যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের বয়স তখন উনিশ। কলেজে পড়ার সময় থেকেই কাব্যের প্রতি তাঁর আবেগ তৈরি হয়। তার পর থেকেই কবিতার প্রতি যতীন্দ্রনাথের ভালবাসা জন্মায়।
কলেজের ট্রেনিংয়ের শেষে যতীন্দ্রনাথ নদিয়া জেলা বোর্ডের অধীনে কাজ করতে শুরু করলেন। কাজের ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন হলেও অত্যাধিক পরিশ্রম আর নদিয়ার জলহাওয়া তাঁর সহ্য হল না। বেশ কিছু দিন এই ভাবে কাজ চালানোর মাঝে জেলা বোর্ডের প্রশাসনিক জটিলতার কারণে যতীন্দ্রনাথকে কর্মক্ষেত্র থেকে ছয় মাসের অবৈতনিক ছুটি দেওয়া হয়। ছুটি পাওয়ার পর তিনি পৈতৃক বাড়ি হরিপুরে চলে আসেন এবং বুঝতে পারেন তাঁর পুরনো কর্মক্ষেত্রে ফেরা মুশকিল।
এ দিকে উপার্জন না করলে সংসার অথৈ জলে পড়ে যাবে। তাই তিনি একটি দেশলাই হাতকল কিনে নিয়ে এসে গ্রামের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে একটি দেশলাই কারখানা গড়ে তোলেন। আর তিনি নিজে চরকা চালান এবং শ্রমিকদের দিয়ে খদ্দর বোনান। এই ভাবে কষ্টকর ভাবে কয়েক বছর দিনপাত করার পর কাশিমবাজারের প্রাতঃস্মরণীয় মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্রের এস্টেটে ইঞ্জিনিয়ারের কাজ পান। তখন তাঁর বয়স ছত্রিশ। গ্রামের প্রতি টান থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়স্বজনদের আগ্রহে দেশলাই কারখানা ও খদ্দর বুনান ছেড়ে কাশিমবাজারের কাজে যোগ দিলেন।
নতুন চাকরিতে প্রবেশের বছরেই তিনি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মরীচিকা’ (১৯২৩) প্রকাশ করেন। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি তিনি লিখেছিলেন নদিয়া জেলার চাকরি করার সময়ে। গ্রন্থে ভাবজগতের ভাববিলাস থেকে মুক্ত হয়ে পেশাগত জীবনের ইট-কাঠ-পাথর নিয়ে কারবারযুক্ত কবি বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ ও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রেম-প্রকৃতি, ভগবান, রোমান্টিকতা আবেগ বর্জিত কঠিন বাস্তবের দৃষ্টি দিয়ে জগৎ ও জীবনের অন্তরালবর্তী জীবনকে ফুটিয়ে তুললেন।
১৯২৩ সালে কাশিমবাজারের কাজে ঢোকার পর থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কবিতা লিখে গিয়েছেন এবং একে একে প্রকাশ করেছেন ‘মরুশিখা’ (১৯২৭), ‘মরুমায়া’ (১৯৩০), ‘সায়ম’ (১৯৪৪), ‘ত্রিযামা’ (১৯৪৮), ‘নিশান্তিকা’ (১৯৫৭, মৃত্যুর পর প্রকাশিত), এবং কাব্যসংকলন ‘অনুপূর্বা’ (১৯৪৮)। কাব্যগ্রন্থগুলিতে এক অভিনব স্বাদ আনলেন যার নাম হলো দুঃখবাদ।
ডক্টর শশীভূষণ দাশগুপ্ত যতীন্দ্রনাথের ‘দুঃখবাদ’ সম্পর্কে বললেন— ‘‘কবি ছিলেন রুদ্রগোত্রীয় অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ যেখানে অর্মত্য অতীন্দ্রিয়তায় নিমগ্ন ছিলেন, সেখানে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন জীবনের রুদ্র রূপকে।’’ ‘কচিডাব’ কবিতায় সেই রুদ্র রূপেরই আভাস রয়েছে। ভিন্নধর্মী মানবতাবাদী, বাস্তবধর্মী এই চিন্তাভাবনার জন্যই তিনি উত্তর রবীন্দ্র কবিগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। সেই জনপ্রিয়তা ক্রমে কবিকূল থেকে সাধারণ কবিতাপ্রিয়, সাহিত্যপ্রেমী মানুষের মধ্যে প্রবাহিত হয়। এমনকি তাঁর কাব্যের কয়েকটি চিত্রকল্প, যথা—‘‘চেরাপুঞ্জি থেকে একখানি মেঘ ধার দিতে পার গোবি সাহারার বুকে’’ ‘‘প্রেম বলে কিছু নাই চেতনা আমার জড়ে মিশাইলে সব সমাধান পাই’’ লাইনগুলি প্রবাদ বাক্যে রূপে সমাজে প্রচলিত হয়েছিল।
যতীন্দ্রনাথের কাছে কবিতা ছিল একটি শিল্পকর্ম। তাই তিনি কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে কতটা অধ্যবসায় করতেন তার উল্লেখ পাই কবিবন্ধু বিমলচন্দ্র ঘোষকে লেখা একটি চিঠিতে। সেই চিঠিতে কবি লিখেছিলেন, ‘‘যথেষ্ট শক্তির অভাবে কবিতা লিখতে আমি যে পরিশ্রম করি তা বোধ হয় বিশ্বাস করা যায় না। প্রতি কথায় সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনা আনবার জন্য আমার অধ্যবসায়ের অন্ত নেই...একটি কবিতা লিখতে আমার ১সপ্তাহ থেকে ২ সপ্তাহ লাগে আর প্রতিদিন অন্তত ৪/৫ ঘণ্টা তাই নিয়ে থাকি। সমস্তক্ষণ নিম্নস্বরে ছত্রগুলি গান করে অদল বদল যোগ বিয়োগ করি।... শেষে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি তখন তাকে ছাড়ান দিই। তারপরও তাকে ছাপাখানায় দিই না; ৬ মাস ১ বছর ফেলে রাখি অধিকাংশ ক্ষেত্রে।’’
কবির দীর্ঘ সময়ে ধরে জীবনের নানা উত্থানপতনের যিনি সাক্ষী থেকেছেন, তিনি হলেন তাঁর সহধর্মিনী জ্যোতিলতা দেবী। হাজারিবাগের বিখ্যাত আইনজীবী চারুচন্দ্র গুপ্তের মধ্যম কন্যা ছিলেন জ্যোর্তিলতা। ১৯০৭ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর তাঁদের জীবন আবর্তিত ছিল সুনীলকান্তি, অরুণকান্তি, তরুণকান্তি নামে তিন ছেলে এবং শ্যামলী, নীলা, শুভ্রা আর শুক্লা নামে চার কন্যাকে নিয়ে। চাকরি জীবন শেষ করে কবি রোগজীর্ণ অবস্থায় সিন্দ্রিতে কিছু দিন থাকেন। সেখানে থাকার কিছু সময় পরে ১৯৫৪ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর খড়্গপুরের আইআইটির অধ্যাপক বড় ছেলে সুনীলকান্তির কাছে থাকাকালীন মারা যান।
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ছোট কন্যা শুক্লা দাসগুপ্তের মেয়ে সুদেষ্ণা দাসগুপ্ত তাঁর দাদুর স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘‘আমার জন্মের অনেক আগেই কবি ছেড়ে চলে গিয়েছেন সকলকে। মার মুখে কিছু কিছু গল্প শুনেছি। তবে ছোটবেলা থেকেই তাঁর নাতনি হওয়ার জন্য যথেষ্ট গর্ব বোধ করতাম। আমরা বাংলার বাইরে সিন্দ্রিতে বড় হয়েছি, বাবা সেখানে চাকরি করতেন। আমরা ছাড়াও সিন্দ্রিতে আমার বড়মাসি এবং দূর্গাপুরে বসবাসের আগে মেজমামাও থাকতেন। দাদু তাই সিন্দ্রিতে গিয়েছেন, থেকেছেন তাঁর ছেলের কাছে। গর্ব লাগত তখন, যখন ঝাড়খণ্ডের এক শহরে বাংলা সাহিত্যের মানুষজন স্বাভাবিক ভাবেই কম ছিলেন, সেই খানে স্কুলের পাঠ্যে ‘লোহার ব্যাথা’ ও ‘হাট’ কবিতাটি বন্ধুদের দেখিয়ে বলতাম— ‘এই যে কবিতাটি সেটি আমার নিজের দাদুর লেখা, আমার মায়ের বাবার’। এ যে কী অনুভূতি, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।’’
বর্তমান কালে আমরা অনেক কবিকে ভুলে যতে বসেছি, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত সেই ভুলে যাওয়া কবিদের মধ্যে এক জন। যিনি শান্তিপুরের অদূরে হরিপুর গ্রামে একদা তাঁর শৈশবের অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন। প্রারম্ভিক শিক্ষাঅর্জন করেছিলেন যে গ্রামে, এমনকি যৌবনেও যে গ্রামে কারখানা গড়ে নিজে এবং গ্রামের ছেলেমেয়েদের অর্থ রোজগারের দিশা দেখিয়েছিলেন, বর্তমান কালের নতুন প্রজন্ম সেই ভূমিপুত্র কবি সম্পর্কে উদাসীন, নির্লিপ্ত। অনেকে তাঁর নাম পর্যন্ত জানেন না। এটা শুধু লজ্জাকর নয়, অপমানজনক। এর সঙ্গে আমাদের মাথা নিচু হয়ে যায় যখন আমরা দেখি, হরিপুর গ্রামে তাঁর পৈতৃক ভিটে জরা জীর্ণ, ভগ্নদশায় জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে রয়েছে। তাঁর পৈতৃক ভিটেতে কবির নাম-সহ স্মৃতিচিহ্ন যুক্ত ফলক ছাড়া বাড়ির বাদবাকি সমস্ত কিছুই ধ্বংস হওয়ার অন্তিম প্রহর গুনছে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার কবি সারা জীবন ধরে নির্মাণকর্ম করে গিয়েছেন। শান্তিপুর হরিপুরের সেই ভূমিপুত্র কবির রুগ্ণ, ভগ্নপ্রায় জন্মভিটেকে সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে দেখে মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy