মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী। ফাইল ছবি
রাজ্য বাজেটেও চাহিদা বাড়ানোর দিশা কই?
গত পয়লা ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সংসদে কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করার পর ১০ ফেব্রুয়ারি রাজ্য বিধানসভায় বাজেট পেশ করেন আমাদের রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার দাওয়াই দিতে নির্মলা ব্যর্থ হয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। সে দিন সেনসেক্স প্রায় হাজার পয়েন্ট পড়েছিল। তাই রাজ্য বাজেটে অর্থমন্ত্রী কী-কী সুবিধা ঘোষণা করেন সে দিকে নজর ছিল রাজ্যের আম জনতার।
তবে প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল, রাজ্য বাজেটে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ অর্থমন্ত্রীদের হাতে থাকে না। মূলত বাজেট আগামী আর্থিক বছরে রাজ্যের আয়-ব্যয়ের হিসেব। রাজ্যের আয়ের উৎস কর এবং কর বহির্ভূত আয়। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে প্রাপ্য কর বাবদ এবং অনুদান বাবদ অর্থ এবং রাজ্যের সরকারি উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত মুনাফা থেকে। আর অন্য দিকে, ব্যয় হয় সরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য, পরিবহণ, পুলিশ ইত্যাদি ক্ষেত্র এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত আনুষঙ্গিক খরচ খরচায়।
অমিত মিত্র এবার ২,৫৫,৬৭৭ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন। যেখানে গত বছর ছিল ২,৩৭,৯৬৪.৩৫ কোটি টাকার বাজেট। অর্থাৎ ৭.৪% এর মতো বৃদ্ধি করা হয়েছে। যদি এই সময়ে মূল্যবৃদ্ধির হারকে (প্রায় ৭% এর মতো) আমরা হিসাবের মধ্যে ধরি, তা হলে বলতে হয়, এই বছরে বাজেটের বরাদ্দ কিছুই বাড়ানো হয়নি। তিনি জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ৫০,৪৮৬ কোটি টাকা গত বছরের পাওনা বাকি রয়েছে। এ বছরও কেন্দ্রীয় বাজেটে যে কর কাঠামোর কথা বলা হয়েছে, তাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা কর কম আদায় হবে আর তার ভাগ হিসেবে এই রাজ্য আগামী বছরে আরও কম টাকা পাবে বলে দাবি উঠছে। গত বাজেটের মতো এ বারের বাজেটকেও ‘শূন্য ঘাটতি বাজেট’ বলা হচ্ছে। কিন্তু গত আর্থিক বছরের সংশোধিত হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ হয়েছে ৬,৭৭১ কোটি টাকা। তাই কেন্দ্রের কাছে কম টাকা পেলে এই আর্থিক বছরেও ঘাটতি শূন্য থাকবে সেটা জোর দিয়ে বলা যায় না।
২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে এটিই শেষ পূর্ণাঙ্গ রাজ্য বাজেট। তাই সমালোচকদের মতে, এই বাজেটের বেশ কিছু নীতি আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রণীত হয়েছে। যেমন তফশিলি জাতির ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষদের জন্য প্রতি মাসে ১,০০০ টাকা করে পেনশনের সুবিধা দেওয়ার জন্য ‘বন্ধু প্রকল্প’ এবং তার জন্য ২,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যার ফলে প্রায় ২১ লক্ষ বয়স্ক মানুষ উপকৃত হবেন বলে শাসকদল দাবি করছে। একই রকম ভাবে তফশিলি উপজাতির বয়স্ক মানুষদের জন্য নেওয়া ‘জয় জহর’ প্রকল্পে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে। এতে প্রায় চার লক্ষ মানুষের উপকার হবে বলে দাবি। অসংগঠিত শ্রমিক শ্রেণির জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প ছিল যেখানে এক জন শ্রমিককে প্রতি মাসে ২৫ টাকা দিতে হত এবং সরকার দিত ৩০ টাকা। আর ৬০ বছর বয়স হলে বা মারা গেলে তাঁরা বা তাঁদের পরিবার সুদ-সহ ‘ভবিষ্যনিধি’ থেকে টাকা পেতেন। কিন্তু এই বাজেট অনুযায়ী, ‘বিনা মূল্য সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে পুরো মাসিক টাকাটাই সরকার দেবে এবং তার জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।। ‘বাংলাশ্রী প্রকল্পে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে বেকারদের উৎসাহিত করার জন্য মাত্র একশো কোটি টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শাসক দলের আশা, এতে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে। তা ছাড়া, বেকারদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য ‘কর্মসাথী’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। শাসকদের দাবি, এখানে আগামী তিন বছরে এক লক্ষ বেকারদের সস্তায় ঋণের এবং ভর্তুকির ব্যবস্থা করা হবে। এই প্রকল্পের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন অর্থমন্ত্রী।
পাহাড়ের চা বাগানে স্থায়ী শ্রমিকদের বাসস্থানের জন্য ‘চা সুন্দরী’ প্রকল্পের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। গরিব মানুষ যাঁরা তিন মাসে মোট ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ভোগ করেন তাদের কোনও বিল দিতে হবে না। এই উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্পে দু’শো কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
কৃষিক্ষেত্রের এ বারের বরাদ্দ ৫,৮৬০.৫৭ কোটি টাকা। যেখানে গত বাজেটে ছিল ৬,০৮৬ কোটি টাকা। সেচ ব্যবস্থাতেও বরাদ্দ ৩,১৮৫ কোটি টাকা থেকে ২,৮২০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। প্রাণী সম্পদ উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ৫৬৫.৫০ কোটি বরাদ্দ করা হয়েছে। যদিও আগের বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১,১১৫ কোটি টাকা। মৎস্য বিভাগেও বরাদ্দ ৪৫২ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৩৪০ কোটি টাকা করা হয়েছে। জলসম্পদ, তদন্ত ও উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ১,৩০৭ কোটি থেকে কমিয়ে ৯২৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। সমবায় বিভাগে ৪২৪ কোটি থেকে কমিয়ে ২৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। বন বিভাগে আগে ছিল ৮,৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ। এখন তা হয়েছে ৪১৫ কোটি টাকা।
অর্থাৎ, কৃষি ও তার আনুষঙ্গিক অন্য বিভাগে এই বাজেটে বরাদ্দ হয় কমেছে, নয় খুব সামান্য বেড়েছে। যেমন পঞ্চায়েত এবং গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ২০,৪২২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০,৭৮৬ কোটি টাকা হয়েছে। এর ফলে, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার আশা দেখা যাচ্ছে না।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও এই বাজেটে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে ৯,৫৫৬ কোটি টাকা কমিয়ে মাত্র ৪,৬০৮ কোটি টাকা দেওয়া হবে; প্রায় ৫২ শতাংশ বরাদ্দ কমানো হয়েছে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে। জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগেও ৩,০২৯ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২,৭৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। স্কুলশিক্ষায় বরাদ্দ আগের বাজেটের তুলনায় ২৭,৫৪০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৮,৭৫০ কোটি টাকা করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষায় ৩,৯৬৪ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বৃত্তিমূলক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং স্কিল উন্নতির জন্য বরাদ্দ ১,১০৬ কোটি টাকা কমিয়ে ৯০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। এই তিনটি ক্ষেত্রের মোট বরাদ্দ তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে গত বাজেটে যেটা ছিল ৩২,৬১০ কোটি টাকা সেটা এই বাজেটে কমে ১০,৩৫০ কোটি টাকা করা হয়েছে; অর্থাৎ, প্রায় ৬৮ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ কমানো হয়েছে রাজ্যের শিক্ষা খাতে। সংখ্যালঘু এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগেও বরাদ্দ ৪,০১৬ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৩৬০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে এই বাজেটে। এক দিকে, কেন্দ্রীয় সরকার উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে একশো শতাংশ বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকে মান্যতা দিচ্ছে আর তার সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে রাজ্য বাজেটে কম টাকা বরাদ্দ করে রাজ্যের মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন অনেকে।
শিল্পের উন্নতির জন্য যেখানে পরিকাঠামোর প্রয়োজন সেখানেও দেখা যাচ্ছে বাজেটে টাকার বরাদ্দ কমানো হয়েছে। যেমন পরিবহণ সংস্থায় গত বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ ১,৬১৩ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে এই বাজেটে ৯৮৫ কোটি টাকা, পূর্ত বিভাগে বরাদ্দ ৫,৩৩৬ কোটি টাকা কমে ৪,৪০০ কোটি টাকা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগে ২,৪৭৪ কোটি টাকা থেকে কমে ১৮৫৫.৫০ কোটি টাকা, পুর ও নগরোন্নয়ন বিভাগে ১০,৯৩০ কোটি টাকা কমে ৮,৪৩০ কোটি টাকা হয়েছে। আবাসন বিভাগে বরাদ্দ ১,৩০০ কোটি টাকা কমে মাত্র ১৬৩ কোটি টাকা করা হয়েছে এই বাজেটে। তা ছাড়া, শ্রম বিভাগে বরাদ্দ ৯৫৯ কোটি টাকা থেকে কমে ৪২৫ কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে ১,০৩৩ কোটি টাকা থেকে ৮৮০ কোটি এবং শিল্প, বাণিজ্য, উদ্যোগ ইত্যাদি বিভাগে ১,৩০৪ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১১৫৮.৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে এই বাজেটে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী টাকার বরাদ্দ কমিয়েছেন। বেকারদের হাতে কাজ যোগানোর কোন সুস্পষ্ট চিন্তাধারা এই বাজেটে নেই বলে অভিযোগ উঠছে। স্কুলে, কলেজে, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির পরীক্ষার মাধ্যমে আগে রাজ্যে শিক্ষিত বেকারদের যে চাকরির সুযোগ ছিল, বর্তমানে তা অবলুপ্ত প্রায়। এই বাজেটে সেই শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের উল্লেখ নেই। প্রতি মাসের ইলেকট্রিক বিল প্রতি মাসে দেওয়ার দীর্ঘদিনের দাবিকে এই বাজেট মান্যতা দেয়নি।
বাজেটে ঘোষিত জনমুখী প্রকল্পগুলোতে সাধারণ ভোক্তার কিছু সুবিধা হবে সেটা অনস্বীকার্য। তবে সারা রাজ্যের বয়স্ক মানুষদের জন্য বার্ধক্য ভাতার পরিমাণ বাড়ানো, বা আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি ইত্যাদিতে কর্মরত মহিলাদের ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি কিন্তু বাজেটে করা হয়নি। তাই এই রাজ্য বাজেটেও জনসাধারণের হাতে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধির কোনও উপায় করা হয়নি, যার ফলস্বরূপ বাজারে চাহিদা বাড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, আর অর্থনীতিও চাঙ্গা হবে, তেমন আশা কম।
কাজী নজরুল মহাবিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy