২০১৭ সালে বর্ধমান জেলাকে ভেঙে পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান জেলা গঠন করা হয়। একটা সময় বর্ধমানের পূর্ব অংশ যাকে আজ আমরা পূর্ব বর্ধমান জেলা নামে চিনি তাকে বলা হত ‘বাংলার শস্যভাণ্ডার।’ পরিসংখ্যান বলছে, এই জেলার গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলির অধিকাংশই কৃষিকাজের উপরে নির্ভরশীল। পশ্চিম বর্ধমানের বেশিরভাগ মানুষ শিল্পোৎপাদন, কয়লা উত্তোলন, পাথর খাদানের মতো নানা ক্ষেত্রের সঙ্গে সংযুক্ত। এই দুই জেলার কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ মানুষ আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণিভুক্ত। ফলে, দেশের বাজেটে শিল্প এবং কৃষি— এই দুইয়ের প্রতি সমদর্শিতার নীতিই পারে এই দুই জেলার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে। এ বার পূর্ব বর্ধমানকে সূচক হিসেবে ব্যবহার করে দেখে নেওয়া যাক দেখে নেওয়া যাক, কৃষি ক্ষেত্রে কী পাওয়া গেল এ বারের বাজেটে?
বাজেট পেশ হওয়ার আগে থেকেই বহু অর্থনীতিবিদ বলছিলেন, যদি গ্রামের প্রান্তিক মানুষজনকে আর্থিক ভাবে উন্নতির দিশা দেখানো না যায়, তা হলে বিপুল সরকারি আয়োজন ব্যর্থ হবে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই প্রান্তিক চাষি, ভাগচাষি, মৎস্যজীবী, তাঁতশিল্পী। উৎপাদিত পণ্যের সঠিক দাম পাওয়াই তাঁদের আর্থিক উন্নতিকে সুনিশ্চিত করতে পারে। বাস্তব বলছে গত কয়েক বছরে, ধারাবাহিক ভাবে তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের ঠিকঠাক দাম না পাওয়ার কারণে দেশে সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। দেশের প্রকৃত ‘জিডিপি’ (গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট) তখনই বাড়ে, যখন আমজনতার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। যখন দরিদ্র মানুষের মানুষের হাতে পয়সা থাকে।
কিন্তু চলতি বাজেটে, কৃষিঋণ-সহ একাধিক বিষয়ে বলা হলেও, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কী ভাবে বৃদ্ধি পাবে তা নিয়ে স্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। নেই গ্রামীণ কর্মসংস্থান সম্পর্কে কোনও সুস্পষ্ট কথাও। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, ব্যবসামুখী বাজার অর্থনীতি দেশে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করবে। পক্ষান্তরে, অন্যদের দাবি, ‘মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান’-এর মতো সামাজিক প্রকল্পে অর্থের বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ায় গ্রামীণ কর্মসংস্থানে সঙ্কট দেখা দিতে পারে। সে কারণে অর্থনীতিবিদদের একাংশের অভিমত, যে হেতু গ্রামীণ অর্থনীতির মূলকেন্দ্রে থাকা প্রান্তিক চাষি, বা ভাগচাষিরা যাতে বাজারে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য কী ভাবে পাবেন তার সম্পর্কে সে ভাবে কোনও রূপরেখা করা হয়নি, সেই কারণে চিরপরিচিত ছবিতে খুব একটা পরিবর্তন আসা সম্ভব নয়। বহু ক্ষেত্রেই আগের মতো দাদন নিয়ে চাষিদের ফসল ফলানো, আর ধনী শ্রেণির তাদের কাছ থেকে কম দামে ফসল কিনে নেওয়ার ছবিতে খুব একটা পরিবর্তন আসবে না বলে মনে করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এ ভাবে ‘জিডিপি’-র বৃদ্ধি সম্ভব নয়। গত বাজেটে ‘জিডিপি’-র লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাত শতাংশ। সে জায়গায় অর্জন করা গিয়েছে পাঁচ শতাংশ। সারা বছরে সেই লক্ষ্যমাত্রাকে এক বারও স্পর্শ করা যায়নি। ফলে, চলতি বাজেটে গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য বাজেটে যে নীতিগুলি নেওয়া হয়েছে, তাতে গ্রামাঞ্চলের মানুষদের খুব একটা সুবিধা হবে বলে মনে করা হচ্ছে না। এ বার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬.৬৫ শতাংশ। কিন্তু কী ভাবে তা স্পর্শ করা যাবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। অন্য দিকে অর্থনীতিবিদদের দাবি, একশো দিনের কাজে বরাদ্দ কমিয়ে স্বাস্থ্যে ‘সেস’ চাপানোয় সঙ্কট গভীর হবে।
গোটা রাজ্যের ‘শস্যভাণ্ডার’ বর্ধমান জেলায় দেখা গেল, বিঘা প্রতি পঁচিশ হাজার টাকা খরচ করে, সর্বোচ্চ একশো বস্তা আলু উৎপাদন করে, সেই আলু বস্তা প্রতি দুশো থেকে আড়াইশো টাকায় বিক্রি করতে কৃষকেরা বাধ্য হয়েছিলেন। এখন আলুর দাম বস্তাপ্রতি সাতশো টাকা। মুনাফা হয়েছে বড় ব্যবসায়ীদের। যদি এই বৈষম্য দূর করার জন্য বাজেটে কোনও নীতি নেওয়া হত, তা হলে সাধারণ মানুষের সুবিধা হত। একটা সময় বর্ধমান জেলায় বাৎসরিক পর্যায়ক্রম ছিল আলু-পাট-ধান। আলু ও ধানের মধ্যবর্তী ফসল হিসেবে পাটই ছিল পরিচিত। কিন্তু বর্তমানে ‘সিন্থেটিক’ দ্রব্য বাজারে আসার পরে, পাটের ব্যবহার অনেকটা কমেছে। অথচ, বর্তমানে যখন গোটা দেশ জুড়ে প্লাস্টিক বর্জন আর পরিবেশবান্ধব সামগ্রী ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তখন কেন বাজেটে নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে পাটজাত সামগ্রীর ব্যবহারে উৎসাহিত করতে কোনও স্পষ্ট নীতি নেওয়া হল না সে প্রশ্নও উঠছে।
লাভ না থাকার কারণে বিকল্প হিসেবে তিল চাষের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল জেলায়। সাধারণত জুন মাসে বর্ষা আসে। তার আগেই তিল কৃষকদের ঘরে উঠে যায়। কিন্তু নিম্নচাপ, ‘ফণী’র মতো ঘূর্ণিঝড় বা কালবৈশাখীর কারণে তিল গাছ ফুল-ফল-সহ জমিতে শুয়ে পড়ে। এতে তিল চাষিদের ফলন ও লাভ— দুইই মার খায়। তেমন ভাবেই পূর্বস্থলী ও মন্তেশ্বর ব্লকে বিকল্প হিসেবে কলা ও পেঁপে চাষ করা হয়েছিল। কিন্তু কালবৈশাখীর বৃষ্টিতে গাছ ভেঙে পড়ায় সে ফলনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত কয়েক বছরে পূর্বস্থলী ১ ও ২ ব্লকে আম ও পেয়ারার চাষ কৃষকদের কাছে আর্থিক ভাবে লাভদায়ক হয়ে উঠেছিল। এখানেও মাঝেমধ্যে ঝড় বৃষ্টিতে আম ও পেয়ারার ক্ষতি হয়। কচি ফল গাছ থেকে পড়ে যায়। কিন্তু চলতি বাজেটে খরিফ ও রবিশস্যের মধ্যবর্তী ফসল হিসেবে বাগিচা ফসলকে রক্ষা বা তার চাষে উৎসাহ প্রদানের জন্যও সুনির্দিষ্ট কোনও নীতি চোখে পড়ল না।
আগে কৃষকদের মধ্যে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি, গরু পোষার রেওয়াজ ছিল। গরুর দুধ বিক্রি করে দু’চার পয়সা আয় করতেন কৃষক। তারই সঙ্গে বাজারে খড়ের একটা চাহিদাও ছিল। সে কারণে ধানের পাশপাশি খড়, ধানের তুষ ইত্যাদিও বিক্রি করেও কৃষকের লাভ হত। কিন্তু এখন দেশের বেশিরভাগ জমিতেই ট্রাক্টর-সহ অন্য যন্ত্র দিয়ে চাষ করা হচ্ছে। ফলে, কৃষিকাজে গরুর ব্যবহার কমেছে। তারই সঙ্গে কমেছে দুগ্ধজাত সামগ্রী বিক্রি করে কৃষকের বাড়তি আয়ও। খড়ের বিক্রি বন্ধ হওয়ায় কৃষক বাধ্য হয়ে জমিতে পুড়িয়ে দিচ্ছেন ফসলের অবশিষ্টাংশ। ‘নাড়া’ পোড়ানোর দূষণ থেকে বাড়ছে পরিবেশের ক্ষতি। এই দিক থেকে একটি উল্লেখযোগ্য সঙ্কট মোচন করতে পারত এ বারের বাজেট। কৃষকের কাছ থেকে খড় কিনে নিয়ে যদি সরকারের তরফে সেগুলি কাগজ তৈরির মতো কাজে ব্যবহার করা যেত তা হলে এক দিকে, যেমন কাগজ শিল্পের কাঁচা মালের জন্য বনভূমির অবক্ষয় কমত, তেমনই কমত পরিবেশ দূষণের সমস্যা। কৃষকেরও কিছু বাড়তি আয়ের সম্ভাবনা ছিল।
সমালোচকেরা দাবি করেন, দেশের বাজেট এমন হওয়া উচিত, যাতে কৃষক-সহ উৎপাদন ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরের সঙ্গে যুক্ত মানুষ তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ দাম পান। এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষা স্বাস্থ্য ও খাদ্যের জোগান সুনিশ্চিত হয়। কিন্তু কেবলমাত্র কৃষিঋণ আর কিসান ক্রেডিট কার্ড দিয়ে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। ভিক্ষার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ভরসার। সেই ভরসার কথা এ বারের বাজেটে তেমন ভাবে প্রতিফলিত হল না এমন মন্তব্য করছেন অনেকে।
তবে এ বারের বাজেটে একটি আশার কথা রয়েছে। মৌমাছির চাষের উপরে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মৌমাছির চাষের প্রসার ও ব্যাপকতা বাড়লে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে মৌমাছি অবলুপ্তির পথে। অথচ, উৎপাদনের সঙ্গে এদের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক। ভারতের ১৬ কোটি হেক্টর শস্যক্ষেত্রের মধ্যে পাঁচ কোটি পঞ্চাশ লক্ষ জমি পরাগ সংযোগের জন্য মৌমাছির উপরে নির্ভরশীল। মৌমাছির সঠিক প্রতিপালন না হলে ভবিষ্যতে উৎপাদন প্রায় এক তৃতীয়াশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা। সে কারণে এই চাষের প্রতি উৎসাহ বাড়ানো নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
শিক্ষক ও গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy