ভাই ভাই? ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং। এএফপি
চি ন ঘুরে এলাম। দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা মাত্র যখন চিনা সামগ্রী বর্জনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন চিন ভ্রমণ কেন? এ প্রশ্নের সম্মুখীন হলে আমিও কর্ণ জোহরের মতো বলতে পারি যে আমি যখন টিকিট কিনেছিলাম তখনও দুই দেশের সম্পর্ক এত তিক্ত ছিল না। অনায়াসে কথা দিতে পারি যে আর কোনও দিন যাব না, নিজের পয়সায় তো নয়ই। যাত্রার প্রাক্কালে মনে যে একটু দ্বিধা ছিল না তা নয়। ফিরে এসে যখন দেখলাম যে দেওয়ালিতে চিনা বাজির দাপট খুব একটা কমেনি তখন বুঝলাম কোনও ভুল করিনি।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাসেও খানিকটা খাদ থাকে। রাজ ঠাকরে ভেবেছিলেন যে, দেশের মানুষ দেশটাকে নতুন ভাবে ভালবাসতে শুরু করেছে। এক বার বললেই হবে, পাকিস্তানের অভিনেতা অভিনেত্রীদের তাঁরা নিজেরাই বয়কট করবেন। কিন্তু না। এটা ভারতবর্ষ। পাকিস্তান বয়কট কাজটি সহজ হল না। তাই তিনি বাধ্য হলেন সিনেমা হলে ভাঙচুর করার ভয় দেখাতে। আমাদের দেশের বিদ্বান দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উপর গবেষণাপত্র জমা দিতে যান কপালে দইয়ের ফোঁটা লাগিয়ে। বিজ্ঞানীরা ভগবানে বিশ্বাস করেন। আমরাও করি, কিন্তু সরস্বতী পুজোর চাঁদার পয়সায় সিগারেট খেতে সংকোচ করি না। তাই বয়কট করেও আমরা বয়কট করি না। এই নমনীয়তা আমাদের জাতীয় শক্তির একটা উৎস।
কিন্তু সমস্যা তো শুধু পাকিস্তান নয়, চিনও আছে তার পাশে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রে আবেদন করেছিল আজহার মাসুদকে আতঙ্কবাদীদের তালিকায় ফেলতে। চিন তা নাকচ করে দেয়। প্রত্যাশিত ভাবেই ভারত সরকার চিনের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলছে। একই সঙ্গে চিনের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চিনা আমদানি বয়কট করলে কেমন হয়? আর কথাটা যখন উঠেছে দেওয়ালির আগে, বাজি দিয়েই শুরু করা যায় বয়কট। চিনের অর্থনীতি রফতানি-নির্ভর। ওরা ভয় পাবে না?
পরিসংখ্যান দেখলে অবশ্য তা মনে হয় না। চিনের রফতানি বছরে দু’লক্ষ কোটি ডলার। তার মধ্যে ভারতে রফতানি মাত্র পাঁচ-ছয় হাজার কোটি, মানে মোট রফতানির আড়াই থেকে তিন শতাংশ। তার মধ্যে ইলেক্ট্রনিক্স বেশি। শুধু আতসবাজির মূল্য ধর্তব্যের মধ্যেই আসবে না। তাতে কী আসে যায়? পরিসংখ্যান তো সব নয়। আবেগেরও তো মূল্য আছে। প্রধানমন্ত্রীর আবেদনে এক কোটির বেশি মানুষ এলপিজির ভর্তুকি ছেড়ে দিয়েছেন। এ বার যদি চিনা বাজি বয়কট করি তা হলে সন্দেহ থাকবে না আমরা কার দিকে। তাতে চিনের ক্ষতি নাই-বা হল, রাজনৈতিক ভাবে আমরা লাভবান হব বইকী।
চিনের মাথাপিছু আয় আমাদের দ্বিগুণ, বৃদ্ধির হারও বেশি। দেখলাম এর নিদর্শন ছড়িয়ে আছে সর্বত্র, শহরেই নয় গ্রামেও। বেজিং-এর বিস্তীর্ণ এলাকা আর সাংহাই-এর গোটা শহরই দেখতে নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটন-এর মতো। প্রত্যেকটি বাড়ি সারা রাত আলোয় ঝলমল করে। প্যারিস চুক্তিতে সই করেছে দুই দেশই কিন্তু কেউই এই অপচয় বন্ধ করেনি। অবশ্য দূষণ এতটাই যে ঝলমল না করলে হয়তো দেখাই যাবে না। মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে কিছু গরিব ঘর। টুরিস্ট গাইডদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায় গরিব মানুষের সমস্যা ও দেশেও আছে। কারও ছেলের অসুখ, চিকিৎসার পয়সা নেই। কেউ চিন্তিত কারণ বয়স হচ্ছে, সঞ্চয় নেই বললেই হয়। কিছু জায়গায় আমাদের ‘পকেটমার হইতে সাবধান’ করে দেওয়া হল। ঠিক আমাদের মতোই ওরা সাম্যের পথে কিছু দিন চলে অন্য রাস্তা ধরেছে। মাও ৎসে তুং-এর একটা বড় ছবি এখনও টিকে আছে তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে।
সাংহাই শহরের জনসংখ্যা দু’কোটি চল্লিশ লাখ। অফিস টাইমে বেড়ে দাঁড়ায় তিন কোটিতে। ট্রেন চলে একচল্লিশটি রুটে, বাস রুটের সংখ্যা হাজারের বেশি। এই কর্মকাণ্ড চালু রাখা সহজ নয়। এই বিষয়ে আমরা ওদের কাছে অনেক কিছু শিখতে পারি। শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে ওদের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এই উদ্যোগ যে সব সময় সফল তা নয় কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি নেই। বেজিং-এর কিছু পুরনো বস্তিতে এখনও এক কামরায় একটি পরিবার থাকে। পাঁচ ছয়টি পরিবারের জন্য আছে কমন বাথরুম। সেই বস্তির ছোট গলিও তারা পরিচ্ছন্ন রাখতে পেরেছে।
মডার্ন চিনের কিছু জিনিস ভাল লাগল কিছু জিনিস লাগল না। পুরাতন চিনের প্রত্যেকটি নিদর্শন চমৎকার। বেজিং-এর কেন্দ্রে রয়েছে মিং সম্রাটদের প্রাসাদ, যাকে বলা হত নিষিদ্ধ নগরী— ফরবিড্ন সিটি। ১৪০০ সালে তৈরি এই প্রাসাদ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাজপ্রাসাদ। ঘরের সংখ্যা ৯৯৯৯। স্বর্গে আছে ১০০০০ ঘর, তাই এই প্রাসাদে একটা কম। এ ছাড়াও বেজিং-এ আছে ‘সামার প্যালেস’। বিপ্লবের পরেও মাও ৎসে তুং চিনের শেষ সম্রাটকে আজীবন থাকতে দিয়েছিলেন এই প্রাসাদে।
চিনের উত্তর সীমান্তে ‘গ্রেট ওয়াল’ তৈরি শুরু হয় ৭০০ খ্রিস্টপূর্বে। ২০০ খ্রিস্টপূর্বে চিনের প্রথম সম্রাট শাখাপ্রশাখাগুলিকে যুক্ত করেন। পরে মিং সম্রাটরা ৫৫০০ মাইল যোগ করেন। এই ভাবে হাত পাকিয়েছে বলেই ওরা থ্রি-গর্জেসের মতো জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করতে পারে। পুরনো রাজধানী শিয়ান-এ দেখা যায় অত্যাশ্চর্য ‘টেরাকোটা সোলজারস’। সবচেয়ে ভাল লাগল ওদের প্রাচীন প্রস্তরফলকের সংগ্রহ। এই ফলকে কনফিউশিয়াসের বাণী পুরোটাই পাওয়া যায়। হিউ-এন-সাং-এর সংগৃহীত ভারতীয় পুথি আর ভারত সফরের বিবরণ তাঁর ছাত্ররা খোদাই করে রেখেছিল পাথরে। সেই ফলকও সযত্নে রক্ষিত। আমাদের গৌতম বুদ্ধ ওখানে শাক্যমুনি। এই শাক্যমুনির মূর্তিও ভারত থেকে চিনে নিয়ে যান হিউ-এন-সাং।
তাই বলছি চিনের কোনটা নেব, কোনটা নেব না, তা নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন আছে। আজকের বাজারে এর বেশি কিছু বলা নিরাপদ মনে করি না। জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা বা ভারত-চিন মৈত্রী স্থাপন আমার কম্মো নয়। যদি কেউ চিন বয়কট করেন আমি আপত্তি করব না। তবে একটা অনুরোধ আছে। শুনেছিলাম চিন থেকে যাঁরা ভারতে আসেন তাঁরা চিলি
চিকেন বা চাউমিন দেখে চিনতে পারে না। ওঁদের দেশে গিয়ে বুঝলাম কথাটা সত্যি। অনেক খোঁজ করেও এই দুই খাবারের হদিশ পেলাম না কোথাও। এরা একান্তই আমাদের আপন। চিনের ছোঁয়া নামে মাত্র। তাই আর যা-ই করুন চাউমিন খাওয়া ছেড়ে দেবেন না।
ভূতপূর্ব মুখ্যসচিব, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy