যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভিতরে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে তা ইতিমধ্যেই সংবাদ হিসেবে পুরনো। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় ও অভিঘাতে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যার বৃহত্তর প্রাসঙ্গিকতা আছে। ক্যাম্পাসের ঘটনাবলি অনেকটাই টিভির পর্দায় সরাসরি দেখা গিয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়া বা সমাজমাধ্যমেও সেই ঘটনার নানা ছবি, ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেই ঘটনার অভিঘাত ক্যাম্পাসের মধ্যেই আটকে থাকেনি। তা যেমন বাইরে রাস্তায় মিছিলের চেহারা নিয়েছে, তেমনই ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমের নানা মঞ্চে। সেই সমাজমাধ্যমেই যাদবপুরের ঘটনার জেরে এমন অনেক কিছু হয়েছে, হয়ে চলেছে, যা হালের রাজনীতি-সমাজের বদলে যেতে থাকা বাস্তবতার চেহারাটা আমাদের সামনে তুলে ধরছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার পরেই লাগোয়া যাদবপুর এইটবি বাসস্ট্যান্ডে দুই ছাত্রীকে ঘিরে ধরে নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে। তাঁদের এক জন বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী। তাঁর অভিযোগ, ‘তোরা মন্ত্রীকে আটকে রেখেছিস’ বলে তাঁদের কান ধরে ক্ষমা চাইতে বলা হয় ও ভিডিয়ো তোলা হয়। তিনি জানিয়েছেন, ‘‘মহিলা ও পুরুষদের একটি দল মিলে ঘিরে ধরে ‘ক্ষমা চা’ বলে আমাদের ফোন কেড়ে হেনস্থা করে। জয় শ্রীরাম স্লোগান দিচ্ছিল ওরা। যে হেতু আমাদের ছবি তুলে ভিডিয়ো করেছে ওরা, তাই নিরাপত্তার কথা ভেবে যাদবপুর থানায় পুলিশকে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছি।’’
আক্রমণ। আক্রান্তের অবস্থা। ভিডিয়োয় সেই অবস্থার দৃশ্য-শ্রাব্য ধারাবিবরণী। এই তিনের মিশেল হালের রাজনীতিতে ক্ষমতা প্রদর্শনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। কাউকে লক্ষ্য করে তার উপর আঘাত হানলেই কেবল ক্ষমতা দেখানো সম্পূর্ণ হচ্ছে না, সেই আঘাত হানার পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রক্রিয়া ভিডিয়োতে লিপিবদ্ধ করে ছড়িয়ে দেওয়া হলে তবেই ক্ষমতার যথাযথ প্রকাশ হচ্ছে বলে মনে করছে আক্রমণকারীরা। ক্ষমতা প্রদর্শনের এমন কৌশল আমরা দেখেছি গত কয়েক বছরে একাধিক গণপ্রহারে খুনের ক্ষেত্রে। মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ার আগে আক্রান্তের আর্তনাদে শিউরে উঠেছি আমরা।
আসলে এক জনকে আক্রমণই শুধু নয়, একশো জনকে শিউরে দেওয়াই আক্রমণকারীদের আসল উদ্দেশ্য। আর তা সফল করতেই আক্রমণের সম্প্রচারের আয়োজন, যাতে আক্রান্তের অসহায়তার দৃশ্য অনেক প্রতিবাদী ইচ্ছের গলা টিপে ধরে। সেই আয়োজনের প্রকরণ হল ইন্টারনেট, বিশেষত সমাজমাধ্যম। এই সম্প্রচারের নিদর্শন সম্প্রতি বহু বার দেখেছি। সমাজমাধ্যমে মন্তব্যের জন্য নানা জায়গায় অনেককে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনের পথে না গিয়ে বরং তাঁদের বাড়ি গিয়ে হামলা, প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ানোর ঘটনা ঘটেছে। এবং সেই গণনিগ্রহের ঘটনা ভিডিয়ো করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সমাজমাধ্যমে।
এই ভার্চুয়াল খাপ-পঞ্চায়েতে আক্রমণকারীদের দু’টি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। তা হল অসম্ভব দ্রুততা এবং অদ্ভুত ঐক্য। উল্টো স্বরে কোনও কিছু শুনলেই নিমেষে চিহ্নিত করা হয় তাঁকে। অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় জোগাড় হয়ে যায় তাঁর বাড়ি, পরিবারের ঠিকানা। শুরু হয় সংগঠিত আক্রমণ। যাদবপুর পর্বেও ঐক্যবদ্ধ নেট-নিগ্রহের অভিযোগ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের এক ছাত্রী বলেন, ইউনিয়ন রুম ভাঙচুরের পরে ফেসবুকে প্রতিবাদ জানিয়েই তিনি বিজেপি সমর্থক পরিচিতির বহু প্রোফাইল থেকে ক্রমাগত হুমকি পেতে থাকেন। আক্রমণ এতই ক্ষিপ্র, ঠিক-ভুল বিচারের সময় থাকে না আক্রমণকারীদের। ওই ছাত্রীকেই বিক্ষোভরত অন্য ছাত্রী ঠাহরে নিয়ে চলে কদর্য হুমকি।
এই ক্ষিপ্র, ঐক্যবদ্ধ ভার্চুয়াল গণনিগ্রহের বিপ্রতীপে কি প্রতিবাদ নেই? রয়েছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অনেকেই এমন নোংরামির প্রতিবাদ করেছেন। সমাজমাধ্যমে সম্মানিত শিল্পীর উদ্দেশে কদর্য উক্তি করার প্রতিবাদ হয়েছে রাস্তায় নেমেও। তবে এই পরিস্থিতিতে কেবল রাস্তায় নেমে প্রতিবাদই যথেষ্ট নয়। ভার্চুয়াল প্রতিবাদের আরও ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। একাধিক রাজনৈতিক দল অবশ্য এমন নেট-নিগ্রহের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিবৃতি দেয়। কিন্তু ভার্চুয়াল দুনিয়ায় তাদের কার্যকলাপের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দুষ্কৃতীরা যত সহজে সমাজমাধ্যম থেকে কাউকে খুঁজে ধাওয়া করে তাঁকে বাস্তবের মাটিতে নিগ্রহ করে ও নিগ্রহের ছবি আবার সমাজমাধ্যমে দেয়, আক্রান্তের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সেই তৎপরতা কোনও দলেরই দেখা যায় না। কিন্তু ‘আমরা ঘটনার নিন্দা করছি’ গোছের বিবৃতি দিয়েই এ ক্ষেত্রে কাজ শেষ হয়ে যায় না। প্রয়োজন আক্রান্তের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করা। ভিডিয়ো তুলে তা পাল্টা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়াও। কারণ আক্রান্ত যে একা নন, সেই সত্যটা জনসমক্ষে আনাটা পরবর্তী হামলা ঠেকানোর জন্য জরুরি।
আসলে স্বাধীন স্বরকে দমিয়ে রাখতে গেলে প্রয়োজন ভয়ের পরিবেশ। ভয় দেখাতে গেলে ভয়ের ধারণা তৈরি করতে হয়। সেই ধারণা তৈরির পিছনে কত জন থাকে সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল সেই ধারণাটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য ভাবে নির্মিত হচ্ছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ— সেই নির্মিত ধারণা কতটা সফল ভাবে ভয়ের চেহারাটা ফুটিয়ে তুলতে পারছে। ভয়ের সেই ধারণার নির্মাণ যত সফল হবে ততই সহজ হবে ভয় দেখানো। তাই এক জনকে খুঁজে বার করে ঘিরে ধরে নিগ্রহ করার পিছনে যত জন থাকে, তার চেয়ে ঘটনার প্রতিবাদকারীর সংখ্যা হয়তো অনেক বেশি হয়। কিন্তু সেই প্রতিবাদ সঙ্ঘবদ্ধ রূপ নিতে পারে না। তাই জমাটও বাঁধে না। অন্য দিকে হামলাকারীরা যে পদ্ধতিতে নিগ্রহে নামে তাতে মনে হয় বিশাল সংখ্যক দুষ্কৃতী দল বেঁধে আক্রমণ করেছে। তার একটা বড় কারণ এই বহুমুখী অনলাইন আক্রমণের বেশির ভাগ মুখই আসল নয়। অধিকাংশই, অনেক ক্ষেত্রে সবগুলোই, ভুয়ো। তাই এর পিছনে পাঁচ জন থাকলেও তাদের পক্ষে পাঁচশো জনের ‘রূপ ধরে’ নেট-নিগ্রহ চালানো অসম্ভব নয়।
এই আক্রমণের উদ্দেশ্য: বিরোধী স্বরের, স্বাধীন মতামতের টুঁটি টিপে ধরা। তাই তার বিরুদ্ধে লড়াইটাও কঠিন। সেই কঠিন লড়াইয়ের চক্রব্যূহেই অনেক সময় দিশাহারা হয়ে পড়ে গণতান্ত্রিক মত। ঘিরে ধরে আসা নিগ্রহকে জুঝতে গিয়ে অনেক সময় হাল ছেড়ে সমাজমাধ্যমই ছেড়ে দিতে হয় আক্রান্তকে। আর তাতেই উদ্দেশ্য সফল হয় আক্রমণকারীদের। পুলিশও মানছে, ভুয়ো পরিচয় এমন অপরাধ ঠেকানোর পথে একটা বড় বাধা। পুলিশ জানাচ্ছে, এই সব ক্ষেত্রে মামলা রুজু করে তদন্ত হয়, তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে চার্জশিটও দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে যে মামলার অগ্রগতি তেমন হয় না, তাও মানছে পুলিশের একাধিক সূত্র। পুলিশ জানাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই ভুয়ো পরিচয়ে প্রোফাইল খুলে এই ধরনের অপরাধ করা হয়। তাই ইন্টারনেট প্রোটোকল (আইপি) অ্যাড্রেস খুঁজে বার করে অপরাধীকে পেতে সময় লাগে। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগকারিণীরা বার বার আদালতে যেতে অস্বস্তি বোধ করেন বলেও তদন্ত ব্যাহত হয়।
এই অস্বস্তি ঠেকাতে সমাজমাধ্যমে গণনিগ্রহের শিকার হওয়া আক্রান্তদের আশ্বাস দেওয়া, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো অত্যন্ত প্রয়োজন। দরকার সেই পাশে দাঁড়ানোর সম্প্রচারও। আর সে জন্য প্রয়োজন ঐক্যের। রাজনীতিক ও তাত্ত্বিক এডমান্ড বার্ক-এর উক্তি স্মরণ করে বলা যায়, যখন খারাপ মানুষেরা একজোট হয়, তখন ভালদের কর্তব্য জোট বাঁধা। এক না হলে এক এক করে তাঁদের পতন হয়। এই পতন ঠেকাতেই ভুয়ো, মুখোশপরা, ভাড়াটে সেনাদের বিরুদ্ধে এক হতে হবে স্বাধীনতাপ্রিয়, গণতন্ত্রপ্রিয় নাগরিকদের।
ভার্চুয়াল জগতেও জমাট বাঁধা দরকার সেই ঐক্যের। যাতে কাউকে ঘিরে ধরে নিগ্রহ শুরু হলে তাদেরও ঘিরে ধরে প্রতিবাদ করা যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেই প্রতিবাদের ভাষা যেন দুষ্কৃতীদের মতো না হয়। হুমকির পাল্টা হুমকি নয়, ভয় না পেয়ে, হাল না ছেড়ে দল বেঁধে যুক্তি দিয়ে প্রশ্ন করা যায় একসঙ্গে। বরং আক্রান্তদের দিতে হবে আশ্বাস। সমাজমাধ্যম থেকে খুঁজে কারও ওপর হামলা হলে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। প্রয়োজনে ভিডিয়ো বার্তা দিয়ে আশ্বস্ত করা যায় স্বাধীন মতকে, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষদের। যে সব প্রোফাইল থেকে আক্রমণ হচ্ছে সেগুলিকে চিহ্নিত করে পুলিশকে জানানোর দায়িত্বও নিতে হবে অনেককে। ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ ছাড়া এই আক্রমণ ঠেকানো দুরূহ।
প্রবীণ রাজনীতিকরা মাঠঘাটের রাজনীতিতে ওয়াকিবহাল। কিন্তু এখন কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাজনীতির লড়াইয়ের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট। আর, কমবয়সিরা, বিশেষত ছাত্রসমাজ এই ভার্চুয়াল বাস্তবতার সঙ্গে তুলনায় অনেক বেশি সড়গড়। তার কারণ, তাঁদের যাপনের অনেকটা জুড়েই রয়েছে ভার্চুয়াল জীবন। তাই স্বাধীন স্বর, গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে তাঁদেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy