বেশ বিরক্তই লাগছিল প্রথমটায়। চিনের সঙ্গে অশান্তি বাড়লে ভারতের ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘোর ঘনঘটা ঘোরতর হয়ে উঠবে, অতি বড় আহাম্মকও তা জানে। এটাও পরিষ্কার যে, ‘রক্তক্ষয়ী সংঘাত’-এর দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই দু’দেশের সামরিক কর্তারা অশান্তি মেটাতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন, এবং সেই আলোচনা অবশ্যই চলছে দুই সরকারের নায়কদের নির্দেশ অনুসারে। দৃশ্যত, তার প্রাথমিক সুফলও মিলছে। এর পরেও সংঘাতের মাত্রা ফের চড়তেই পারে, আগুন নিয়ে খেলার বিপদ থাকেই। কিন্তু দুই রাষ্ট্রের মন্ত্রী-সান্ত্রি-আমলা-কূটনীতিকরা সেটা বিলক্ষণ জানেন, আর তাই, নিজেদের স্বার্থেই, তেমন পরিণতি রোধ করতে তাঁরা তৎপর। ইতিমধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, টিকটক ইত্যাদি নিয়ে টক্কর চলছে, আপাতত চলবে। তার পুরোটাই পুকুরঘাটের ঝগড়া নয়— কূটনৈতিক দর-কষাকষিতে এ-সবের উপযোগিতা থাকে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর পারিষদরা সত্যিই চিনের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাতে চাইবেন, এতটা নির্বোধ তাঁরা নন। অথচ, ছা-পোষা লড়াই-খেপাদের আস্ফালনের অন্ত নেই! চতুর্দিকে ম-ম করছে জাতীয়তাবাদী হুঙ্কার, বয়কটের প্রাগৈতিহাসিক এবং আত্মঘাতী আস্ফালন, শি চিনফিং ও তাঁর দলের স্বৈরশাসনের নিন্দায় উদ্বেল-হয়ে-ওঠা পবিত্র ক্রোধ— যেন এত দিন বেজিংয়ের রাষ্ট্রচরিত্র অজানা ছিল, যেন মোদীর সঙ্গে ঝুলনদোলায় মধুর হাসাহাসির সময় শি চিনফিং গণতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা ছিলেন! এই কঠিন সময়ে এমন সব ধার্ষ্টামো দেখে বিরক্ত লাগাটা অস্বাভাবিক নয়।
যাঁরা এই জঙ্গিয়ানার আগুনে রাজনীতির তাওয়া গরম করতে চান, কিংবা সংবাদ-বিনোদনের বাজার ধরে মুনাফা বাড়াতে চান যাঁরা, তাঁদের হিসেব পরিষ্কার। কিন্তু এর বাইরেও আছেন বহু মানুষ, যাঁদের হুজুগপরায়ণ, অবিবেচক, জঙ্গিমনোভাবাপন্ন ইত্যাদি কোনওটাই বলা যাবে না। তাঁরাও অনেকেই কলকণ্ঠে চিনের সঙ্গে আড়ি করে দেওয়ার সওয়ালে যোগ দিয়েছেন এবং কী কী উপায়ে ‘ওদের’ মুখের মতো জবাব দেওয়া যায় তার জন্য অতিমাত্রায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কতকগুলো ফাঁকা কথা বলা এবং এটা-ওটা বয়কটের নামে নিজের নাক কেটে কিছু খুচরো ঝামেলা সৃষ্টি করা ছাড়া বিশেষ কোনও করণীয় নেই, এই সহজ সত্য জেনেও তাঁরা কিছু একটা করার জন্যে কেন এমন উদ্বেল হয়ে পড়লেন?
সে-কথা ভাবতে গিয়ে একটা খটকা লাগল। যাকে প্রশ্ন বলে মনে করেছি, সেটাই উত্তর নয় তো? কিছু করার নেই বলেই কি এই কিছু-একটা-করতে-হবে মার্কা আবেগ এত প্রবল? সত্যি বলতে কি, এ-আবেগের বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর প্রকাশ আমরা দেখেই আসছি। লকডাউনের প্রথম পর্বগুলো মনে করা যাক। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে থেকেই টিভিতে অবতীর্ণ হন, এবং কখনও বলেন বিকেলবেলায় বাজনা বাজাও, কখনও বলেন সন্ধেবেলায় ঘরের আলো নিবিয়ে ব্যালকনিতে আলো জ্বালাও, আর কোটি কোটি লোক সেই অনুজ্ঞা পালন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন— এত দিন পুরো ব্যাপারটা নিয়ে হেসেছি, ঠাট্টা করেছি, নিন্দেমন্দও। সেটা অন্যায় নয়, ব্যাপারগুলো সত্যিই উৎকট ছিল। কিন্তু ভাবতে গিয়ে এখন মনে হচ্ছে— অগণিত মানুষ এই সব অর্থহীন বিচিত্রানুষ্ঠানে সাগ্রহে যোগ দিয়েছেন, তার আসল কারণ সম্ভবত এটাই যে, তাঁদের সত্যিকারের কিছু করার নেই। আর তা নেই বলেই একই লগ্নে যে যার থালাবাটি বাজিয়ে কিংবা মোবাইল জ্বালিয়ে, সোশ্যাল মিডিয়ায় একই বয়কটের স্লোগানে গলা মিলিয়ে বা লাইক দিয়ে জাতীয় সংহতির বোধে তা দেওয়ার সুযোগ অনেকের কাছেই মহামূল্যবান। এই এত আলো, এত আওয়াজ, এত স্লোগান, এ-সবই এক ধরনের ধর্মীয় আচার। একে জনগণের আফিম বা নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস বলা ঠিক হবে না, বলতে পারি অক্ষমের আত্মরতি। সে-আবেগকে ব্যঙ্গ করে উড়িয়ে দিলে ওই অক্ষমতাকে চিনতে পারব না।
এই অক্ষমতা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। একটা সহজ কথা, বহুচর্চিত হলেও, মনে রাখা দরকার। গণতন্ত্রের গল্প, একটি প্রাথমিক অর্থে, প্রজা থেকে নাগরিক হয়ে ওঠার গল্প। আর সেখানেই এ-তন্ত্রের নিরন্তর টানাপড়েনও। নাগরিক তার চেতনায় ও উদ্যমে সক্রিয়, প্রজা নিষ্ক্রিয়। শাসক সক্রিয় নাগরিক চায় না, চায় নিষ্ক্রিয় প্রজা। সব শাসক অবশ্যই এক নয়, রাষ্ট্র এবং সমাজের চরিত্রে দেশভেদে এবং কালভেদে বিস্তর তফাত ঘটে, সেই পার্থক্যের পিছনে থাকে অর্থনীতির লীলা। কিন্তু টানাপড়েনটা আছেই। এবং, দুনিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সেই খেলায় শাসকের দাপট বেড়েই চলেছে। ভারত সে-অভিযানের প্রথম সারিতে। যে প্রজা নাগরিকত্বের দাবি জানাতে চাইবেন, রাষ্ট্রের কালো খাতায় তাঁর নাম উঠবে, দাবির মাত্রা চড়লে শাস্তির হুকুম জারি হবে— এই বার্তা দিকে দিকে রটে গিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অধিকাংশ নাগরিক স্বাভাবিক ভাবেই তেমন কোনও দাবি জানাতে চাইবেন না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাঁরা মনে মনে প্রজার ভূমিকাতেই সন্তুষ্ট। সেটা হয় না। মন বড় বালাই। মানুষ স্বভাবত স্বীকৃতি চায়, আত্মসম্মান চায়। প্রজার নিষ্ক্রিয়তা তাকে, চেতনায় বা অবচেতনে, পীড়া দেবেই। অথচ অধিকাংশ মানুষের জীবনে এর কোনও উপশম নেই। যথাঋতু নিজের ভোটটা নিজে দিতে পারলেই এখন নাগরিকের ‘এজেন্সি’ কৃতার্থ।
এ-পরিণতির দায় শুধু রাজনীতির নয়, এর উৎস নিহিত আছে অর্থনীতিতে। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি আজ দুনিয়া জুড়ে আধিপত্য বিস্তার করছে, তার কাছে ব্যক্তির দু’টি ভূমিকা: কর্মী এবং ক্রেতা। তিনি পরিশ্রম করে রোজগার করবেন এবং সেই টাকায় পণ্য ও পরিষেবা কিনবেন। এই দ্বিতীয় ভূমিকাটি আমাদের নাগরিক সত্তাকে অখিল ক্ষুধায় গ্রাস করে চলেছে, সক্রিয়তার কোনও অবকাশই থাকছে না আর। বিশেষ করে বলছি নাগরিক মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তের কথা, যাঁরা সমাজে গণ্য এবং মান্য— থালা বাজানো থেকে চিনকে একঘরে করার স্লোগান কীর্তনেও তাঁরাই সামনের সারিতে। একটু আঁচড় দিলেই ধরা পড়ে, তাঁদের প্রতিপত্তির একমাত্র উৎস তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তাঁরা রোজগার করছেন এবং/অথবা কিনছেন ও ভোগ করছেন। প্রয়োজনের সামগ্রী তো বটেই, তাঁদের বিনোদন, খেলাধুলো, বেড়ানো, এমনকি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উদ্যাপনও কাঞ্চনমূল্যে কিনে নেওয়া। এই অর্থনীতি নাগরিকত্বের গোড়া ধরে টান দিয়েছে। তার কাছে নাগরিক মানে আদ্যোপান্ত প্রজা— বাজারের নিষ্ক্রিয় প্রজা। সে কেবল ব্যক্তিকে নিষ্ক্রিয় করেনি, তাকে নিঃসঙ্গও করেছে, পৌঁছে দিয়েছে সেই থ্যাচারলোকে, যেখানে ‘সমাজ বলে কিছু নেই’, আছে কেবল বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির যোগফল। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং আমরা কবেই রপ্ত করেছি! বরণ করেছি বিচ্ছিন্ন ক্রেতা-উপভোক্তা-প্রজার ভূমিকা, প্রশিক্ষিত সারমেয় যে ভাবে নিজের গলার চেনটি নিজেই খুঁজে এনে দেয়।
কিন্তু ওই যে বলেছি, মন বড় বালাই। নিষ্ক্রিয় নিঃসঙ্গতার গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রজা মনে মনে নাগরিক হয়ে উঠতে চায়, একে অন্যের সঙ্গে সেতু বাঁধতে চায়। এমন কিছু করতে চায়, যাতে সে নিজেকে সমাজের পক্ষে মূল্যবান ভাবতে পারে, যে মূল্য বাজারের মহার্ঘতম সামগ্রীও তাকে দিতে অক্ষম। কিন্তু বহু মানুষই আপন অন্তরের সেই চাহিদা পূরণে অক্ষম, আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার কোনও পথই তাঁদের জানা নেই। তাই তাঁরা হাতে চাঁদ পেয়ে যান, যখন দেশের নায়কনায়িকারা তাঁদের একটা কাজ দেন, এমন কাজ যার কোনও পরিশ্রম নেই, কোনও দায় নেই। তখন তাঁরা প্রচণ্ড উৎসাহে হাততালি দেন, মোমবাতি কেনেন, ‘অ্যাই, চিনের মাল কে বেচছে, ওকে বয়কট করো’ বলে হাঁক পাড়েন। তাঁরা নির্বোধ নন, অবশ্যই জানেন এ-সবই অর্থহীন, নিষ্ফল, ফাঁকিবাজি। এবং জানেন যে, ফাঁকির দ্বারা মহৎ কর্ম হয় না। কিন্তু তাঁরা কোনও মহৎ কর্ম করতে চাইছেন না, তাঁরা কিছু একটা করতে চাইছেন, কেবল সবাইকে জানাতে চাইছেন যে ‘আমিও আছি’। সেই চাওয়াটুকু পাওয়া হলেই তাঁরা কৃতার্থ।
বিপজ্জনক নয়? প্রজা যদি রাষ্ট্রের দেওয়া পিটুলিগোলাতেই নাগরিকত্বের অমৃত আস্বাদন করে পরিতৃপ্ত থাকেন, তা হলে গণতন্ত্রের দাবি-টাবি নিয়ে শাসকের বারো আনা ঝকমারি এমনিই থাকে না। বাকি চার আনার জন্যে আইন আছে, উর্দি আছে, আরও কারা কারা সব আছে। মনে পড়ল, তুরস্কের নির্বাসিত লেখক সাংবাদিক সমাজকর্মী এচে তেমেলকুরান তাঁর হাউ টু লুজ় আ কান্ট্রি গ্রন্থে লিখেছেন, একাধিপত্যকামী রাষ্ট্রচালকরা দেশের মানুষকে ‘ইনফ্যান্টাইলাইজ়’ করতে চান, যাতে তারা শিশুর মতো সরল বিশ্বাসী হয়ে ওঠে, অলীক স্বপ্ন, ফাঁকা প্রতিশ্রুতি বা মিথ্যে বাগাড়ম্বরের রকমারি খেলনা দিয়ে তাদের ভুলিয়ে রাখা যায়, একটা খেলনা পুরনো হলে আর একখানা দিলেই চলে। আপাতত বাজারে চলছে— চিন হটাও, দেশ বাঁচাও।
শুনেছি, সে-কালে চিনারা কারও সর্বনাশ চাইলে নাকি মৃদু হেসে তাকে আশীর্বাদ করত: ‘মে ইউ লিভ ইন ইন্টরেস্টিং টাইমস।’ এই জনশ্রুতি অবশ্য সাহেবদের তৈরি, তারাই সম্ভবত সেটা চিনাদের নামে চালিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy