সব গরিবের ঘরে নাকি পৌঁছে গিয়েছে ‘আয়ুষ কার্ড’। ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পে গরিব মানুষের সুস্থ ভাবে বাঁচার চাবিকাঠি। কিন্তু ১০১ বছরের দেবকী দেবীর আয়ুষ কার্ড কোথায়? উত্তরাখণ্ডের চম্পাবত জেলার কোডা গ্রামের বাসিন্দা দেবকী দেবীর পরিবার আয়ুষ কার্ড পায়নি। তাই দু’চোখের ছানি পেকে এমন অবস্থা হয়েছে যে এখন আর দেখতেই পান না। বাড়ি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। কিন্তু সেখানে কখনও চোখের ডাক্তার এসেছেন বলে শোনেননি বৃদ্ধা। বাড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে লোহাঘাটে একটা বড় হাসপাতাল রয়েছে। সেখানেও চোখের ডাক্তার নেই।
নাতির হাত ধরে দেবকী দেবী তাই এসেছেন অদ্বৈত আশ্রমের হাসপাতালে। সেখানে কলকাতা থেকে ডাক্তারবাবুরা এসে চিকিৎসা শিবির করছেন। গত বছর ওই শিবিরেই চোখের ছানি ধরা পড়েছিল। একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছেছিলেন বলে দেবকী দেবীর চোখের অস্ত্রোপচার করা যায়নি। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে দু’টি চোখের ছানি অপারেশন না হলে কিছুই দেখতে পাবেন না বৃদ্ধা। হলও তাই। এক বছরে কোথাও ছানি কাটাতে না পেরে ফের ওই চিকিৎসা শিবিরেই এসেছেন তিনি। লাইনে বসে দুই হাত জোর করে স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে কুমায়নি ভাষায় বৃদ্ধার কাতর অনুনয়, ‘‘মরার আগে যেন সবাইকে এক বার দেখতে পাই। এই বৃদ্ধাকে একটু দয়া করুন।’’
দেবকী দেবীর দু’চোখেরই ছানি কেটে দিয়েছেন কলকাতার চিকিৎসকরা। পরের দিন কালো চশমা পরে বাড়ি যাওয়ার সময় সকলকে আশীর্বাদ করেছেন তিনি। নিমন্ত্রণ করে গিয়েছেন সবাইকে। নাতি গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এসেছিলেন ঠাকুমাকে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই দুই হাতে নাতির মুখটা উঁচু করে ধরে চুমু খেয়েছেন দেবকী দেবী। ধমকে উঠেছেন নাতি, ‘‘চোখের জল ফেলবে না একদম। চোখ কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।’’
৮০ বছরের ভবানী দেবীর সঙ্গে দেখা ওই লাইনেই। তিনি এসেছেন মায়াবতীর ওই হাসপাতাল থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম চারাপিতা থেকে। কলেজপড়ুয়া নাতি হরিশ সিংহ দু’হাজার টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এসেছেন ঠাকুমাকে। বাঁ চোখে গ্লকোমা। দেখতে পান না। ডান চোখে ছানি। দৃষ্টি নেই সেই চোখেও। সব পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু জানালেন, ডান চোখের ছানি অপারেশন হবে ভবানী দেবীর। এখনই। নাতির হাত ধরে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যান তিনি।
৬২ বছরের সরস্বতী দেবীর বাড়ি ২৫ কিলোমিটার দূরের শিরমোলি গ্রামে। নাতির পিঠে চেপে পাহাড়ি পথ ধরে চলে এসেছেন এতটা পথ। নাতি রঘুবীর বলছিলেন, ‘‘ঠাকুমা সারা রাত কাঁদত। বলত, আর বোধ হয় বাঁ চোখে দেখা হবে না। রোজ ডান চোখ চেপে দেখত, বাঁ চোখের দৃষ্টি কতটা কমেছে। এই কষ্ট আর দেখতে পারছিলাম না।’’
দেবকী দেবী, সরস্বতী দেবী, ভবানী দেবীরা আয়ুষ্মান ভারত, আয়ুষ কার্ডের নাম শোনেননি। তাঁদের নাতিরা শুনেছেন। কলেজ পড়ুয়া রঘুবীর বলেন, ‘‘আয়ুষ কার্ডের নাম তো শুনেছি। কিন্তু আমাদের তল্লাটের কাউকে তা হাতে পেতে শুনিনি।’’
ছয় দিনে প্রায় পাঁচশো রোগীর নাম, ঠিকানা, বয়স নথিভুক্ত করেছি ওই স্বাস্থ্য শিবিরের এক জন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। কিন্তু দু’জন ছাড়া কারও কাছে আয়ুষ কার্ড দেখিনি। যে দু’জন নিজেদের আয়ুষ দেখালেন, তাঁরা সরাসরি কেন্দ্রের শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত। এমনই এক জনের স্বীকারোক্তি, ‘‘যত লোকের পাওয়া উচিত ছিল, তত লোক আয়ুষ কার্ড পাননি।’’ পাশ থেকে আয়ুষ কার্ড থাকা সঙ্গী তরুণের মন্তব্য, ‘‘কার্ড থেকেই বা কী লাভ হচ্ছে আমাদের? সেই তো রোগী নিয়ে আসতে হচ্ছে ৫০ কিলোমিটার দূরের এই আশ্রমে। কবে কে শিবির করবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’’
চাষ বলতে গম, আলু, আদা, টম্যাটো। কোনও কোনও এলাকায় সরষে আর ধানও হয়। জলের অভাব প্রায় সারা বছর। তাই জমি থাকলেও চাষ হয় না। শিল্পটিল্প কিছু নেই। রোজ সকাল সন্ধ্যায় পাহাড়ি পথে যুবকদের দৌড়তে দেখা যায়। পকেটে একটা করে টর্চ। সন্ধ্যা হয়ে গেলে চিতাবাঘ, বুনো শুয়োর ভরা জঙ্গলের পথে কাজে লাগে। ফৌজে যোগ দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে তারা।
দুর্গম পাহাড়ি এলাকার এই মানুষগুলি জল পান না। চিকিৎসা পান না। ছেলেমেয়েদের পাহাড়ি পথে ১০-১২ কিলোমিটার দূরের স্কুলে যেতে হয়। অনেকেই মাঝপথে পড়া ছেড়ে দেয়। মায়াবতীর অদ্বৈত আশ্রম, কলকাতা বা দিল্লির কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আর ব্যারাকপুরের একটি চোখের হাসপাতালের উপরে ভরসা করে বেঁচে আছেন এই প্রান্তিক মানুষগুলি। ওই চোখের হাসপাতালের চিকিৎসকেরা এ বার ৫০০ জনের চিকিৎসা করেছেন। ২৫০ জনের চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছেন অস্ত্রোপচার করে। চিকিৎসক দলের নেতা ১০ বছর হল বছরে এক বার তাঁর দলবল নিয়ে আসেন এবং চোখের আলো ফিরিয়ে দেন সরস্বতী দেবীদের। তাঁর কথায়, ‘‘কাউকে না কাউকে তো ওঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমরাই না হয় সেই কাজটা করলাম।’’ কৃতিত্ব অবশ্য আশ্রমেরও। ‘‘ওঁরা প্রয়োজন বুঝেছেন বলেই আমাদের ডেকে এনেছেন।’’
ফোর্তির মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিশোরী বৈশালী। চিকিৎসকের দল পরের দিনই চলে যাবেন শুনে চোখ ছলছল করে ওঠে মেয়েটির, ‘‘শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম। ফিরতে দেরি হয়ে গেল। আমার বাবার চোখের দৃষ্টিটা এ বার আর তাই ফেরানো গেল না।’’ তরুণীর আর্জি, ‘‘সামনের বছর ফের আসবেন তো বাবুজি?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy