পারে অথবা যে দেশের ভাব সে দেশের শব্দ ধার করা চাই। মোদ্দাকথা হল, সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে নানা কাজে লাগানোর জন্য নিত্য মুখের ভাষাকে ও লেখার ভাষাকে গড়ে নিতে হবে। এই নানা কাজ বড় হতে পারে, আবার ছোটও হতে পারে। তাতে কিছু যায় আসে না। বড়-ছোট সমান গুরুত্বপূর্ণ।

রামমোহন রায় স্থির করলেন বাঙালির কুসংস্কার দূর করতে হবে। তারা উৎকট আমোদে মূর্তিপুজো করে, বিধবা মেয়েদের পুড়িয়ে মারে। তাদের এই অপকীর্তি দূরকরার জন্য সংস্কৃত একেশ্বরবাদী উপনিষদের কথা বাংলা গদ্যে প্রচার করা চাই। অথচ তখন বাংলা গদ্যের ভাণ্ডারে ঘর-দুয়ারের কাজকর্ম চালানোর জন্য অল্প কিছু শব্দ আছে। তা দিয়ে তো আর উপনিষদের ভাবপ্রচার চলে না। রামমোহন ভাষার নতুন চেহারা গড়ে নিলেন। অক্ষয়কুমার দত্ত খেয়াল করলেন, এদেশে সাহেবি প্রশাসন তাদের প্রয়োজনে যানবাহন-ব্যবস্থার খোলনলচে বদলাচ্ছেন। বাষ্পীয় শকট চালু হয়েছে। তাতে চাপতে গিয়ে বাঙালিদের অবস্থা নাজেহাল। এই সাধারণ বাংলা-জানা মানুষদের জন্য বাষ্পীয় শকট ব্যবহারের ম্যানুয়াল লিখলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমন কাজ। উপনিষদের জ্ঞান প্রকাশের জন্য যেমন উপযুক্ত বাংলা চাই তেমনই বাষ্পীয় শকটে চাপার বিধিনিষেধ জানার জন্য সহজ বাংলা ম্যানুয়াল লাগবে। যে ভাষা রাঁধে ও চুল বাঁধে সে ভাষাই তো বাঁচে। অক্ষয়কুমার দত্তের মতো জ্ঞানী মানুষের সহজ ম্যানুয়াল লিখতে জাত যায়নি।

বাঙালির কুসংস্কার দূর করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন রামমোহন রায়।

আরও পড়ুন: শাক থেকে শজারু, সবই কব্জি ডুবিয়ে খেত বাঙালি​

প্যারীচাঁদ মিত্রের কথাই ধরা যাক না কেন! ইয়াং বেঙ্গলের অন্যতম তিনি। মেয়েদের আর বালকদের জন্য সহজ কথ্য বাংলায় ‘মাসিক পত্রিকা’ সম্পাদনা করতেন । সে বাংলায় পণ্ডিতির কাঠিন্য ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র প্যারীচাঁদের বাংলা পড়ে খুব খুশি। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এই বাস্তববাদী গদ্য উপাখ্যানে সেকালের বাঙালি মজেছিল। প্যারীচাঁদ কৃষিবিজ্ঞানের বইও লিখেছিলেন। কীভাবে সেগুন গাছ লাগাতে হয় আমবাঙালিকে তা বুঝিয়েছিলেন।

এই যে সব কাণ্ডকারখানা তার উদ্দেশ্য একটাই। বাংলা ভাষাকে সব কাজে লাগানো চাই। গাড়িতে চাপতে বাংলা, গাছ লাগাতে বাংলা, গদ্য আখ্যানে বাংলা, উপনিষদের শাস্ত্রীয় জ্ঞান প্রচারেও বাংলা। একরকম নয়, নানারকম সে বাংলা। রবীন্দ্রনাথ এই বিষয়টির গুরুত্ব নানা ভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, নানা লেখায়। শুধু যে গল্প-কবিতা-উপন্যাসের রথে চাপলে বাংলা ভাষার প্রাণ থাকে না অপরাপর কাজের নানা গলিতে যাতায়াত করলেই যে তার পুষ্টি যথাযথ হয় এই বিশ্বাস থেকেই তো রবীন্দ্রনাথ দুটি গ্রন্থমালার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ আর লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা উল্টে-পাল্টে দেখলে মালুম হবে। সব বিষয় সব রকম বাঙালিকে বাংলা ভাষায় বোঝানো চাই।

এই যে বাংলা গদ্যভাষার মরা গাঙে বান এসেছিল এখন সেই বানের কী দশা? দশচক্রে ভগবান ভূত হয় আর অব্যবহারে ভাষার ধার কমে। খেয়াল করে দেখেছি, বাংলা ভাষা, কাজের বাংলা ভাষা তার জায়গা সংকুচিত করছে। এ মোটেই ভাল কথা নয়। আগে খ্যাতিমান বিশিষ্টরা নানা-কাজের বাংলা ভাষা গড়ায় মন দিতেন বলে আমজনতার ভাষার প্রতি সোহাগ শ্রদ্ধা ছিল। এখনকার গল্পকার, কবি, উপন্যাস লেখক কাজের বাংলা ইত্যাদির কথা ভাবতে চান না। তাঁরা বুঝতেই চান না, কাজের জগতে বাংলা সংকুচিত হলে সংস্কৃতির জগতেও বাংলা সংকুচিত হবে। কাজের বাংলা গড়ার জন্য এই সেদিন পর্যন্ত তো সুভাষ মুখোপাধ্যায় কলম পিষতেন। শঙ্খ ঘোষ কুন্তক ছদ্মনামে আনন্দমেলায় কিশোর-কিশোরীদের জন্য কলম ধরতেন। সেই সব দিন যে কোথায় গেল!

বাংলা ভাষাকে সব কাজে লাগানোর পক্ষপাতী ছিলেন রবীন্দ্রনাথও।

আরও পড়ুন: গড়ে তুলি বাঙালির ‘জাতীয়’ বা ‘ন্যাশনাল’ ইতিহাস ও সংস্কারের উদ্যোগ​

গেল বলেই কাজের বাংলার দশা, ব্যবহারিক বাংলার দশা ভাল নয়। প্রতিটি ভারতীয় ভাষারই নিজস্ব চালচলন আছে। একভাষায় যা চলে অন্য ভাষায় তা চলে না। বাংলা ভাষা কাজের জগতে নিজস্বতা হারিয়ে এখন কেমন যেন বিশেষ ধাঁচের হিন্দির দাসানুদাস। হিন্দি ভাষার অক্ষম অনুবাদে বাংলা ভাষা নিজস্বতা হারাচ্ছে। আমরা বাংলা ভাষায় চিরকাল ঘর-দুয়ার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখেছি। এখন পরিচ্ছন্ন বলতে আমরা বুঝি স্বচ্ছ-ভারত। ভারতের সঙ্গে আমাদের বিরোধ নেই, তবে প্রতিটি ভাষারই তো নিজস্বতা আছে। এই নিজস্বতাটুকু খোয়ালে সর্বনাশ। ভাষার নিজস্বতা হারালে সংস্কৃতির নিজস্বতাও হারায়। সেই কবে থেকে কৃত্তিবাসী রামায়ণে বাঙালির রাম সীতাবিনা মণিহারা ফণীর মতো কান্নাকাটি করেছে। যুদ্ধে বাঙালি রামের আপত্তি নেই তবে রামকে মারমুখী হিসেবে বাঙালি ভাবেনি। আজ কাজের ভাষা গিয়েছে বলে বাঙালির ভাবের ভাষাও গিয়েছে। মারমুখী রাম-হনুমানে হো-হো আওয়াজ!

তাই মনে হয় সব ভুলে বাঙালির উচিত তার ভাষাকে আবার আগের মতো নানা কাজে লাগানো। সেই নানা কাজের বাংলা যখন রমরম গমগম করবে তখন বাঙালির আত্মবিশ্বাস প্রবল হবে। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা বজায় রেখেই এই নানা ভাষা-সংস্কৃতির দেশে আগের মতো বাঙালি মান্যতা পাবে। ভয় কী? বাংলা তো মৃত্যুমুখী ভাষা নয়। এ ভাষা এখনও পৃথিবীর অন্যতম বড় ভাষা। বড়ত্বের অহমিকা ছেড়ে আমাদের উচিত নানা কাজে বাংলাকে লাগানো। সে কাজে বাংলা ভাষার সবশ্রেণির ভাবুকদের ও সাধারণ মানুষদের যোগ দিতে হবে। নতুন বাংলা বছরে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

(লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক)

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy