প্রতিরোধ: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণের প্রতিবাদে শহরের রাজপথে পদযাত্রা। কলকাতা, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯। পিটিআই
একেবারে শুরুতেই পরিষ্কার বলে নেওয়া দরকার, আইন মেনে সভ্যতা বজায় রেখে অবস্থান, বিক্ষোভ, কালো পতাকা বা ব্যাজ, প্রতিবাদী স্লোগান, পোস্টার— এ-সবই সম্পূর্ণ গণতন্ত্রসম্মত, অতি বড় মন্ত্রী-সান্ত্রির বিরুদ্ধেও দিব্বি চলতে পারে, তাতে সংবিধান কিছুমাত্র অশুদ্ধ হয় না, কিন্তু বৃহস্পতিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে নির্ধারিত সভায় যেতে শারীরিক ভাবে বাধা দেওয়া বা ‘ক্ষমা না চাইলে বেরোতে দেব না’ বলে আটকে রাখা একেবারেই উচিত কাজ হয়নি। মন্ত্রী না হয়ে অন্য যে কেউ এমন জবরদস্তির নিশানা হলেও সেটা একই রকম অনুচিত হত। প্রতিবাদ জানানোর কারণ এবং প্রয়োজন অবশ্যই ছিল, সে প্রতিবাদের বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি হয়তো আরও অনেক বেশি সুচিন্তিত এবং জোরদার হতে পারত, কিন্তু অত্যন্ত জরুরি ছিল— শত প্ররোচনা সত্ত্বেও— নিজেদের সংযত এবং দৃঢ় অবস্থানে অবিচল রাখা।
প্রসঙ্গত, অনেকেই ছাত্রছাত্রীদের আচরণকে ‘অল্প বয়সের স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে আবার বলেছেন, ‘ঠিকই করেছে, যারা যে ভাষা বোঝে।’ এই সাফাই ও সমর্থন যথার্থ হিতৈষীর কাজ নয় বলেই মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও তাঁদের সহযোগীরা প্ররোচনার ফাঁদে পা দিয়ে যে ভুল করেছেন, সেটা দুর্ভাগ্যজনক। তার ফলে সুযোগসন্ধানী প্রতিপক্ষ বেশ কিছুটা সুবিধে পেয়ে গেছে। তার চেয়েও বড় কথা, সমাজের অনেক মানুষও বিরক্ত এবং বিরূপ হয়েছেন। সেটা এই প্রতিবাদী তরুণতরুণীদের সমস্যা বাড়াবে। তাঁদের লড়াইটা অত্যন্ত কঠিন এবং বিপদসঙ্কুল বলেই এ ধরনের ভুল থেকে নিজেদের দূরে রাখা জরুরি।
কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের এই ভুলকে যাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বহুমুখী আক্রমণের সঙ্গে এক সারিতে বসিয়ে দেখাতে চাইছেন, তাঁরা হয় সম্পূর্ণ নির্বোধ, নয়তো জেগে ঘুমোচ্ছেন। যে অনুষ্ঠান উপলক্ষে মহামান্য মন্ত্রীর আগমন, সেটির ব্যবস্থাপনা, আলোচ্য বিষয় এবং দর্শকমণ্ডলীর স্বরূপ দেখার পরেও তার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে যদি কিছুমাত্র সংশয় থেকে থাকে, পরবর্তী ঘটনাবলিতে সেটা সম্পূর্ণ দূর হয়েছে। মন্ত্রিবরের আচরণ এবং মহামান্য রাজ্যপালের আবির্ভাব, দুইই সেই সংশয় বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছিল বটে, তবে সেই অবধি ব্যাপারটা সংশয়ের স্তরেই ছিল। কিন্তু তার পর, রাত বাড়তেই, নির্ভেজাল গুন্ডারা সংগঠিত শক্তিতে চড়াও হয়ে বীভৎস উল্লাসে তাদের ধ্বংসকাণ্ড সম্পন্ন করল এবং তাদের জ্বালিয়ে দেওয়া আগুনের আলোয় সব ধোঁয়াশা কেটে গেল। এহ বাহ্য। পরের দিন সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে রাজ্য বিজেপির সভাপতির সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা: পাকিস্তানে যে ভাবে সার্জিকাল স্ট্রাইক করা হয়েছিল, যাদবপুরে ঢুকে অ্যান্টিন্যাশনালদের ঘাঁটিও সে ভাবেই ধ্বংস করা হবে। ‘এ রকম তো উনি কতই বলেন’ গোছের তাচ্ছিল্যে সভাপতির ভাষণকে উড়িয়ে দিলে মস্ত ভুল হবে। সার্জিকাল স্ট্রাইকের উপমাটা নিশ্চয়ই অতিকথন, কিন্তু অতিকথনেই অনেক সময় মানসিকতার স্বরূপ সবচেয়ে ভাল ধরা পড়ে।
ঘটনাপরম্পরা বুঝিয়ে দিয়েছে, এ আসলে বক্তৃতাসভার ব্যাপারই নয়, নয় যথার্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাও, এখানে গণতন্ত্রের কোনও গল্প লেখা হচ্ছে না, এটা যুদ্ধ। যাঁরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, তাঁদের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের তুলনার কোনও মানেই হয় না। ঠিক যেমন ‘বহিরাগত তো দুই তরফেই ছিল’ বলে একটা সমীকরণ খাড়া করার চেষ্টাও যুগপৎ করুণ এবং হাস্যকর। শিল্পসংস্থার মতোই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আন্দোলনে বহিরাগতদের থাকা উচিত কি উচিত নয়, তা নিয়ে বিস্তর তর্ক চলতে পারে, কিন্তু ছাত্র সংগঠনের সদস্য বা সহযোগী হিসেবে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন আর যারা সেখানে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হানা দিয়ে ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়েছে, দু’পক্ষকে একাকার করে দিলে দুনিয়ার সব সমীকরণ সমস্বরে আর্তনাদ শুরু করবে।
প্রশ্ন হল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কেন এত বড় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত যে সেখানে হানা দিয়ে, ভাঙচুর করে, আগুন লাগিয়ে, ‘শক্তিপ্রদর্শন’ অভিযানের কর্মসূচি ঘোষণা করেও সন্তুষ্ট হওয়া যাবে না, একেবারে সার্জিকাল স্ট্রাইক করতে হবে? এটা সহজ প্রশ্ন। এই প্রতিষ্ঠানে স্বাধীন চিন্তার পরিসর এখনও জেগে আছে, এই প্রতিষ্ঠান এখনও ক্ষমতার মুখের ওপর প্রশ্ন ছুড়ে দিতে পারে, দেয়, তাই সে বিপজ্জনক, প্রতিস্পর্ধী, শত্রু। বস্তুত, এই কারণেই রাজ্যের শাসক গোষ্ঠীর নায়কনায়িকারাও যাদবপুরের প্রতি মোটেই অনুকূল মনোভাব পোষণ করেন না, সে কথা তাঁরা নানা উপলক্ষে বারংবার জোর গলায় ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও সমীকরণ চলে না— এখন যা ঘটছে তার চরিত্র সম্পূর্ণ অন্য মাত্রার। রাষ্ট্রক্ষমতা এখন সমস্ত প্রতিবাদ, সমালোচনা, এমনকি স্বাভাবিক প্রশ্নকেও স্তব্ধ করে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়েছে এবং দেশ জুড়ে প্রায় সবাই তাকে পথ ছেড়ে দিচ্ছে, প্রতিবাদের স্বরগুলি ক্রমে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। এই দিগ্বিজয়ের কালে যদি কোনও যাদবপুর বা জেএনইউ সেই ঘোড়াকে আটকাতে চায়, তা হলে যুদ্ধ তো বাধবেই। সেই চ্যালেঞ্জারদের দমন না করা অবধি এই রাষ্ট্রের শান্তি থাকতে পারে না, তাই এত বিদ্বেষ, এত হুমকি, এত আক্রমণ।
আর ঠিক সেই কারণেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। তারা যখন স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াই করে তখন সেটা কেবল তাদের নিজের লড়াই থাকে না, বৃহত্তর সমাজের স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়ে দাঁড়ায়। চিন্তার স্বাধীনতা, কথার স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা। চোখের সামনে দেশ জুড়ে সেই স্বাধীনতার পরিসর দ্রুত সঙ্কুচিত হয়ে আসছে, এবং তা নিয়ে আমাদের কোনও তাপ-উত্তাপ নেই, বরং সভয় সমর্থন আছে, আমাদের হাঁটু মুড়ে বসতে বললে আমরা হামাগুড়ি দিচ্ছি। মেনে নেওয়ার এই বিস্তীর্ণ দরিয়ায় যে দু’একটি তর্কশীল দ্বীপভূমি এখনও জেগে আছে, তাদের আত্মরক্ষা আজ আর কেবল তাদের আত্মরক্ষা নয়।
যে সমাজ ক্ষমতার বশ্যতা মেনে নিয়েছে, ক্ষমতাবানের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যকেই সুনাগরিকের ধর্ম বলে স্বীকার করেছে, ছাত্ররা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে চাইলে সে তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে না, বরং কথায় কথায় তাঁদের ‘বাড়াবাড়ি’র জন্য তিরস্কার করবে, তাঁদের ‘বিশৃঙ্খলা’র নিন্দায় মুখর হবে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এটাও স্বাভাবিক যে, এত ‘বিশৃঙ্খলা’ সত্ত্বেও এই বিশ্ববিদ্যালয় কী করে আজও বিভিন্ন বিষয়ের পঠনপাঠনে এবং গবেষণায় প্রথম সারিতে নিজের স্থান অক্ষুণ্ণ রেখেছে, সেই প্রশ্ন করলে এই অনুগত সমাজ শুনতে না পাওয়ার ভান করে অথবা গলা চড়িয়ে বলে, ‘তাই বলে ডিসিপ্লিন মানবে না, হ্যাঁ?’ বশ্যতার ভাষা এবং আনুগত্যের কণ্ঠস্বর এমনই হয়।
এই কারণেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের সমর্থনে কেবল সমাজমাধ্যমের পরিসরে নয়, তার বাইরেও যতটুকু সাড়া পাওয়া গেছে, রাজপথের মিছিলেও যত নাগরিক পা মিলিয়েছেন, কণ্ঠ মিলিয়েছেন, সেটাই সম্ভবত আমাদের শেষ ভরসা। ‘মানুষের জোট’ কথাটার যদি কোনও মানে থাকে, সেটা এই আন্তরিক, স্বতঃস্ফূর্ত জন-সংযোগের মধ্যেই আছে। কী ভাবে এই সংযোগকে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে গভীরতায় উত্তরোত্তর শক্তিশালী করে তোলা যায়, কী ভাবে তা থেকে যথার্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের শক্তি গড়ে তোলা যায়, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
সকলে মিলেই তার উত্তর সন্ধান করতে হবে। লড়াইটা এখন অস্বাভাবিক রকমের কঠিন। প্রতিপক্ষ শক্তিমান, নির্মম, এবং সবচেয়ে বড় কথা, তার কাছে গণতান্ত্রিক নৈতিকতার কোনও মূল্য নেই, বস্তুত, তাকে ‘ইমমরাল’ বা অনৈতিক বললে ভুল হবে, সে ‘অ্যামরাল’ অর্থাৎ নীতিনিরপেক্ষ। তাই বেসামাল হলেই অ-স্বাভাবিক প্রত্যাঘাত আসবে, যেমন এসেছে। বস্তুত, ওই প্রত্যাঘাতের ছক কষেই বেসামাল করে দেওয়ার প্ররোচনা চলতে থাকবে, কুৎসিত প্ররোচনা। তাতে রাগ হবে, রাগ হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক, কিন্তু সেই রাগের বশে বুদ্ধি হারালে চলবে না। মনে পড়ে গেল, গাঁধীজির পৌত্র অরুণ গাঁধীর দ্য গিফট অব অ্যাঙ্গার বইয়ে একই নামের একটি লেখা আছে। কিশোর বয়সে অরুণ সেবাগ্রামে গাঁধীজির জীবনের শেষ বছর দুয়েক তাঁর কাছে কাটিয়েছিলেন। পিতামহকে জানিয়েছিল সেই কিশোর, ‘আমার সব সময় খুব রাগ হয়।’ শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘রাগ ভাল। তা আমাদের চিনিয়ে দিতে সাহায্য করে— কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়।’ তার পর পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘তোমার রাগকে বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করবে।’
অতএব, আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ সেটা জেনেও, ওই উন্নতশির তরুণ সহনাগরিকদের প্রতি পদে সতর্ক থাকতে বলব, দরকার হলে বকব, কথা না শুনলে বার বার বকব, তর্ক করলে মহা উৎসাহে তর্কে যোগ দেব, এবং পাশে থাকব। এখন আমাদের একে অন্যের পাশে থাকা দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy