শশী তারুর। ফাইল চিত্র।
মল্লিকার্জুন খড়্গেকে হারিয়ে তিনি যদি কংগ্রেস সভাপতি পদে নির্বাচিত হতেন, সংগঠনের তাতে কিছুমাত্র ইতরবিশেষ হত কি না, অনেকেরই সেই সংশয় রয়েছে। কিন্তু এটুকু বলাই যায় যে, তা হলে সওয়া শতাব্দীপ্রাচীন দলটি জওহরলাল নেহরুর পর এই প্রথম এমন এক জন সভাপতি পেত, যিনি একই সঙ্গে পণ্ডিত ও ফ্ল্যামবয়েন্ট, নিজের জোরেই জগৎসভায় সুপরিচিত। এমন এক জন, যাঁকে দেখে রাজনীতি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলা শিক্ষিত উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যেও কেউ কেউ হয়তো সদস্যপদের জন্য ফর্ম পূরণ করে ফেলতেন!
শশী তারুরের পরিচয়টি ঠিক কী? তিরুঅনন্তপুরম লোকসভা কেন্দ্র থেকে তিন বারের কংগ্রেস সাংসদ, দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী? রাষ্ট্রপুঞ্জের ভূতপূর্ব আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল? টাফ্টস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল অব ল’ অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসি-র ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে পিএইচ ডি করার কৃতিত্বের অধিকারী? বিশ্বের বেশ কয়েকটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপক? গোটা কুড়ি বইয়ের লেখক, যার মধ্যে দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান নভেল বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠ্যক্রমের অন্তর্গত— উত্তর-ঔপনিবেশিক চর্চা ও ইংরেজি সাহিত্য, উভয় বিষয়েই? না কি, ভারতীয় রাজনীতিতে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারের অগ্রপথিক, অথবা চলমান শব্দকোষ?
প্রতিটি পরিচয়ই ঠিক, প্রতিটি পরিচয়ই শশী তারুরকে অন্তত আংশিক ভাবে চেনায়। কিন্তু, ৬৬ বছর বয়সি তারুরের মোক্ষমতম পরিচয়টি সম্ভবত এই যে, তিনি হেরে যাওয়া লড়াইকেও স্মরণীয় করে রাখতে জানেন। দেড় দশকের ব্যবধানে দু’টি সাংগঠনিক নির্বাচন, দু’টিতেই তাঁর পরাজয় ছিল পূর্বনির্ধারিত। ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব পদে বান কি-মুনের বিরুদ্ধেই হোক, বা ২০২২-এ কংগ্রেসের সভাপতি পদে মল্লিকার্জুন খড়্গের বিরুদ্ধে— তারুরের আসল প্রতিদ্বন্দ্বীরা নির্বাচনের ময়দানে ছিলেন না। ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁকে মনোনীত করেছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব পদে ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে। কোফি আন্নানের স্নেহধন্য, ও তাঁর উত্তরসূরি হিসাবে পরিচিত তারুরকে নাকি পছন্দ ছিল না আমেরিকার। তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট কন্ডোলিসা রাইসের নির্দেশে রাষ্ট্রপুঞ্জের সিকিয়োরিটি কাউন্সিলে আমেরিকার প্রতিনিধি ভেটো দেন তারুরের বিরুদ্ধে। চার দফা ‘স্ট্র পোল’-এর পর নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়ান তারুর— চার দফাতেই তাঁর স্থান ছিল দ্বিতীয়, বান কি-মুনের পরেই। কিন্তু, তার আগেই, সেই নির্বাচনের প্রচারপর্বে তারুরের বাগ্মিতা আর সপ্রতিভতার খবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে এতখানিই পৌঁছেছিল যে, কংগ্রেসে যোগ দিয়ে ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে সমস্যা হয়নি— ভারতীয় রাজনীতিতে তিলমাত্র অভিজ্ঞতা ছাড়াই।
তাঁর সংসদীয় জীবন অতীব বর্ণময়, সে কথা বলা যাবে না। দ্বিতীয় ইউপিএ-র আমলে এক বছরের জন্য বিদেশ প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন, মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন দেড় বছরের জন্য। তার পর, বিরোধী দলের সাংসদ হিসাবে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে কাজ করেছেন। স্ত্রী সুনন্দা পুষ্করের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় বিতর্কে জড়িয়েছেন, যদিও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগই ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু, এই একই সময়কালে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রেখে গিয়েছেন তারুর। তৈরি করেছেন অল ইন্ডিয়া প্রফেশনাল কংগ্রেস, লিখেছেন অন্তত পাঁচটি বই, যোগ দিয়েছেন স্ট্যান্ড আপ কমেডির অনুষ্ঠানেও। মেঠো রাজনীতিতে তাঁর পুঁজি এখনও তেমন নয়, কিন্তু শিক্ষিত, উদারবাদী ভারতীয়দের কাছে তিনি নিজেকে বিলক্ষণ গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে তাঁর অবধারিত পরাজয়ের পরেও সোশ্যাল মিডিয়ায় যে সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল, তা এই জনগোষ্ঠীর কাছে তারুরের গ্রহণযোগ্যতার নির্ভুল প্রমাণ।
তিনি যে হারবেন, নিজেও জানতেন তারুর। গান্ধী পরিবারের সমর্থন যে খড়্গের দিকে, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও। একের পর এক প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি খড়্গেকে সমর্থন করার কথা ঘোষণা করেছে। তার পরও তারুর নির্বাচনী ময়দান থেকে সরেননি। অসমান খেলার মাঠ বিষয়ে নিজের অসন্তোষ জানিয়েছেন প্রকাশ্যেই, কিন্তু সেটুকুতেই থামেননি। কংগ্রেসের সাংগঠনিক সংস্কার বিষয়ে তাঁর মতামত স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করেছেন নিজের নির্বাচনী ইস্তাহারে। সভা করেছেন একের পর এক। এবং, গান্ধী পরিবার তাঁর পক্ষে নেই, জানার পরও বিন্দুমাত্র অসৌজন্য প্রকাশ করেননি। তারুর সম্ভবত জানেন, একটা লড়াইয়ে যুদ্ধ ফুরোয় না। হেরে যাওয়া নির্বাচন থেকেও যে ভবিষ্যতের পুঁজি অর্জন করা যায়, নিজের অতীত থেকেই কথাটি তাঁর জানা। এবং, তিনি এ কথাও জানেন যে, দলটির নাম কংগ্রেস— তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চোরা স্রোত কখন কার পায়ের নীচের মাটি কেড়ে নেয়, আর কাকে নিয়ে আসে ক্ষমতার কাছাকাছি, সে বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা নেহাতই মূর্খামি।
তারুরের ভবিষ্যৎ কোন খাতে বইবে, সে প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের কাছেই রয়েছে। তবে, শিক্ষা যে রাজনীতির ময়দানে কোনও প্রতিবন্ধক নয়, অথবা রাজনীতির সঙ্গে যে সৌজন্যের বিরোধ নেই, তারুরকে দেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই কথাগুলি শিখতেই পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy