জো বাইডেন। ছবি রয়টার্স।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে শপথ লইয়া জো বাইডেন যে ভাষণ দিলেন, তাহাকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়াছে বিশ্ব। বাইডেন ভাষণে বলিয়াছেন, এই উদ্যাপন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এক প্রার্থীর নির্বাচনে জয়ের উদ্যাপন মাত্রই নহে, গণতন্ত্রেরই উদ্যাপন। বলিয়াছেন, গণতন্ত্র অমূল্য, গণতন্ত্র আঘাতপ্রবণও বটে, কিন্তু সব কিছুর পরেও গণতন্ত্র যে রক্ষিত হইয়াছে, তাহাই উদ্যাপনীয়। সাম্প্রতিক অতীতে আমেরিকায় গণতন্ত্রের চরম দুর্দশা হইয়াছিল। নূতন প্রেসিডেন্টের ভাষণে সেই অগণতন্ত্রের বিদায়ঘণ্টা বাজাইয়া সুষ্ঠু ও সফল প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রকে ফিরাইয়া আনিবার সুর শুনিয়া গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ আশায় বুক বাঁধিতেছেন। আবার এই ভাষণের বিরোধিতাও কম হয় নাই। আমেরিকার দক্ষিণপন্থী গণমাধ্যমগুলি কটাক্ষ করিয়াছে, বাইডেন যাহা বলিয়াছেন তাহা নিতান্ত চর্বিতচর্বণ, নীরস। তাহাতে রুজ়ভেল্টের ‘নিউ ডিল’-এর চমক নাই, কেনেডির ‘নিউ ফ্রন্টিয়ার’-এর স্বপ্ন নাই। এহেন সাদামাটা বক্তৃতা পূর্বে কোনও প্রেসিডেন্ট দেন নাই, এত ‘সাধারণ’ কথাও যে প্রেসিডেন্টের বক্তৃতায় স্থান পাইতে পারে, তাহাই লজ্জার।
কিন্তু এখন এই সাধারণেই ফিরিবার সময় নহে কি? গণতন্ত্র বহু মানুষের এবং সেই কারণেই বহু মতের সম্মিলন, সেই সহজ সত্য মনে রাখিয়া অগ্রসর হইবারই সময় এখন। ইহা ‘সাধারণ’ কথা বলিয়া মনে হইতে পারে, কিন্তু ইহা গোড়ার কথাও। সেই দিক দিয়া দেখিলে বাইডেনের বক্তব্যের বিরোধীরা ঠিকই বলিতেছেন— কোনও নূতন প্রেসিডেন্টকে ইহার পূর্বে এই কথাগুলি বলিতে হয় নাই, কারণ আমেরিকার গণতন্ত্রপ্রেমী নাগরিকরা ধরিয়াই লইয়াছিলেন যে এই কথাগুলি স্বতঃসিদ্ধ; গণতন্ত্রের এই মূলগত মূল্যবোধগুলি সকলেই জানেন, মানিয়াও থাকেন, যাহা কিছু ভাবিবার বা করিবার তাহা ইহার পরবর্তী পদক্ষেপ সংক্রান্ত। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনকালে আমেরিকা গণতন্ত্রের শিকড়ে টান পড়িতে দেখিয়াছে। সত্য, সাম্য, নীতি ও ন্যায্যতা যে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে, জাতি ও বর্ণবিদ্বেষে সমাজ যেরূপ দ্বিধাবিভক্ত হইয়া গিয়াছে, তাহার পরে বাইডেনের ভাষণে বলা জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক সংহতিতেই ফিরিবার সময়। সাফল্যসিঁড়িতে তরতর করিয়া উঠিবার কথা পরে, শুরুর টাল খাইয়া যাওয়া ধাপটি আগে মেরামত করিতে হইবে। প্রেসিডেন্টের ওই সহজ, ‘সাধারণ’ কথাগুলি আসলে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত, সেগুলি উচ্চারণের গুরুত্ব সেইখানেই। গণতন্ত্রে বিরোধী দেখিলেই তাহাকে গুলি মারিবার স্লোগান উঠানো চলে না, বিরুদ্ধ বা ভিন্নস্বর শুনিলেই তাহাকে উপহাস-ধর্ষণ-হত্যার হুমকিতে সন্ত্রস্ত করা চলে না, রাজনীতি ও সমাজের এই মৌলিক শর্ত এত কাল সুরক্ষিত ও আচরিত হইতেছিল বলিয়া ভাবিয়া লওয়া ভুল হইয়াছিল। সেই ভুল শুধরাইতেই এই সাধারণ কথাগুলি বলা, বারংবার বলা জরুরি।
দেশের ও দশের দায়িত্ব যাঁহার কাঁধে, তেমন নেতার মুখে এই কথাগুলি শুনিলে গণতন্ত্রপ্রেমী জনগণ আশ্বস্ত হন। বাইডেনের ভাষণে যে সাড়া পড়িয়াছে তাহাতেই প্রমাণ, আমেরিকাবাসী ভরসা পাইয়াছেন। বিশ্বের অন্য বহু দেশেও এখন গণতন্ত্রের বিস্তর সমস্যা ও সঙ্কট, সেই দেশগুলির অধিবাসীদেরও বাইডেনের বক্তৃতা ভাল লাগিতে বাধ্য। ভারতের গণতন্ত্রপ্রেমী নাগরিকেরা হয়তো ভাবিতেছেন, তাঁহাদের রাষ্ট্রনেতার মুখে এই কথাগুলি শুনিতে পাইলে কী ভালই না হইত। বাইডেনের ভাষণে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, রক্ষণশীল-উদারবাদীদের বিরোধ অতিক্রম করিয়া দেশের গণতন্ত্র রক্ষা ও প্রসারের কথা ধ্বনিত হইয়াছে। ভারতের গণতন্ত্রও এই মুহূর্তে হিন্দু ও মুসলমান, শাসক ও বিরোধী, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও উদার বহুত্ববাদের সংঘর্ষে রক্তাক্ত। আরও একটি প্রজাতন্ত্র দিবস চলিয়া গেল, গণতন্ত্রের গোড়ার সাধারণ কথাগুলি রাষ্ট্রপ্রধান এই দিনে নিজমুখে বলিলে খানিক ভরসা মিলিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy