১৯৩৪ সালের নাৎসি শাসনাধীন জার্মানি। দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে ইহুদি বিতাড়নের পালা। বাদ পড়েননি সমাজের উচ্চস্তরের ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষাবিদ, গবেষকরাও। নাৎসি সরকার প্রথম আঘাতটা হানল জার্মান শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র, স্বাধীনতার মন্ত্রে বিশ্বাসী ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর। নবনিযুক্ত নাৎসি সরকারি কমিশনার জানালেন, ইহুদিদের যে শুধু মাইনে কেটে তাড়ানো হবে তা-ই নয়, বাধা দিলে সোজা পাঠানো হবে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। তবে ভয় নেই আর্যরক্তের বিশুদ্ধ জার্মানদের, সরকারি উদ্দেশ্য মেনে জ্ঞানের চর্চায় টাকার অভাব হবে না।
সে দিন জনাকয়েক জার্মান অধ্যাপককে বাদ দিলে আর কেউই তাঁদের ইহুদি সহকর্মী বা ছাত্রদের পাশে দাঁড়াননি। বরং, অনেকেই অপেক্ষা করছিলেন ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টিতে যোগদানের প্রথম সুযোগটির, যাতে সেই ডামাডোলের সময়টাতেও যতটা সম্ভব ক্ষমতা ও সুবিধে কুক্ষিগত করা যায়। এই নাৎসি-ধ্বস্ত জার্মানিতেই থেকে গিয়েছিলেন গ্যোটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কবিদ এবং বিশুদ্ধ জার্মান রক্তের ডেভিড হিলবার্ট। প্রাপ্তির আশায় নয়, পিতৃভূমির প্রতি আনুগত্য থেকে। একে একে হিলবার্টের সামনে বিদায় নিতে বাধ্য হলেন তাঁর প্রিয় শিষ্যা এমমি নোদেয়ার, নোবেলজয়ী পদার্থবিদ ম্যাক্স বর্ন আর জেমস ফ্রাঙ্ক-সহ ৪৫ জন অধ্যাপক। তার পর এক ভোজসভায় নাৎসি শিক্ষামন্ত্রী বার্নহার্ড রাস্ট হিলবার্ট-এর কাছে জানতে চাইলেন, ইহুদিরা চলে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কি খুব ক্ষতি হয়েছে? মাথা নাড়লেন হিলবার্ট, “নাহ্, ক্ষতি হয়নি, মৃতদেহের কি আর অঙ্গহানির ভয় থাকে?” একা প্রতিবাদ করতে ভয় পাননি গণিতজ্ঞ হিলবার্ট।
কী হত, সে দিন যদি নিজেদের স্বার্থ ভুলে জার্মান বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের ইহুদি সহকর্মী আর পড়ুয়াদের পাশে একজোট হয়ে রুখে দাঁড়াতেন? আয়ারল্যান্ডে ২০১৭ সালের নারী দিবসের ঘটনাক্রমে তেমনই এক বিকল্প সম্ভাবনার একটা আভাস পাওয়া যায়। ২০১২ সালে সবিতা হলপ্পানভরের মৃত্যুর পর সে দেশের সংবিধানের গর্ভপাত-বিরোধী অষ্টম সংশোধনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ চরমে ওঠে, যা পূর্ণতা পায় পাঁচ বছর পেরিয়ে ৮ মার্চের দেশ জুড়ে হরতাল আর মিছিলের দিন। একাধিক নেত্রীর পাশে পড়ুয়া আর সহকর্মীদের নিয়ে বিক্ষোভের সামনে থাকেন ৭২ বছর বয়সি, ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীবিদ্যার প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, অ্যালিভে স্মিথ। তাঁদের দাবি মেনে আসে গণভোট, অবশেষে রক্ষণশীলদের হারিয়ে বাতিল হয় সংশোধনী।
সরাসরি বিক্ষোভে পা না মেলালেও বিশ্ব জুড়ে বিগত তিন দশক ধরে গবেষকরা কিন্তু চুপ করে বসে থাকেননি। বরং তাঁদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় একাধিক বিশ্ববিশ্রুত চিকিৎসা এবং বিজ্ঞান পত্রিকায় ক্রমাগত মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে গর্ভপাতের বিরোধিতায় মানসিক চাপ বা স্তন ক্যানসারের সম্ভবনা বৃদ্ধির মতো উদ্দেশ্যমূলক ভাবে বিভ্রান্তিকর প্রচারগুলি।
কোনও অসমসাহসীর একক প্রতিবাদ, না কি গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো— বিদ্যাচর্চার দুনিয়ায় কোন গল্পটি বেশি পরিচিত আমাদের কাছে? তুলনায় অনেক কম হলেও, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের যূথবদ্ধ প্রতিবাদের ঘটনা কিন্তু ঘটেছে। বিশেষত পশ্চিমে। অতিমারির সুযোগে ট্রাম্প প্রশাসন যখন আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তর্জাতিক পড়ুয়াদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করছিল, তখন হার্ভার্ড-এমআইটি’র মতো প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ গর্জে ওঠেন। মামলা ঠোকেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে।
২০২০ সালই সাক্ষী থাকল নেচার, সায়েন্স, এবং নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন নামক বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রের তিন সর্বজনমান্য জার্নালের আমেরিকার সরকারের অতিমারি সামলানোর অপদার্থতা ও মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে মুখর হওয়ার। তাতে স্বর মেলান সরকারি টাস্ক ফোর্সের সদস্য ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্টনি ফাউচি। সমর্থন করলেন ৮১ জন নোবেলজয়ী; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে বৈপ্লবিক ডিপ লার্নিংয়ের এক প্রাণপুরুষ ইয়ান লেকুনও। শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ পিছিয়ে থাকে না তুরস্কও। সরকারকে প্রশ্ন করার অপরাধে, হাজারের উপর শিক্ষাবিদ ছাঁটাই বা জেলবন্দি হলেও, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইতে ভাটা পড়ে না। ব্রাজিলের শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি অনুদানের সঙ্কোচনের বিরুদ্ধে নির্দ্বিধায় পথে নামেন শিক্ষকরা।
স্বাধীন ভারতে ছবিটা ক্রমেই উল্টো পথে হেঁটেছে। সত্তরের দশকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে গ্রাস করার সরকারি প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে একাকী জ্যোতিষ্ক হয়ে জেগে ছিলেন কেবল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের উপাচার্য, অর্থনীতিবিদ অম্লান দত্ত। আরও সাড়ে চার দশক অতিক্রম করে সেটুকু প্রতিবাদও বিরল।
ছাত্রদের প্রতিবাদ আছে, কিন্তু প্রতিষ্ঠান এখনও রাষ্ট্রীয় ধামা ধরতেই ব্যস্ত। এখন সরকারি অঙ্গুলিহেলনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শুধু নিজেই চুপ থাকেন না, পড়ুয়াদের কথা বলার অধিকারও কেড়ে নেন। সরকারের সমালোচনাকে সুকৌশলে রূপ দেন দেশদ্রোহিতার। পড়ুয়াদের সরকারি বৃত্তি বন্ধ করে ফি বৃদ্ধির প্রস্তাবকে তুলনা করে যুদ্ধ জেতার সামরিক কৌশলের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি রক্ষার্থে পুলিশি প্রবেশ দেশ জুড়ে নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। স্বাভাবিক হয় গবেষণা ভুলে নিরাপত্তার পিছনে বরাদ্দ বাড়ানো।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy