সাফিন আলি থাকত মেদিনীপুরের এক বস্তিতে। রোগাপাতলা শরীর, তাই ছোটবেলা থেকেই বুঝে গিয়েছিল লেখাপড়াটা মন দিয়ে করতে হবে। পরিশ্রম করে স্থানীয় স্কুলে এক সময় সে সেকেন্ডও হল ক্লাসে। তেমনই এক সময় স্কুলের সায়েন্স এগজ়িবিশনে আড়াল থেকে শুনেছিল এক শিক্ষক তার সহপাঠীকে বলছেন, “ওই বস্তির ছেলেটা ফার্স্ট না হয়ে যায়।” সাফিন বাড়ি চলে এসেছিল একবুক অভিমান নিয়ে। লেখাপড়া ছেড়ে বিপথে যাওয়ার সমস্ত হাতছানি তার সামনে মজুত ছিল। কিন্তু সাফিন আজ ডাক্তার। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি নিয়ে মুম্বইয়ে থাকে। গ্রামের ওই স্থানীয় স্কুল থেকে মুম্বই পর্যন্ত সাঁকো গড়ে দেওয়ার কাজটা করেছে আল-আমিন মিশন। গত কয়েক বছরে মাধ্যমিকের রেজ়াল্টে যে প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের উপস্থিতি চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো।
পশ্চিমবঙ্গের এমন বহু সাফিন এই ভাবেই আলোর দিশা দেখিয়েছে। কারও বাবা রিকশাচালক, কারও মা বিড়ি বাঁধেন, কেউ বাবাকে আজন্ম জেলহাজতেই দেখে এল— দারিদ্র আর অশিক্ষার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে সেই সব ছেলেমেয়েরা আজ কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ গবেষক।
আল-আমিন মিশনের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলামের পরিকল্পনা ছিল শুধুমাত্র মুসলমান ছেলেমেয়েদের জন্যে একটা আবাসিক স্কুল চালু করার। ‘শুধুমাত্র মুসলমান’— কেন? আশির দশকের শেষ তখন। শিক্ষায় স্বাস্থ্যে চেতনায় সামগ্রিক ভাবে রাজ্যের মুসলমান জনসংখ্যা কতটা পিছিয়ে, তার ভয়াবহতা তখনও পরিসংখ্যানে মাপা যায়নি যথার্থ অর্থে। কিন্তু, পিছিয়ে পড়া বুঝতে কি আর পরিসংখ্যান লাগে? একটা পরিবর্তন দরকার ছিল। আর সেই পরিবর্তনটা আসার দরকার ছিল মুসলমানদের ভেতর থেকেই।
তাই কেউ কেউ এই ভাবেই ভাবছিলেন। সরকারকে দোষারোপ না করে, সংরক্ষণের জন্যে হাত না পেতে মুসলমানদের লেখাপড়া শেখাতে হবে। সংরক্ষণ যদি করতেই হয়, বুনিয়াদি স্তরেই হোক না সেটা।
এক কামরার একটা বাড়িতে এগারো জন আবাসিক শিক্ষার্থীকে নিয়ে শুরু হল দেশের অন্যতম সফল শিক্ষা-আন্দোলন। তত দিনে একটা ফুলস্কেপ পাতায় ডটপেনে আঁকা হয়েছে একটা ছবি— একটা ফুটবল মাঠ, তার এক দিকে একটা ইস্কুলবাড়ি আর অপর প্রান্তে একটা হস্টেল। সেই স্বপ্ন সফল করতে শুধু কঠোর পরিশ্রম নয়, দরকার যথেষ্ট অর্থেরও। বেরিয়ে পড়তে হয়েছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়েও। আয়ের আড়াই শতাংশ জাকাত হিসেবে দান করা সচ্ছল মুসলমানদের জন্য অবশ্যকর্তব্য। বড় বড় মুসলমান ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের সামনে হাত পাতলে কাজ হবে কি? সংশয় ছিলই। দানের অর্থের এমন ব্যবহার সেই সময় মুসলমান সমাজ দেখেনি। ধেয়ে এসেছে সন্দেহ, অপমান। দরজায় দরজায় ঘুরেছেন নুরুল ইসলাম, দরকারে স্ত্রীর গয়না পর্যন্ত বন্ধক দিয়েছেন। সরকারি স্কুলে চাকরি করেন, সেই মাইনেটুকুও এসে জমা হয়েছে মিশনের তহবিলে। কিন্তু এ সবে হার মানেননি।
তিন দশক পেরিয়ে এসে আল-আমিন মিশন আর ফুটবল মাঠের দু’দিকের দুটো বাড়ি নয়, সারা রাজ্যে মিশনের ৩৩টা শাখায় চলছে রাজসূয় যজ্ঞ। ২০২০-তে উচ্চ মাধ্যমিকে বসেছিল ২১৫৫ জন। প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে সারা পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্য থেকে সেরা মুসলমান মেধা বেছে নেয়। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, এমনকি দারিদ্রসীমার নীচে থাকা পড়ুয়ারাও আসে এখানে। আর্থিক সামর্থ্য পড়াশোনার অন্তরায় হয়ে ওঠে না। অসংখ্য মানুষের দানে সম্পূর্ণ নিখরচায় বা আংশিক খরচে পড়াশোনা করে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী। মিশনের চার দেওয়ালের মধ্যে এদের কাজ হয় শুধুমাত্র লেখাপড়া করা। মাধ্যমিকে প্রথম স্থান দখল করা হয়ে গিয়েছে এক দশক আগে। উচ্চ মাধ্যমিকের মেধাতালিকাতেও মিশনের ছাত্র-ছাত্রীরা উপস্থিত। ২০২০-র অঘোষিত মেধাতালিকাতে সম্ভাব্য প্রথম কুড়িতে জায়গা করে নিয়েছে অন্তত ৭৭ জন।
গত চার বছরে রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে গড়ে ১০ শতাংশ আসন এই মিশনের দখলে। এই হবু ডাক্তারদের অনেকেই তাদের পরিবারের প্রথম শিক্ষিত প্রজন্ম। এ ভাবেই মুর্শিদাবাদ, দুই দিনাজপুর, মালদহ— মুসলমানপ্রধান জেলাগুলোতে প্রায় মসিহার ভূমিকা নিয়েছে মিশন, না হলে এই সব ছেলেমেয়ে বহু আগেই পড়াশোনা ছেড়ে বিড়ি বাঁধার কাজে, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে হিসেবে বা অপরাধের রাস্তায় হারিয়ে যেতে পারত। এই প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে বদলে গিয়েছে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানও। তাই ডব্লিউবিসিএস, আইএএস-এর মতো প্রশাসনিক পদে বা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের তালিকায় মুসলমান নাম এখন একেবারে অমিল নয়।
রবীন্দ্রনাথ ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশকে লেখাপড়া শেখানোর কথা। মূলস্রোতে ফেরার সেটাই একমাত্র রাস্তা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। কিছু কিছু মানুষ নীরবে সেই কাজটাই করে চলেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy