হিন্দিস্তান? সারা দেশে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবকে স্মরণ করে ‘হিন্দি দিবস’ সমারোহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, দিল্লি, ১৪ সেপ্টেম্বর। পিটিআই
ভারতে হিন্দি-বিতর্ক অনেকটা কয়লার আগুনের মতো। ভেতরে ভেতরে ক্রমাগত জ্বলছে, হাওয়া দিলে শিখাটা দপ করে ওঠে। হিন্দি দিবসে কেবল সেই ফুঁ দেওয়ার কাজটাই করেছেন অমিত শাহ। আর সঙ্গে সঙ্গে অহিন্দিভাষী জনতা এবং রাজনৈতিক নেতারা প্রতিবাদে জ্বলে উঠেছেন। অতএব কয়লা জ্বালানো পর্বটিই সর্বাধিক জরুরি।
ভাষাগত ভাবে ভারত আসলে সংখ্যালঘুর দেশ। এ দেশের ৯০ শতাংশ জনতা ২০টি ভাষায় কথা বলে, যার মধ্যে একটি হিন্দি। ২০১১ আদমশুমারি অনুসারে, দেশের ৪৩ শতাংশ জনতার মাতৃভাষা এটি। বহুভাষিক দেশে সংযোগ ভাষার ধারণাও বহু পুরনো। সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজির মতো একাধিক উদাহরণ আছে। তবে সে সবই এলিট বা অভিজাতের ভাষা। লেখাপড়া, সাহিত্য, প্রশাসনে তা থাকলেও ভারতজোড়া জনতার ভাষার অস্তিত্ব কখনওই ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর্বে জাতীয়তাবাদের বাহন হিসেবে উঠে এল সবচেয়ে বেশি-বলা ভাষা হিন্দি। তার পর চলল এক অভূতপূর্ব নিরীক্ষা, যা ভারত আগে কখনও দেখেনি।
উনিশ শতকে, এখনকার গো-বলয়ে সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুকে সরিয়ে হিন্দি ব্যবহারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এই দাবির বিরোধিতায় সরব হয় মুসলমান সমাজ, কারণ ফারসি লিপি এবং ফারসি শব্দকোষের জ্ঞানের বলে প্রশাসনিক ও আইনগত কাজে তাঁরা সুবিধে ভোগ করতেন। হিন্দুরা বললেন, এই উর্দু ইংরেজির মতোই বিদেশি। জনতার ভাষা না হলে ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। ১৮৩০-এর দশকে সেই দাবি মেনে নিল ব্রিটিশ শাসক। স্থানীয় ভাষার চর্চাও শুরু হল প্রবল ভাবে। সময় যত এগোল, তত উত্তর ভারত জুড়ে ব্রিটিশ-পূর্ব ও মুসলমান-পূর্ব ভারতীয় (পড়ুন হিন্দু) সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের ডাক এল। পুনর্জাগরণ পর্বে হিন্দিকে ফারসি-আরবি শব্দভাণ্ডার থেকে মুক্ত করে সংস্কৃত ঘেঁষা করে তুলতে চাইলেন সে কালের নেতারা।
আর এই ‘বিশুদ্ধি’ ভয় পাওয়াল উর্দুভাষীদের। ধর্মীয় রাজনীতির গন্ধ থাকলেও, স্বাধীনতা আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় প্রতীক হিসেবে গুরুত্ব পেতে থাকল হিন্দি। অহিন্দিভাষীরাও আপত্তি করলেন না। ১৯০৫ সালে হিন্দির জাতীয় ভূমিকার কথা প্রথম বললেন মরাঠি নেতা বালগঙ্গাধর টিলক। ভিত আরও পোক্ত করলেন গুজরাতিভাষী মহাত্মা গাঁধী। তিনি অবশ্য হিন্দির কথা বলেননি, বলেছিলেন ‘হিন্দুস্তানি’ ভাষার কথা। নাগরী এবং ফারসি দুই লিপিতেই লেখা যায় সে ভাষা। শব্দভাণ্ডারও গড়ে সংস্কৃত এবং ফারসিগন্ধী। ১৯২৫’এ হিন্দুস্তানিকেই প্রাথমিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে কংগ্রেস। তামিল চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি থেকে বাঙালি সুভাষচন্দ্র বসু সকলেই তা মেনে নেন। দেশভক্তি এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানের প্রতীক হয়ে ওঠে এই ভাষাশিক্ষা। দেশ জুড়ে গজিয়ে ওঠে হিন্দুস্তানি শিক্ষার সংগঠন।
একটু ভেঙে দেখলে বোঝা যায়, গাঁধীর ভাষা-ভাবনার ছত্রে ছত্রে পুনর্জাগরণ, এবং একতা ও সমঝোতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা ছিল। স্পষ্ট ছয় দফা প্রস্তাবও ছিল তাঁর। এক, ভারতের সাধারণ ভাষা হবে ‘হিন্দুস্তানি’, হিন্দি নয়। দুই, কোনও ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের সঙ্গে সংলগ্ন থাকবে না হিন্দুস্তানি। তিন, ‘বিদেশি’ বা ‘দেশি’ শব্দ বলে কিছু থাকবে না, কেবল সাম্প্রতিকতার কষ্টিপাথরে শব্দকে যাচাই করে নেওয়া হবে। চার, সাম্প্রতিকতা বলতে উর্দুভাষী হিন্দু লেখক এবং হিন্দিভাষী মুসলমান লেখকদেরও ধরা হবে। কেননা, উর্দু বা হিন্দি সাম্প্রদায়িক ভাষা নয়। পাঁচ, পরিভাষার ক্ষেত্রে— বিশেষত রাজনৈতিক— সংস্কৃতকে আলাদা মর্যাদা দেওয়া হবে না, কিন্তু উর্দু, হিন্দি ও সংস্কৃতের স্বাভাবিক বাছাই প্রক্রিয়ায় এই ভাষাই অগ্রাধিকার পাবে। ছয়, দেবনাগরী ও আরবি দুই লিপিই সাম্প্রতিক ও সরকারি বলে ঘোষিত হবে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের প্রবক্তারা আজও স্বদেশ ও স্বদেশির প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গাঁধীজি ও হিন্দুস্তানি ভাষাকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। শাহের বক্তব্যেও সেই গন্ধ ছিল— “আমাদের প্রাচীন দর্শন, আমাদের সংস্কৃতি, স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে গেলে আমাদের স্থানীয় ভাষাকে শক্তিশালী করতেই হবে। সে ক্ষেত্রে একটাই ভাষা আছে, যা গোটা দেশ জানে... স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে যদি হিন্দিকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তা হলে সংগ্রামের সমগ্র আত্মাটাই বিনষ্ট হয়ে যায়।” যে আরএসএস ও কংগ্রেসের পরস্পরের সঙ্গে দ্বিমত হওয়াই দস্তুর, ভাষার প্রশ্নে কিন্তু তাদের সহচর হতে বাধা নেই। হিন্দুস্তানি প্রসঙ্গে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, “...সামান্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে অতি দ্রুত দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে, এবং কাঙ্ক্ষিত জাতীয় ঐক্য নিয়ে আসতে সাহায্য করবে।”
শাহ আরও বলেছেন সর্বজনীন পরিচিতির কথা। রাশিয়াকে যেমন রুশ ভাষায় চেনে দুনিয়া, ভারতকেও তেমন চিনবে হিন্দি ভাষায়। কিন্তু একটু ঘুরিয়ে ভাবা যেতে পারে, বিশ্বের অন্যান্য বহুভাষিক দেশে কী হয়। কানাডা যেমন সরকারি ভাবে দ্বিভাষী। যে কোনও সরকারি কাজই দু’টি ভাষায়— ইংরেজি ও ফরাসি— প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। সে দেশে ৫৯.৩ শতাংশ ইংরেজিভাষী এবং ২২.৯ শতাংশ ফরাসিভাষী। সেখানে সংখ্যার জোর থাকলে সংখ্যালঘু ভাষার স্বীকৃতি বাধ্যতামূলক। আবার, মরক্কোয় ক্লাসিক্যাল আরবি সরকারি ভাষা হলেও সে দেশের লোকেরা এক নিজস্ব ভঙ্গিতে আরবি বলেন, যাকে উপভাষা বলা যায়। মালয়েশিয়ার প্রায় প্রত্যেক নাগরিকই মালয়ের পাশাপাশি চলনসই ইংরেজিও জানেন। ফিনল্যান্ড বা বেলজিয়াম বা লুক্সেমবুর্গ বা নাইজেরিয়ায় প্রায়ই দেখা যায়, বাড়িতে এক ভাষা এবং বাজারে আর এক ভাষা বলেন নাগরিকেরা। বিশ্ব জুড়ে বহুভাষিকতার অস্তিত্ব আছে, এবং নানা চ্যালেঞ্জও আছে। অনেকেই তাকে সযত্নে রক্ষা করে সেই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। যাঁরা ইংরেজিভাষী, বা কোনও শক্তিশালী ভাষাভাষী নন, অর্থাৎ যাঁরা তাঁদের মাতৃভাষাতেই কাজকর্ম করেন, সেই নাগরিকরা যাতে কোনও ভাবেই পিছিয়ে না পড়েন, সেই দায়িত্বও নিচ্ছে বহু রাষ্ট্র। অতএব পরিচিতির যুক্তি কি ধোপে টিকল?
উল্টে বলা যায়, ভাষার প্রতি সরকার বা সমাজের নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী, তার উপরই নির্ভর তার সামাজিক সম্মান বা স্টেটাস। শিশুদের সামনে যে হেতু একাধিক ভাষা শেখার সুযোগ, সুতরাং ভাষার সামাজিক চরিত্র নির্মাণে রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রয়োজনীয়। ভেবে দেখলে, সে কাজই করছেন শাহ।
স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে দেশব্যাপী হিন্দির যে প্রয়োজনীয়তা ছিল, ১৯৪৭-এর পরে তা-ও আর রইল না। তার উপর ১৯৫৬ সালে ভাষাভিত্তিক রাজ্যভাগে সেই গুরুত্ব আরও কমল। সে কারণেই ১৯৫০ বা ১৯৬৫ দু’বারই একক সরকারি ভাষা করা গেল না হিন্দিকে। অর্থাৎ, ‘এক’ জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তোলা এবং হিন্দির প্রয়োজনীয়তা বার বার একই সঙ্গে বলা হয়ে এসেছে। এখনও তাই ঘটছে।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কাজ চালাতে গেলে একটা সাধারণ ভাষার প্রয়োজন হয়। সমস্ত বহুভাষিক দেশেই এ রকম একটা সংযোগ ভাষা বা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা থাকে। যে দুই গোষ্ঠীর মাতৃভাষা এক নয়, সেখানে তৃতীয় একটা ভাষার প্রয়োজন হয়, যা সেতুর কাজ করে। ভারতের কোথাও কোথাও হিন্দি তেমন হতেই পারত। যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানে না-ও হতে পারত। কিন্তু তার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ‘ঐক্যের ভাষা’ হতে চেয়েই বিপদ বাধাল হিন্দি। ১৯৪০ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এক বক্তৃতায় বলছেন, কিছু নিরিখে হিন্দি ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হলেও তা কম সংখ্যক লোকেরই মাতৃভাষা।
নিঃসন্দেহে, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যত দিন কেন্দ্রমুখী হয়ে থাকবে, তত দিন এক ভাষার গুরুত্ব বার বার উঠে আসবে। আমরা রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছি বলেই এমন ব্যবস্থা। যদি ভাষাকে প্রাধান্য দিতাম, তা হলে হয়তো রাজনৈতিক কাঠামোটাই অন্য রকম হতে পারত। সেই পথেই জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে ঢুকে গিয়েছে ‘রাষ্ট্রভাষা হিন্দি’। ঢাকাই বাঙাল হাবুল সেন বলেছিল— ‘হাম—হাম। মানে কী? আমি—আমি...’। বাঘেও রাষ্ট্রভাষা কয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy