কেকার তখন সবে এক মাস। তাকে নিয়েই সে দিন ভাগীরথীতে ভাসল বনফুলের নৌকা।
‘তুই একটা বড় নৌকা ঠিক কর। আমারা বেড়া দেখতে যাব। সব্বাই যাব। ছই দেওয়া নৌকা ভাড়া করিস, তোর মেয়েকে ছইয়ের তলায় ঢাকাঢুকি দিয়ে রেখে দেব, ঠান্ডা লাগবে না’— মা বলেছেন এ কথা। বেরা দেখার ইচ্ছে নিজেরও অবশ্য ছিল। সুতরাং ভাড়া করা হল নৌকা। ক’দিন আগে জিয়াগঞ্জ হাসপাতালে জন্মেছে প্রথম সন্তান। কন্যা সন্তানটির নাম রাখা হয়েছে কেকা। কেকার তখন সবে এক মাস। তাকে নিয়েই সে দিন ভাগীরথীতে ভাসল বনফুলের নৌকা।
‘ভাসিতে ভাসিতে আমরাও মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। চার দিকে গান-বাজনা আনন্দ-কলরব শোনা যাইতেছে নানা নৌকা হইতে।’ কিন্তু আসল নৌকাটি কোথায়? যেটা কলার ভেলা দিয়ে বানানো হয় নবাব পরিবারের পক্ষ থেকে, যেখানে থাকে সোনার মোমবাতি, মিষ্টদ্রব্য, ফুল আরো কত কী! ভাদ্রমাসের শেষ বৃহস্পতিবার (এ বারে যে সময়টা মহরমের জন্য অনেকটাই এগিয়ে) কিংবদন্তির সন্ত খাজা খিজিরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই নৈবেদ্য দেখার জন্য ভাগীরথীর দুপাশে ভিড় সে দিন কম জমেনি। বনফুলদের মতো তারাও উদ্গ্রীব বেরা দেখার জন্য। অবশেষে দেখা গেল।
বনফুল লিখছেন-‘ক্রমে ক্রমে একটি বিরাট হর্ম্ম্য যেন নদীবক্ষে মূর্ত হইয়া উঠিল। তাহার অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে আলো জ্বলিতে লাগিল।’বনফুল মুগ্ধ। মুগ্ধ বাড়ির সকলে।
চিকিৎসক হিসাবে বনফুল চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জ হাসপাতালে। এসেছিলেন ১৯২৮ সালে। মাত্র এক বছরই ছিলেন এখানে। এই এক বছরে আত্মীয় বন্ধু যাঁরা এসেছেন, ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক নানান স্থান। বেরার কথাও শুনেছিলেন। কিন্তু দেখা সে দিনই। লোকের মুখে শুনে শুনে বেরার রাতে গঙ্গা বক্ষের একটা দৃশ্য বনফুল কল্পনাও করে নিয়েছিলেন মনে মনে। ‘কুলে কুলে ভরা শারদ জ্যোৎস্নায়…অনেক আলোকিত নৌকা ভাসিয়া চলিয়াছে, কোনটি হইতে হাসির হররা শোনা যাইতেছে, কোনটি হইতে বা গান। কোন বড় নৌকায় নাচও হইতেছে, নটীর নূপুরের শব্দও শোনা যাইতেছে মাঝে মাঝে। সারেঙ্গি এবং তবলচির বাজনাও।…সব নৌকাই ভাসিয়া চলিয়াছে মুর্শিদাবাদের ঘাটের দিকে।’ সে দিন কি তেমনই ছিল গঙ্গাবক্ষ? বনফুল জানাননি। শুধু জানিয়েছেন, নবাব বাড়ির সেই বিশেষ নৌকাটির কথাই। এই নৌকা দেখে তিনি রোমাঞ্চিত। নৌকার আলোগুলো একে একে যখন জ্বলে উঠল, তখন নানা রংযের আলো দেখে তাঁর মনে হল-‘ইহা যেন নৌকা নয়,একটা অপূর্ব আবির্ভাব।’ স্বপ্নের রূপকথালোক যেন মূর্ত হয়ে উঠল তাঁর চোখের সামনে।
রাত্রি ১২টা পর্যন্ত সেদিন সপরিবার ‘বেরা’ দেখে কোয়ার্টারে ফিরলেন বনফুল। আজিমগঞ্জের পটভূমিকায় বনফুল উত্তর কালে লিখেছিলেন ‘নির্মোক’ উপন্যাস। আক্ষেপ একটাই সে উপন্যাসে কিন্তু বেরা নেই। যেমন নেই এর অনেক কাল আগে মুর্শিদাবাদকে সরাসরি পটভূমি করে লেখা বঙ্কিমের ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে।
‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাস ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল ১২৮০-র শ্রাবণ সংখ্যা থেকে ১২৮১-র ভাদ্র সংখ্যা পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে প্রায় চোদ্দ মাস। এই সময় বঙ্কিম অবস্থান করছেন বহরমপুরেই। বঙ্কিমের অনেক লেখার সূতিকাগার মুর্শিদাবাদ ধরা হয়। কিন্তু ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসটা শুরুই হল মুর্শিদাবাদে। এই উপন্যাসের পাত্র-পাত্রী প্রতাপ, শৈবালিনী, চন্দ্রশেখর সকলেরই বাড়ি মুর্শিদাবাদের অনতিদূরে গঙ্গার কোলে বেদগ্রামে। খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায়, এই উপন্যাসের অনেক ঘটনাই এই গ্রাম বা গ্রাম পার্শ্বস্থ অঞ্চলে। গঙ্গাও এসেছে নানা ঘটনা পরম্পরায়। কিন্তু রুদ্ধশ্বাস সে সব ঘটনা বেরা আসা তো দূরস্থান আসার সুযোগটুকুও সৃষ্টি হয়নি।
আসলে ‘নির্মোক’ বা ‘চন্দ্রশেখর’ কোনওটাই আঞ্চলিক উপন্যাস নয়। কাজেই অঞ্চলের উৎসব পার্বণ উপন্যাসে আসবে এমন আশা করাও ঠিক নয়। কিন্তু ‘নির্মোক’ উপন্যাসের জনক বনফুল ওরফে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় যেমন বেরা দেখেছিলেন, তেমনি বহরমপুরে থাকাকালীন বেরার সংস্পর্শে এসেছিলেন বঙ্কিমও। শুধু তাই নয়, বেরায় এতকাল ধরে চলে আসা এক নবাবি প্রথার অবসানও ঘটিয়েছিলেন তিনি।
বঙ্কিমচন্দ্র বহরমপুরে বদলি হয়ে এসেছিলেন ১৮৭৯ সালের ২৯ নভেম্বর। পদ আগে যা ছিল তাই। অর্থাৎ, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর। পরে অবশ্য তাঁর পদোন্নতি হয়, অন্য দায়িত্বও দেওয়া হয়। তবে যে বেরায় তিনি এক মৌলিক পরিবর্তনের হত, সে সময়ে আসীন একই পদে।
সালটা ১৮৭০। বাংলা-বিহার-ওড়িশার নবাব তখন ফেরাদুন জাঁ ওরফে সৈয়দ মুনসুর আলি খান বাহাদুর। যদিও ১৮৭৯ সাল থেকেই তিনি লন্ডনবাসী, কিন্তু নবাব পরিবারের প্রথা মেনে পরের বছরও যথারীতি আয়োজন করা হয়েছে বেরা উৎসবের। প্রতিবারের মত এ বারেও আমন্ত্রণ জানানো হল জেলার সরকারি আমলাদের। বঙ্কিমকেও আমন্ত্রণ-পত্র দিতে এল নবাব পরিবারের কর্মচারী। বঙ্কিম কিন্তু আমন্ত্রণ-পত্র ফিরিয়ে দিলেন। কারণ, বঙ্কিম শুনেছিলেন আমন্ত্রিত অভ্যাগতদের মধ্যে শুধু সাহেবরাই নবাব প্রদত্ত জরিমালা দ্বারা উৎসব মঞ্চে বৃত হন। বঙ্কিম জানিয়ে দিলেন, যেখানে আপ্যায়নে বৈষম্য সেখানে তিনি নবাব পরিবারের বেরা উৎসবের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে অপারগ। ব্যাপারটা কিন্তু এখানে থেমে থাকল না। নবাব পরিবারের উঁচু মহলে রীতিমতো আলোচনা শুরু হল। এর পর তাঁদের তরফ থেকে বঙ্কিমকে আবার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলা হল, এখন থেকে এই ধরনের পক্ষপাত ও বৈষম্যমূলক আচরণ আর ঘটবে না। বেরা উৎসবে বঙ্কিমের প্রতিবাদ এ ভাবেই দেশীয় অভ্যাগতদের জন্য বহন করে নিয়ে এল সমানাধিকার এবং আত্মমর্যাদা।
শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল
তথ্য ঋণ: ‘পশ্চাৎপট (আত্মচরিত)’/ বনফুল ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ (জীবন ও সাহিত্য)/ গোপালচন্দ্র রায়
‘ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র এবং বহরমপুর’/ কেশব কুমার বাগচী (‘মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান’, ২০১২)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy