Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

দেশবিরোধীর কোনও ধর্ম হয় না

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বেশির ভাগ স্কুলেই তো সংস্কৃত অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে পড়ানো হয়। তা কি কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের প্রচার? 

মহম্মদ আবু সাইদ
শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৯ ২২:০৯
Share: Save:

মাদ্রাসা’ শব্দটি শুনলে এখন অনেকের সামনেই ভেসে ওঠে ‘সন্ত্রাসীদের আঁতুড়ঘর’, ‘শুধু আরবি আর কোরান শিক্ষা কেন্দ্র’। লাগাতার অপপ্রচার জনমানসে এই ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য খারিজি মাদ্রাসাকে সন্ত্রাসী তৈরির কেন্দ্র বলেছিলেন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংসদে বললেন, পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসাগুলোয় সন্ত্রাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিজেপি নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায় বললেন, পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসাগুলো জেএমবি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসাগুলোকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম, সরকার অনুমোদিত ও সাহায্যপ্রাপ্ত হাই মাদ্রাসা ও সিনিয়র মাদ্রাসা, যার সব কিছুই সরকার নিয়ন্ত্রিত। বর্তমানে হাই মাদ্রাসার সংখ্যা ৫১২ (হাই মাদ্রাসা ৪০০, জুনিয়র হাই মাদ্রাসা ১১২)। আর সিনিয়র মাদ্রাসা ১০২টি। অর্থাৎ মোট ৬১৪টি হাই ও সিনিয়র মাদ্রাসা রয়েছে। এগুলো ‘পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদ’-এর দ্বারা পরিচালিত ও পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা দফতরের অধীনে। স্কুলের মতোই, হাই মাদ্রাসাগুলো সর্বশিক্ষা মিশন ও শিক্ষা দফতরের অনুদানপ্রাপ্ত ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সাহায্য ও অনুদানপ্রাপ্ত। আর উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের মাদ্রাসাগুলো উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের মতোই, ডব্লিউবিসিএইচএসই পরিচালিত। প্রত্যেক বছর এই মাদ্রাসা বোর্ড থেকে প্রায় ৫০,০০০ পরীক্ষার্থী হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় বসেন, যার মান মাধ্যমিক পরীক্ষার সমতুল। হাই মাদ্রাসা পরীক্ষার সার্টিফিকেট মাধ্যমিকের সমান হিসেবে গ্রহণযোগ্য। মাধ্যমিক পরীক্ষা হয় ৭০০ নম্বরের, আর হাই মাদ্রাসা পরীক্ষা হয় ৮০০ নম্বরের। এখানে অতিরিক্ত হিসেবে ‘ইসলাম পরিচয়’ পড়ানো হয়। আর একটি বিষয় ‘অ্যারাবিক’, সেটি ‘কম্পালসারি অপশনাল’। এর নম্বর মূল নম্বরের সঙ্গে যোগ হয় না। আর হাই স্কুলের সঙ্গে সিনিয়র হাই মাদ্রাসার পার্থক্য হল, সিনিয়র মাদ্রাসার সিলেবাসে ধর্মীয় শিক্ষার ভাগ একটু বেশি। এখানে আলিম হল মাধ্যমিক, ফাজ়িল উচ্চ মাধ্যমিক। আলিমে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোলের সঙ্গে পড়ানো হয় হাদিশ ও তাফসির। ফাজ়িলে অতিরিক্ত হিসেবে পড়ানো হয় থিয়োলজি, ইসলামিক স্টাডিজ়, ইসলামিক হিস্ট্রি।

হাই মাদ্রাসায় অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে আরবি পড়ানো হয়, তাতে অনেকের আপত্তি। কিন্তু উর্দু বা আরবি ‘ইসলামের ভাষা’ নয়, ভাষা মাত্র। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বেশির ভাগ স্কুলেই তো সংস্কৃত অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে পড়ানো হয়। তা কি কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের প্রচার?

হাই মাদ্রাসায় অমুসলিম শিক্ষার্থী বাড়ছে। ২০১৯-এ হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় ১১.৯% অমুসলিম ছাত্রছাত্রী বসেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বহু মাদ্রাসায় ৪০ থেকে ৫০% অমুসলিম ছাত্রছাত্রী পড়ছেন। মাদ্রাসায় শিক্ষক ও কর্মীদেরও একটা বড় অংশ অমুসলিম। প্রথম দিকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমেই হাই মাদ্রাসাগুলোয় শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ হত। পরে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনে কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা কোনও সুযোগ-সুবিধা বা সংরক্ষণ থাকে না। যোগ্যতার নিরিখে যে-কেউ চাকরি পেতে পারেন।

দ্বিতীয় ধরনের মাদ্রাসাগুলি সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত, কিন্তু সরকারি অনুদান থেকে বঞ্চিত। এর সংখ্যা বর্তমানে ২৩৪। এ ছাড়াও অনুমোদনহীন অনেক শিশু মাদ্রাসা রয়েছে, যার সংখ্যা কয়েক হাজার। রাজ্য সরকার দশ হাজার মাদ্রাসাকে অনুমোদন দেবে বললেও, সবাইকে অনুমোদন দেওয়া যায়নি। শিশু মাদ্রাসায় প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানের পাশাপাশি অতিরিক্ত আরবি বিষয় পড়ানো হয়।

তৃতীয় ধরনের মাদ্রাসাকে নিজামিয়া বা খারিজি মাদ্রাসা বলে, যার অর্থ ‘বাহির’। এগুলির কোনও সরকারি অনুমোদন নেই, অনুদানও নেই। রাজ্যে আনুমানিক পাঁচ হাজার খারিজি মাদ্রাসা রয়েছে। অত্যন্ত গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরাই এই সব মাদ্রাসায় পড়ে। এখানে থাকা-খাওয়া বিনামূল্যে। এই মাদ্রাসাগুলি মুসলিম সমাজের মানুষের জাকাত, ফেতরা ও দানেই চলে। এখানে হাদিশ, কোরান, ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক। সমস্যা হল, এই সব মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষিকার মান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাল হয় না। এখানে পড়াশোনা করে হাফেজ়, ক্বারী, মৌলবি পদবি লাভ করা যায়। এঁদের কাজ মুসলিমদের মধ্যে হাদিশ ও কোরানের আলোকে ইসলামকে ব্যাখ্যা করা, ধর্মীয় ক্ষেত্রে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

মূলত এই মাদ্রাসাগুলো নিয়েই বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু যাঁরা অভিযোগ করেন, তাঁরা আজ পর্যন্ত চিহ্নিত করে দিতে পারেননি, কোন কোন মাদ্রাসা ‘সন্ত্রাসীদের আঁতুড়ঘর’। এনআইএ কয়েক বছর ধরে তদন্ত করেও তা চিহ্নিত করতে পারেনি। খাগড়াগড় কাণ্ডের সময়ও মাদ্রাসা সম্পর্কে কোনও ধারণা না-থাকা সংবাদমাধ্যম এবং এক শ্রেণির মানুষ আলটপকা মন্তব্য করতেন। বর্ধমানের শিমুলিয়া মাদ্রাসার নাম শোনা গিয়েছিল। সেখানে নাকি জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। কিন্তু সেখান থেকে কিছু মোবাইল, সিমকার্ড, আরবি শেখার প্রাথমিক বই ছাড়া বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি। তবু, কিছু অসঙ্গতি লক্ষ করে তাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংসদে বলে দিলেন, পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদ, বীরভূমের মাদ্রাসাগুলিকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য, জঙ্গি প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে তো তদন্তকারী সংস্থা রয়েছে। কোনও মাদ্রাসা বা ব্যক্তি যদি দেশবিরোধী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত থাকে, গ্রেফতার করে তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা হোক। কিন্তু দু’একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে, সমস্ত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা এবং তার সঙ্গে জড়িত সমস্ত পড়ুয়া, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, পরিচালন সমিতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া অত্যন্ত অন্যায়। সমাজবিরোধী, দেশবিরোধীর কোনও ধর্ম হয় না। এক জন দু’জন অপরাধীর কারণে একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত শিক্ষাব্যবস্থা এবং একটি গোটা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সন্দেহ-তালিকায় ফেলে, দেশের মানুষের কাছে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা আপত্তিকর।

মাদ্রাসায় না পড়েও কেউ সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতী হতে পারে। সংবিধানের ৩০নং ধারা অনুযায়ী মুসলিমদের ধর্মীয় শিক্ষার অধিকার রয়েছে। সরকার সেই অধিকার নিয়ন্ত্রণ করলেও, খর্ব করতে পারে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Anti Nationalism Religion Hindu Muslim
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy