কয়েক মাস আগে ‘মাদ্রাসার শিক্ষক’ পরিচয়ের কারণে সল্টলেকের গেস্ট হাউসে মালদহ থেকে আসা কিছু শিক্ষককে হেনস্থা হতে হয়। তাঁদের অন্যান্য পরিচয়, ‘পশ্চিমবঙ্গবাসী’, ‘বাংলাভাষী’, ‘সরকারি চাকরিজীবী’ ও ‘মুসলমান’। অথচ দাড়ি-টুপির কারণে অন্য সব পরিচয় চাপা পড়ে ‘মুসলমান’ পরিচয়টিই কর্তৃপক্ষের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা স্থানীয় বাসিন্দাদের আপত্তিকে দায়ী করেছেন। কয়েক দশক ধরে বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ার প্রকাশ দেখছি আমরা। নিশ্চয় মনে পড়বে যে, ২০১৪ সাল থেকে ভারতেও মুসলমানদের পোশাক ও খাদ্যাভ্যাসকে কেন্দ্র করে নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটে চলেছে।
মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে কিছু কাল ধরেই একটা অহেতুক সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। ‘মাদ্রাসা মানেই সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর’, এই ধারণা কেবল উগ্র দক্ষিণপন্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অভিজ্ঞতা বলছে, কোনও সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটলে, প্রমাণ ছাড়াই তাকে মাদ্রাসার কার্যকলাপের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায় এ রাজ্যেও।
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান অনুসারে ৮,৫০০-এরও বেশি আরবি বা ফারসি উর্দু শব্দ বাংলায় মিশে আছে। অথচ একটা নিরীহ শব্দ ‘মাদ্রাসা’কে নিয়ে এত আতঙ্ক কেন? কথাটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হিব্রু শব্দ ‘মিদারস’ থেকে যার উৎপত্তি। বাংলায় মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার গৌরবময় ইতিহাস আছে। ইংরেজ শাসনের প্রথম দিকে ফারসি সরকারি ভাষা হওয়ার কারণে বহু অ-মুসলমানও তা শিখতে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতেন। হুগলি জেলার সীতাপুরে ১৭৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা অবিভক্ত ভারতের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাসায় ‘আলিয়া’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ দেশে মুসলমানদের জন্য আধুনিক শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাবিদ্যা, শল্যচিকিৎসাবিদ্যারও হাতে-কলমে পাঠ শুরু হয়।
ইংরেজ শাসনকালেই অবশ্য মাদ্রাসাকে কেবল ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে দেখা শুরু হয়। ক্রমে ধারণা তৈরি হয় যে, মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় উৎসাহ কম, বেশির ভাগই মাদ্রাসায় পড়ে। সাচার কমিটি রিপোর্টে এই ধারণার অসারতা ধরাও পড়ে। দেশের মাত্র ছয় শতাংশ মুসলমান ছাত্র মাদ্রাসায় পড়ে। এমন ধারণাও আছে যে, মাদ্রাসায় শুধু ছেলেরা পড়ে। পরিসংখ্যান অনুসারে, মাদ্রাসার মোট শিক্ষার্থীর ৬২ শতাংশই ছাত্রী, সাফল্যও নজরকাড়া।
মাদ্রাসার সিলেবাসের আধুনিকীকরণের ফলে, আরবি ও ইসলামি ইতিহাস ছাড়াও অন্যান্য বোর্ডের মতো আধুনিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয় পড়তে হয়। তাই মাদ্রাসায় অ-মুসলমানদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো, মোট শিক্ষার্থীর প্রায় নয় শতাংশ। মাদ্রাসা শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিচালন কমিটির সদস্যদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ অ-মুসলমান। মাদ্রাসা বোর্ডের হিসেব, গত বছর ৭০,০০০-এরও বেশি অ-মুসলমান ছাত্রছাত্রী বোর্ড পরীক্ষায় বসেছিল, যা মোট পরীক্ষার্থীর ১৮ শতাংশ। মাদ্রাসার অ-মুসলমান ছাত্রছাত্রীরা গত কয়েক বছর ধরে বোর্ডের পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছে।
রাজ্যে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সবচেয়ে বড় ভিত্তিহীন ধারণা হল যে, সেখানে শুধু ইসলামি শিক্ষা দেওয়া হয় এবং পাঠদানের মাধ্যম আরবি ও উর্দু। রাজ্যে ৬০৯টি মাদ্রাসার মধ্যে ৯২ শতাংশ গ্রামীণ ক্ষেত্রে, যেখানে আরবি কেবল ভাষা হিসেবে পড়ানো হয়, বহু ক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যমেই। মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে বৃহত্তর জনসমাজে ধারণার এই অভাবের সঙ্গে ইসলামোফোবিয়া-র অমোঘ মিশেলের ফল মারাত্মক— মাদ্রাসা থেকে পাওয়া ‘আরবি শেখার সহজ পাঠ’ জাতীয় নিরীহ বইকেও জেহাদি পত্রিকা বলে প্রচার করা চলে।
বিশ্বের কোথাও সন্ত্রাসবাদ ও মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক আছে বলে জানা যায় না। বরং, পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো পেশায় সফল হয়েছেন অনেকে। পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা বোর্ড থেকে পাশ করে গত বছর বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন ৪১ জন।
আরবি, ফারসি, উর্দু থেকে হাজার হাজার শব্দ আমরা বাংলায় আপন করে নিয়েছি। যখন কোনও গোষ্ঠী এই বিপুল শব্দভান্ডার বাতিলের দাবি করে, তখন তারা ভুলে যায় যে, ‘বাতিল’ শব্দটার উৎসও আরবি। মাদ্রাসা নিয়ে এই অজ্ঞতা রাজনৈতিক মেরুকরণের রসদ, যা হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বাস করা মুসলমান সম্প্রদায় সম্পর্কে অন্ধত্বের জন্ম দেয়। মাদ্রাসা শিক্ষকদের কেন্দ্র করে এই রাজ্যে ইসলামোফোবিয়ার বীজ নতুন করে বপন করা হলে বিভেদকামী রাজনীতির দাপটে এমন ঘটনা আরও বাড়বে। অথচ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যত জোরালো প্রতিবাদের প্রয়োজন ছিল, তা চোখে পড়েনি। শিক্ষক সংগঠনগুলিও কিছু বলেনি।
বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নীরবতাও কিন্তু রাজ্যের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির উপর ধাক্কা।
প্রতীচী ইনস্টিটিউট, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy