ছবি: সংগৃহীত
অভাবের দোসর হয়েছে উদ্বেগ আর আতঙ্ক! কেরল, রাজস্থান, কাশ্মীর, দিল্লি— তালিকাটা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে।
বানে ভাসল কেরল। চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া ভুলল মুর্শিদাবাদ, মালদহ-সহ রাজ্যের বহু জেলা। রাজস্থানে নৃশংস ভাবে খুন হলেন মালদহের কালিয়াচকের শ্রমিক আফরাজুল হক। চমকে উঠল এ রাজ্যের প্রান্তিক জেলা। কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদীরা গুলি চালাল। কোল খালি হল এ রাজ্যের বেশ ক’জন মায়ের। সেই তালিকায় শেষ সংযোজন দিল্লি।
মুর্শিদাবাদের নওদার ১১ জন যুবক কর্মসূত্রেই ছিলেন দিল্লির জাফরাবাদ লাগোয়া মৌজপুর-নুরিনা-ঘোন্ডাচক এলাকায়। ওঁরা কেউ তিন বছর কেউ পাঁচ বছর ধরে সেখানে একটি পাখার কারখানায় কাজ করছিলেন। বাড়ির লোকজনও এত দিন নিশ্চিন্তেই ছিলেন। কিন্তু দিল্লিতে আগুন জ্বলতেই কেঁপে ওঠে ওঁদের বুক। ফোন করেও কারও সাড়া না মেলায় কান্নায় ভেঙে পড়েন ওঁরা। টিভির পর্দা জুড়ে শুধুই হিংসা, গুলি, রক্ত আর মৃত্যু।
মঙ্গলবার কিছুক্ষণের জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হতেই ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে মহম্মদ কালামের আর্তি, ‘আমরা মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা... আমরা ১১ জন দিল্লির মৌজপুর এলাকায় আটকে আছি... গত দু’দিন কিছু না খেয়ে আছি... বাইরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই... আমার যোগাযোগ নম্বর...।’ মুহূর্তে সেই বার্তা ছড়িয়ে পড়ল সমাজ-মাধ্যমে। বাড়ির লোকজনও দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন ব্লক অফিস ও স্থানীয় পঞ্চায়েতে।
মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসন ও বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী আশ্বাস দিয়েছিলেন, ওই এগারো জন শ্রমিককে উদ্ধার করে নিয়ে আসবেন তাঁরা। পারিবারিক সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার তাঁরা ট্রেনে বাড়িও ফিরছেন। অধীরবাবুও এ দিন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘...আটকে পড়া ১১ জন নওদার মানুষকে উদ্ধার করে গত রাতে দিল্লি-কলকাতা ট্রেনে উঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ... আতঙ্কিত পরিবারের সকলকে বলব, আপনাদের লোকেরা বাড়ি ফিরছে, চিন্তা নেই।’
কিন্তু সত্যিই কি চিন্তা নেই? এই এগারো জনের বাড়ি ফেরার কথা ছিল ইদের সময়। ফিরতে হল তার আগেই। দিল্লিতে থাকার জো নেই। বাড়িও ফিরেও যে তাঁরা কী করবেন তা-ও জানা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, দিল্লির পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাঁরা যে সেখানে গিয়ে ফের সেই কাজ পাবেন তারও নিশ্চয়তা নেই।
গাঁয়ে কাজ নেই। ঘরে টনটনে অভাব। তাই সরকার কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের উপরে ভরসা না করে শ্রমিকেরা নিজেরাই খুঁজে নিয়েছে মুক্তির পথ। কেরল, কাশ্মীর, মুম্বই, দিল্লির মতো রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এ রাজ্যের বহু শ্রমিক। সেখানে কষ্ট আছে। কিন্তু কাজও আছে। আর আছে ভাল রোজগার।
সেই রোজগারের টাকায় সংসারে শ্রী ফেরে। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা হয়। বোনের বিয়ে হয়। এমনকি মাটির দেওয়াল ভেঙে শুরু হয় পাকা গাঁথনিও। ‘ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাওয়া’ দেখে পাশের বাড়ির ছেলেও এক দিন অনুরোধ করে বসে, ‘‘ও চাচা, আমাকেও নিয়ে যাবে তোমাদের সঙ্গে? এখানে একেবারেই ইনকাম-টিনকাম নেই!’’ এ ভাবেই শুরু হয় ‘বিদেশ যাত্রা’। কিন্তু একের পর এক ঘটনা এবং দুর্ঘটনায় সেই যাত্রা ক্রমশ কণ্টকময় হয়ে উঠছে।
ঘরের ছেলে ঘরে থেকেই রোজগার করবে, আর তাতেই দু’বেলা ডিমটা-দুধটা-মাছটা হবে। এমন স্বপ্ন নেতারা দেখান বটে। কিন্তু বাস্তবে ছবিটা অন্য। ২০১১ সালের জনগণনার হিসেব অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৫ লক্ষ ৮০ হাজার শ্রমিক গিয়েছেন ভিনরাজ্যে কাজ করতে। কাশ্মীর থেকে কেরল, গুজরাত থেকে অসম, সর্বত্র আছেন বাঙালি শ্রমিক। হাতে টাকা আসছে, বিপদও আসছে। কেরলের বন্যা, রাজস্থানের মুসলিম-বিদ্বেষ, কাশ্মীরে সন্ত্রাস থেকে মহারাষ্ট্র বা অসমে বাঙালি-বিরোধিতা, নানা কারণে বিপন্ন হচ্ছেন শ্রমিকেরা। কিন্তু বাইরে যাওয়ার প্রবণতা কি কমেছে? শ্রম দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, কমা তো দূরের কথা, সেই প্রবণতা বাড়ছে। কারণ, অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে দিনমজুরি, খেতমজুরির হার কম।
যেখানে আয় বেশি, সেখানে লোকজন যাবেন। এটাই দস্তুর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যাঁরা যাচ্ছেন তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন, কী কাজে যাচ্ছেন, কত দিনের জন্য যাচ্ছেন, সেখানে তাঁরা কতটা সুরক্ষিত সেই পরিসংখ্যান যে প্রশাসনের কাছে নেই। দিল্লিতে ছেলে আটকে পড়েছেন শুনে মহম্মদ কালামের বাবা ছুটেছিলেন স্থানীয় ব্লক ও পঞ্চায়েত অফিসে। কিন্তু ব্লক কিংবা পঞ্চায়েত প্রশাসন কি সত্যিই জানত, কাজের খোঁজে দিল্লি যাওয়া কালামের যাবতীয় তথ্য? শুধু কালাম কেন, ভিন্ রাজ্যে যাঁরা কাজে যান তাঁদের কোনও তথ্যই কি সরকারি ভাবে কোথাও
রাখা হয়? সেই তথ্য না রাখার খেসারত মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসন দিয়েছিল কেরলে বন্যার সময়। তার পরে জেলার কত লোক কেরলে কাজ করেন তার একটা তালিকা তৈরিও প্রাথমিক ভাবে শুরু হয়েছিল। ব্যস, ওই পর্যন্তই! কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদীদের হামলার পরেও নিহতেরা মুর্শিদাবাদের কোথাকার বাসিন্দা তা জানতে ঘুম ছুটেছিল প্রশাসনের। এ রাজ্যে ১৯৭৯ সালের ‘আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন’ চালু আছে আজও। কিন্তু সে আইনের তোয়াক্কা করেন না অনেকেই। তিন বছর আগে রাজস্থানে খুন হন মালদহের কালিয়াচকের আফরাজুল। তার পরে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গিরীশচন্দ্র গুপ্তের নেতৃত্বে কমিশন গঠিত হয়। কমিশন পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ‘ট্র্যাকিং পোর্টাল’ বা ‘স্মার্ট কার্ড’ তৈরির পরামর্শও দেয়। আজও সে সব কিছুই হয়নি। কবে হবে তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই।
তাই বলে কি বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে? উত্তরটা হচ্ছে— না। কেরল থেকে জল নামতেই ফের সেখানে পাড়ি দিয়েছেন এ রাজ্যের বহু শ্রমিক। যাঁরা সেই সময় ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘জান থাকতে আর কেরল নয়’, তাঁরাই ক’দিন পরে বলেছেন, ‘কেরল না গেলে খাব কী?’ কাশ্মীর থেকে যে শ্রমিকেরা (সরকারি হিসেব অনুযায়ী, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ও মালদহের মোট ১৩৩ জন) ফিরেছেন তাঁদেরও ‘সমর্থন প্রকল্প’ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু টাকা পাওয়ার পরে তাঁরাও প্রশ্ন তুলেছিলেন, এ টাকায় ক’দিন চলবে? সাগরদিঘি ব্লক প্রশাসন সম্প্রতি চারা পুঁতে আপেল চাষও শুরু করেছে। কিন্তু কাশ্মীর থেকে ফিরে আসা শ্রমিকেরাও বলছেন, ‘‘আপেল না হয় হল, কিন্তু কাশ্মীরে যে মজুরি আমরা পেতাম, এখানে কি আর সেই মজুরি পাব?’’ অতএব, ভয় কাটিয়ে ফের কাশ্মীরে যাওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছেন অনেকেই।
ফলে বাস্তব এটাই, যতদিন এ রাজ্যে কাজের মজুরি অন্য রাজ্যের মতো (একটা উদাহরণ— পশ্চিমবঙ্গে রাজমিস্ত্রির মজুরি ৪০০ টাকা, হেল্পারের ২৫০ টাকা। কেরলে রাজমিস্ত্রি পান ৯৫০ আর হেল্পার ৭৫০ টাকা) না হবে তত দিন শ্রমিকদের বাইরে যাওয়া বন্ধ হবে না।
এখন মাঝেমধ্যেই অশান্ত হয়ে উঠছে দেশের নানা প্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে সবার আগে এগিয়ে আসা উচিত স্থানীয় থানা, ব্লক কিংবা পঞ্চায়েত প্রশাসনের। শ্রমিকেরা কে, কোথায়, কী কাজে যাচ্ছেন তার বিশদ বিবরণ নথিভুক্ত করা জরুরি। না, কারও ব্যক্তি স্বাধীনতা বা মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ নয়, কোনও অঘটন ঘটলে যাতে সহজেই স্থানীয় প্রশাসন সেই শ্রমিক বা শ্রমিকদের ঠিকুজি-কুষ্ঠি সহজেই খুঁজে পেতে পারে।
হাজারও ব্যস্ততার মধ্যে শ্রমিক-সুরক্ষায় তথ্য-সংগ্রহের জন্য প্রশাসন এটুকু সময় নিশ্চয় বের করতে পারবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy