মোকাবিলা? ধর্মঘটের ডাক নিয়ে রাজপথের মিছিল, কলকাতা, ২৩ নভেম্বর। ছবি: রণজিৎ নন্দী
ধর্মঘটে এ-বার সাড়া মিলবে, সেটা অজানা ছিল না। তবু, সাড়া মিলেছে, এটা ভরসা দেয়। বাড়তি ভরসা দেয় তরুণদের ভূমিকা। কিন্তু এতেই ধর্মঘট সফল বলে সন্তুষ্ট হওয়ার হেতু নেই। যে দাবিদাওয়া নিয়ে ধর্মঘট ডাকা, সে-সব আদায়ের সম্ভাবনা কতখানি? বিশেষ করে রাষ্ট্রশক্তির ঔদ্ধত্য যখন অপরিমেয়? ধর্মঘটকে সংগ্রামের শেষ হাতিয়ার বলা হয়ে থাকে। মুশকিল হল, ব্রহ্মাস্ত্রের দায় বড় বেশি— তাকে যুদ্ধ জিততেই হবে, না হলে ব্যর্থতা মেনে নিতে হবে।
তবে, ধর্মঘটকে শেষ হাতিয়ার বলে গণ্য না করে যদি তাকে চেতনায় শান দেওয়ার প্রকরণ মনে করি, তা হলে সাফল্যের হিসেবটা পাল্টে যেতে পারে। ধর্মঘটের প্রস্তুতি, তার উদ্যাপন এবং পরবর্তী কর্মকাণ্ড, সবটাই তো জনসংযোগ ও সংগঠনের পথ, যে পথে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা বহু মানুষের কাছে নিজেদের কথা পৌঁছে দিতে পারেন, বহু মানুষের কথা শুনতে পারেন, সেই কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে জনচেতনা সমৃদ্ধ হতে পারে, সমৃদ্ধ হতে পারে নেতা এবং কর্মীদের চেতনাও। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তার কিছু কিছু নজির আমরা দেখেছি— পত্রপত্রিকায়, রাস্তাঘাটে, সমাজমাধ্যমে ধর্মঘটের দাবিদাওয়া নিয়ে, এবং তার সঙ্গে জড়িত অন্য কিছু কিছু দাবি নিয়েও, প্রচার চলেছে। জনসংযোগের ব্যাপ্তি ও গভীরতা যথেষ্ট ছিল, এমনটা বলা চলে না। মানুষের কথা শোনার অভ্যেস আমাদের রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের ধাতে নেই, তাই সে-কথা আপাতত থাকুক, কিন্তু অন্তত কেন এই ধর্মঘট সে-বিষয়ে মানুষকে আরও অনেক বেশি ওয়াকিবহাল করার সুযোগ ছিল। অতিমারির কথা মনে রেখেও বলা যায়, সেই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। কিন্তু যতটা হয়েছে, তার দাম কম নয়। ধর্মঘটের নানান দাবি বহু মানুষের গোচরে এসেছে, রাষ্ট্রের জনবিরোধী অভিযানের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কথা শোনা এবং কথা বলার মধ্যে দিয়েই আমরা সচেতন হই। সেটাই মূল্যবান।
এই মুহূর্তের পশ্চিমবঙ্গে মহামূল্যবান। রাজ্যে নির্বাচন আসছে। সেই নির্বাচন কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, রীতিমতো জটিল। জটিলতা আগেও ছিল, কিন্তু নানা কারণে এ-বারের পরিস্থিতি প্রায় অভূতপূর্ব। ইতিমধ্যেই রাজনীতির দরিয়ায় ভোটতরঙ্গ প্রকট হয়ে উঠেছে, রকমারি চোরা ঘূর্ণির উৎপাত চলছে, ছোটখাটো সুনামির আশঙ্কাও প্রকট, অনর্থক জল ঘোলা করার পরিচিত কুনাট্যও চলছে। এ-সব অপ্রত্যাশিত নয়, সমুদ্র মন্থনে কিছু গরল ওঠে বইকি। কিন্তু তার পাশাপাশি উঠে এসেছে একটি মহার্ঘ সত্য। সেটা এই যে, নির্বাচনী রাজনীতিকে অনায়াসে চোরাবালি গ্রাস করতে পারে। সেই সম্ভাবনা প্রতিরোধ করতে হলে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার মৌলিক প্রয়োজনগুলি মেটানোর দাবিকেই সেই রাজনীতির ধ্যানজ্ঞান করে তোলা দরকার, সেই দাবি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করাই এখন প্রথম ও প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি। শ্রমজীবী মানে কেবল প্রচলিত অর্থে শ্রমিক নয়, জীবিকার জন্য নিজের শ্রমশক্তিই যাঁর সম্বল, তিনিই শ্রমজীবী। এই অর্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই যে শ্রমজীবী, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মনে হতেই পারে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রয়োজন মেটানোর প্রশ্নে নির্বাচন হওয়া উচিত, এ তো স্বতঃসিদ্ধ, এবং এটাও অজানা কিছু নয় যে, কার্যক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়েই তা হয় না, অন্য নানা বিষয় নিয়ে লড়াই করাই বড় হয়ে দাঁড়ায় আর তার ফলে সাধারণ মানুষের স্বার্থটাই মার খায়— এ-সব আর আলাদা করে বলবার কী আছে? প্রশ্নটা অন্যায্য নয়। কিন্তু খুব চেনা কথাও কোনও কোনও সময় কান কামড়ে বলার দরকার হয়। এখন তেমনই একটা সময়। তার কারণ, পশ্চিমবঙ্গে এখন জল ঘোলা করার তৎপরতা অস্বাভাবিক বেশি, এবং ভোট যত এগিয়ে আসবে, সেই তৎপরতা ততই বাড়বে।
সাম্প্রদায়িকতা এই প্রকল্পে একটি বড় হাতিয়ার। এ-রাজ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিলক্ষণ সুযোগ আছে। গত এক দশকে সেই সুযোগ আরও বেড়েছে। সুযোগসন্ধানীরা এই মরসুমে ভেদবুদ্ধি ও বিদ্বেষের আগুনে ইন্ধন দেওয়ার জন্য সর্বপ্রকার প্রস্তুতি চালাবেনই। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি কালক্রমে অনেক জটিল এবং কুটিল হয়েছে। সরাসরি দাঙ্গা বাধানোর প্রয়োজন আগের তুলনায় কমেছে, বিদ্বেষের মন্ত্র এখন অনেক সূক্ষ্ম ভাবে কাজ করে। যেমন, দুই বিপরীত শিবিরের সাম্প্রদায়িকতা কী ভাবে একে অপরের শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে, বিহার নির্বাচনের শেষ পর্বে তা দেখা গেছে, পশ্চিমবঙ্গেও তেমন চেষ্টা হতেই পারে।
অন্য নানা অস্ত্রও নিশ্চয় শানানো হচ্ছে। যেমন, টাকা। সেই টাকার মাত্রা কোথায় পৌঁছতে পারে, আধুনিক ভারত তা বিলক্ষণ জানে। পশ্চিমবঙ্গে এই অস্ত্রটির কার্যকারিতা কিঞ্চিৎ বেশি হওয়াই সম্ভব। তার কারণ, এ-রাজ্যের অর্থনীতি অন্য অনেক রাজ্যের চেয়ে নিচু পর্দায় বাঁধা, আর দুর্নীতির অঙ্কও তো অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না, তাই দল বদলের বাজারটিও তুলনায় সস্তা হওয়াই স্বাভাবিক। এমন রাজ্যে ভাল ‘রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট’ পাবেন বলে পয়সাওয়ালা বহিরাগত ড্যাঞ্চিবাবুরা যদি কব্জি ডুবিয়ে সওদা করতে নামেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছুমাত্র কারণ নেই।
এবং প্রচার। এই বস্তুটি এখন আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতে রেখেছে। বিশেষত বিদ্বেষের গরল ছড়িয়ে দিতে তার কোনও জুড়ি নেই। পশ্চিমবঙ্গে বিদ্বেষী প্রচারের বিধ্বংসী নমুনা আগেও দেখা গেছে, এ-বারেও রেহাই মেলার কোনও ভরসা থাকতে পারে না। এবং এ ক্ষেত্রেও অনুমান করা যায়, প্রকরণগুলি পাল্টাবে, সূক্ষ্মতর হবে। ডাহা ‘ফেক নিউজ়’ ইতিমধ্যেই কিছুটা কমছে, সম্ভবত অতিব্যবহারে তার ধার অনেকখানি পড়ে গেছে। কিন্তু প্রচারযন্ত্র হয়তো অন্য নানা খেলা দেখাবে। তার কিছু সঙ্কেত ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে— প্রতিপক্ষের একটা অংশকে হাত করে তাদের মাধ্যমে নানা ধরনের বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার তন্ত্রসাধনা চলছে পুরো দমে।
এই অস্ত্রগুলি কয়েকটি উদাহরণমাত্র। এবং, বলা বাহুল্য, এগুলি বিচ্ছিন্ন প্রকরণ নয়, বরং একে অন্যের পরম সহযোগী। এই সমবেত আক্রমণের একটা বড় লক্ষ্য, এক অর্থে প্রধান লক্ষ্য— মানুষের চিন্তাকে তার জীবন ও জীবিকার সমস্যা থেকে বিচলিত করা, যাতে তাকে নিজেদের ছাতার তলায় এনে ক্ষমতা উৎপাদনের কাঁচামাল করে তোলা যায়। শ্রমজীবী মানুষকে বিভাজিত করে ভোটের ফসল কুড়োনোর তৎপরতা একেবারেই অচেনা নয়। আগামী কয়েক মাসে যে রাজ্যটিতে এই তৎপরতা তুঙ্গে উঠবে, তার নাম পশ্চিমবঙ্গ। এই বিপদ এড়ানোর কোনও উপায় নেই।
তাকে মোকাবিলা করার উপায় আছে। সেই উপায়ের নাম, এক কথায়, জনস্বার্থের রাজনীতি। ধর্মঘটের প্রস্তুতি-প্রচারে যার কিছুটা অনুশীলন দেখা গেল। ন্যূনতম আয়, কর্মসংস্থান, খাদ্য সরবরাহ, পেনশন, শ্রম আইন, কৃষি আইন, মেয়েদের নিরাপত্তা, ইত্যাদি যে সমস্ত দাবিতে এই ধর্মঘটের আহ্বান, সেগুলির সঙ্গে বিভিন্ন শ্রমজীবী বর্গের স্বার্থ জড়িত। স্পষ্টতই, এই তালিকায় দাবিপত্র শেষ হয় না, বরং শুরু হয়। নির্বাচনী রাজনীতির বৃহত্তর পরিসরে আরও অনেক বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, এক দিকে পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির উপর জোর দেওয়া দরকার, অন্য দিকে এনআরইজিএ বা অনুরূপ আপৎকালীন প্রকল্পের গণ্ডি পেরিয়ে যথার্থ উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রশ্নটিকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দিতে হবে। এ-রকম আরও বহু প্রশ্ন আছে, যা আক্ষরিক অর্থেই সাধারণ মানুষের জীবনমরণের প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলোই যদি নির্বাচনী রাজনীতির প্রধান বিষয় না হয়, তা হলে কিসের নির্বাচন?
কথাটা বলা সহজ, করা সহজ নয়। নির্বাচনী অ্যাজেন্ডা ছিনতাই হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তো আছেই, তার পাশাপাশি এক বড় সমস্যার কারণ হল পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতির জরা এবং ব্যাধি। এ-রাজ্যে সত্যিকারের জনস্বার্থের রাজনীতি দীর্ঘদিন— বামফ্রন্ট জমানার মধ্যপর্ব থেকেই— নিতান্ত দুর্বল, নিস্তেজ। শাসক দল পাল্টানোর পরেও সেই ঐতিহ্য বদলায়নি। নির্বাচনের হাওয়া কেবলই কুৎসিত গালিগালাজ, অসার দলবাজি এবং দখলদারির হিংস্রতায় বিষাক্ত হয়েছে। এ-বার, অর্থনীতির সঙ্কট অস্বাভাবিক বলেই, হাওয়া বদলানোর সুযোগ এসেছে। ধর্মঘট আপাতত শেষ। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতির কিছুটা অনুশীলন ঘটল, তাকে অনেক বেশি জোরদার করে তোলা দরকার। এখনই। যদি তা করা যায়, তবে হয়তো ‘ধর্মঘট সফল করুন’ আহ্বানটিও ক্রমে সার্থক হয়ে উঠতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy