Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

বিশুদ্ধ কুয়াশার বদলে বাড়ছে ধোঁয়াশাই

গাড়ির ধোঁয়া আর জমির ফসল কাটার পরে গাছের অবশেষ পুড়িয়ে দেওয়ার ফলে যে ধোঁয়া হয় তার কারণে ধোঁয়াশা তৈরি হয় সবচেয়ে বেশি। লিখছেন সুদীপ ভট্টাচার্যসারা রাত এমন ভাবে ভেসে বেড়ানোর পরে, যখন ঠান্ডা মাটির কাছাকাছি থাকা কুয়াশায় ভেসে বেড়ানো জলীয় বাষ্পের কণাগুলো আরও ঘনীভূত হয়ে, একে অপরের নিবিড় ছোঁয়ায় মিলেমিশে এক হয়ে যায়, তখন তাদের ওজন আর ধরে রাখতে পারে না বায়ুমণ্ডল।

কুয়াশা ঘেরা শীতের সকাল। ফাইল চিত্র

কুয়াশা ঘেরা শীতের সকাল। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

শৈশবে কবিগুরুর লেখা কবিতাটি পড়েননি, এমন বাঙালি বিরল— ‘‘এসেছে শরৎ, হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে। সকালবেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের রেখা ধরে।’’

শরতের শুরু থেকে হেমন্ত পর্যন্ত কুয়াশা আর শিশিরের সময় হলেও শীতকালেই কুয়াশা দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। শীতের সকালে এক এক সময়ে তো কুয়াশার চাদর সরে সূর্যের দেখা মিলতে বেশ বেলা হয়ে যায়। কুয়াশা আসলে মেঘের মতোই। বাতাসে ভেসে থাকা সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জলীয় বাষ্পের কণা যখন রাতে ঠান্ডা হয়ে আসা মাটির কাছাকাছি এসে ঘনীভূত হয়ে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি ভেসে বেড়ায়, তাকেই কুয়াশা বলি আমরা।

সারা রাত এমন ভাবে ভেসে বেড়ানোর পরে, যখন ঠান্ডা মাটির কাছাকাছি থাকা কুয়াশায় ভেসে বেড়ানো জলীয় বাষ্পের কণাগুলো আরও ঘনীভূত হয়ে, একে অপরের নিবিড় ছোঁয়ায় মিলেমিশে এক হয়ে যায়, তখন তাদের ওজন আর ধরে রাখতে পারে না বায়ুমণ্ডল। সেই বিন্দু বিন্দু জলকণা তখন শিশির হয়ে ছোট ছোট গাছের পাতায়, ঘাসের ডগায় জমা হয়। এই সময়ে ভোরের দিকে একটু কান পাতলেই শোনা যায় নিঝুম অন্ধকারের স্তব্ধতা ভেঙে হিম পড়ার টুপটাপ শব্দ। সকালের মিঠে রোদে ঘাসের মাথার মুক্তোর মতো সেই শিশির বিন্দুর স্বর্গীয় শোভা যাঁরা দেখেননি, তাঁদের ‘‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া... ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের ওপর একটি শিশিরবিন্দু।’’

শীত মানেই কুয়াশার চাদর জড়ানো সারি সারি খেজুর গাছের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। দুলকি চালে খেজুর রসের হাঁড়ি কাঁধে হেঁটে চলা। শিউলি আর কুয়াশায় ভেসে বেড়ানো খেজুর রস জ্বাল দেওয়ার মিষ্টি গন্ধ। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার কুয়াশা-ঘেরা এই মিষ্টি সকালের ছবিটা। মাঠের খেজুর গাছ কেটে ইটভাটার জ্বালানি হচ্ছে। মেঠো পথ চওড়া পিচ রাস্তায় পরিণত হচ্ছে। খেজুর গাছ কাটা পড়ছে। পিচ রাস্তাতেও অবশ্য বেশ কুয়াশা জমে, তার কারণ ভূপৃষ্ট যেখানে দ্রুত ঠান্ডা হয়, কুয়াশা জমার পরিমাণ সেখানে তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। সে কারণেই রেল লাইনের লোহা বা পিচ রাস্তার পাথর, আশেপাশের মাটির চেয়ে বেশি ঠান্ডা হয় বলে সেই সব জায়গায় কুয়াশা আসে পাশের এলাকা থেকে অনেক অনেক বেশি ঘন হয়ে। শীতের সকালে বা রাতে অনেক সময়ই কুয়াশার জন্য ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। শীতের রাত বা সকালে জাতীয় সড়কে ঘন কুয়াশার চাদর চিরে ফগ লাইট জ্বালিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে বড় বড় গাড়ি, এ খুব পরিচিত ছবি। আস্তে গাড়ি চলার কারণে জাতীয় সড়কে এই সময়ে প্রায়ই যানজট হয় রাতের দিকে। কুয়াশা অনেক সময়ে এতটাই ঘন হয় যে, ফগ লাইটের আলোও চোখে পড়ে না। কুয়াশার কারণে সব চেয়ে বেশি পথ দুর্ঘটনাও ঘটে এ সময়েই।

কুয়াশা ঘন হওয়ার বেশ কতগুলো কারণ আছে বলে মনে করেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে, কোনও কারণে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গেলে, জলীয় বাষ্পের সঙ্গে ধূলিকণা মিশলে, ধোঁয়া মিশলে, বা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার তারতম্য ঘটলে কুয়াশা ঘন হয়। কুয়াশার সঙ্গে ধোঁয়া মিশে যে ঘন ধোঁয়াশা তৈরি হয় তা ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক বলেই মত পরিবেশ বিজ্ঞানীদের। যে সব জায়গায় কলকারখানা বেশি বা গাড়ি চলাচল বেশি, সেখানে ধোঁয়াশার পরিমাণ খুব বেশি। আমাদের নদিয়া জেলায় কলকারখানা তেমন নেই। এখানে মোটরভ্যান, গাড়ি আর কৃষি জমির ফসল কাটার পর গাছের অবশেষ পুড়িয়ে দেওয়ার ফলে যে ধোঁয়া তৈরি হয়, সেই ধোঁয়ার কারণে ধোঁয়াশা তৈরি হয় সব চেয়ে বেশি। প্রতি বছর বাড়ছে বায়ুদূষণের মাত্রা। এখন তো দূষণের জন্য ঘাসের মাথায় যে শিশির পড়ে, তা-ও অনেক সময়ে কালো কাদার ফোঁটার মতো হয়ে যায়। প্রতি বছর বিশুদ্ধ কুয়াশার বদলে বাড়ছে দূষিত ধোঁয়াশার পরিমাণ।

এই প্রসঙ্গে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তথা পরিবেশবিদ নবকুমার মণ্ডল বলেন, ‘‘প্রতি বছর এ ভাবে ধোঁয়াশার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া মোটেই ভাল লক্ষণ নয়। এই ধোঁয়াশার চাদর ভেদ করে কোনও গ্যাস বা ক্ষতিকারক ধোঁয়া বায়ুমণ্ডলের উপর দিকে উঠে যেতে পারে না বলে নানা দূষিত পদার্থ যেমন, ভারী ধাতু, বিষাক্ত হাইড্রোকার্বন-সহ বিষাক্ত ধোঁয়া, ধোঁয়াশার চাদরের মধ্যেই থেকে গিয়ে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থান করে।’’

তিনি আরও জানান, কুয়াশা বা ধোঁয়াশার মধ্যে ভেসে বেড়ায় খুব সূক্ষ্ম ধূলিকণা (পার্টিকুলেট ম্যাটার)। সাধারণ মানুষের মুখের উচ্চতায় ২.৫ মাইক্রন আর ১০ মাইক্রন মাপের সূক্ষ্ম পার্টিকুলার ম্যাটারেরা সবচেয়ে বেশি অবস্থান করে। এই কণা যত সূক্ষ্ম হয় তা তত বেশি ক্ষেত্রফল নিয়ে অবস্থান করে। ফলে, ততটাই বেশি বায়ুতে ভেসে বেড়ানো ক্ষতিকারক পদার্থ বহন করে। পার্টিকুলেট ম্যাটার যত ক্ষুদ্র হবে, তা তত বেশি বিভিন্ন দূষিত পদার্থ সঙ্গে নিয়ে ফুসফুসের গভীরে চলে যাবে। এর ফলে শ্বাসকষ্ট, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিস (COPD), এমনকি, ক্যানসারও হতে পারে। এ ছাড়া ত্বকের নানা রোগ, চোখের জ্বলুনি, গায়ে জ্বালা ধরার মতো নানা উপসর্গও হতে পারে এ থেকে।

শুধুমাত্র মানুষ বা অন্য প্রাণীরই নয়, ঘন কুয়াশা বা ধোঁয়াশার কারণে উদ্ভিদেরও ক্ষতি হয় বলে মত উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের। ঘন কুয়াশায় জাব পোকার মতো, গাছের কিছু কিছু ক্ষতিকারক কীট-পতঙ্গের উপদ্রব বাড়ে। ফলে, গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফসলের ক্ষতি হয়, উৎপাদন কমে যায়। বিষয়টি ভীষণ উদ্বেগের। একমাত্র পথ পরিবেশ রক্ষা করার ব্যাপারে আরও বেশি করে ভাবনাচিন্তা, প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানো। যানবাহনের দূষিত ধোঁয়ার উপরে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। ফসল কাটার পরে যাতে কাটা ফসলের গোড়া কোনও মতেই জমিতে পোড়ানো না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সর্বোপরি, দরকার সার্বিক সচেতনতা। তবেই হয়তো ধানের উপরে কালো কাদামাখা শিশিরকণা সূর্যের কিরণে মুক্তোর মতো ঝকঝকে শিশির বিন্দুতে পরিণত হবে আবার।

অন্য বিষয়গুলি:

Winter Stubble Burning Smog Fog
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy