Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
যে কোনও সময়, কারণ না দেখিয়েই গ্রেফতারের ভয়, সাংবাদিকদেরও

কাশ্মীর তা হলে স্বাভাবিক?

পর্যটকরা কী দেখবেন, বলা মুশকিল। ভূস্বর্গের মহিমা কি লুকিয়ে থাকে শুধুই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে?

অবশেষে: ওষুধের দোকানে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ যেখানে ‘পরম প্রাপ্তি’। শ্রীনগর, ১৪ অক্টোবর। পিটিআই

অবশেষে: ওষুধের দোকানে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ যেখানে ‘পরম প্রাপ্তি’। শ্রীনগর, ১৪ অক্টোবর। পিটিআই

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

পারদ নামা শুরু হয়েছে কয়েক দিন ধরেই। শীত পড়ছে উপত্যকায়। বাড়ির বাইরের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। এত ঠান্ডাতেও বাড়ির মালিকের কণ্ঠের উত্তাপ এতটুকুও কমে না। ‘‘জানেন, কী ভাবে আছি? বাড়িও যে জেলখানা হয়ে যেতে পারে, কে জানত?’’

কেউ না। অন্তত ৫ অগস্টের আগে তো নয়ই। কেউই জানত না যে, গোটা কাশ্মীর উপত্যকাই কার্যত বন্দিশালা হয়ে যাবে! টেলিফোনের ও পার থেকে ভেসে আসছে, ‘‘আমি আমার ইমেল শেষ বার চেক করেছি গত ৪ অগস্ট। তার পর থেকে আর ইন্টারনেট নেই। অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি, কারণ ইন্টারনেট ছাড়া আমরা অসহায়। আমরা তো এখন মধ্যযুগে বাস করছি!’’ এ কথা বলছেন যিনি, তিনি এক জন সাংবাদিক। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দীর্ঘ দিন ধরে লেখালিখি করছেন। থাকেন শ্রীনগরে।

তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে গত আড়াই মাসেরও বেশি স্কুল যেতে পারেনি। স্কুল বন্ধ। বন্ধ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। বন্ধ বাজার-দোকান। খোলে শুধু সকালে, তা-ও বন্ধ হয়ে যায় দশটার মধ্যে। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন গাড়ি চলছে বটে, কিন্তু পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলে কার্যত কিছু নেই। এর আগেও কাশ্মীরে মোবাইল পরিষেবা আংশিক ভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে, স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট, কিন্তু ল্যান্ডলাইন পর্যন্ত নিশ্চুপ করিয়ে দেওয়া উপত্যকাতেও অভূতপূর্ব।

অথচ, কাশ্মীর ‘স্বাভাবিক’! এতটাই যে, সেখানকার দরজা পর্যটকদের জন্য খুলে দিয়েছে সরকার। সংবাদপত্রে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হয়েছে, কাশ্মীর ডাকছে। ভূস্বর্গে আপনারা স্বাগত! কাশ্মীরের সাংবাদিকরা বলছেন, যেখানে সংবাদমাধ্যমের ঘোরাফেরার উপরেই এত নিয়ন্ত্রণ, সেখানে পর্যটকেরা আসবেন কোন ভরসায়? আর এলেও তাঁরা যাবেন কোথায়? কী দেখবেন?

পর্যটকরা কী দেখবেন, বলা মুশকিল। ভূস্বর্গের মহিমা কি লুকিয়ে থাকে শুধুই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে? এক নিবিড় অবরোধের মুখে দাঁতে দাঁত চেপে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে যে বিপুল জনগোষ্ঠীকে, পর্যটকদের দৃষ্টি সে দিকে যাবে না তো? জনমানবহীন, প্রাণহীন ডাল লেক আর হাউজ়বোটে রাতযাপন, বর্ণহীন, নিষ্প্রাণ টিউলিপের বাগানে সেলফি: যথেষ্ট বিজ্ঞাপন হবে তো ‘স্বাভাবিক’ কাশ্মীরের?

আর সেই ‘স্বাভাবিক’ উপত্যকার আসল ছবি তুলে ধরতে যাঁরা জীবন বাজি রাখছেন, সেই সাংবাদিকরা? তাঁরাও তো এই উপত্যকার মানুষ, তাঁদেরও পরিবার-পরিজন রয়েছে। তাঁদেরও প্রতি দিনের এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে আরও পাঁচ জনের মতোই! কিন্তু তা নিয়ে কি তাঁরা ভাবিত?

আদৌ নয়। বরং তাঁরা অনেক বেশি চিন্তিত ইন্টারনেট সংযোগ না থাকা নিয়ে, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন থাকা নিয়ে। সাংবাদিকতার পেশায় যাঁরা আছেন, শুধু তাঁরাই উপলব্ধি করবেন, কোনওক্রমে ঘটনাস্থলে পৌঁছে খবর সংগ্রহ করেও তা দফতরে পৌঁছে না দিতে পারার যন্ত্রণা কতটা!

শ্রীনগর বিমানবন্দরে এখন এটি একটি পরিচিত দৃশ্য— পরিচিত বা স্বল্পপরিচিত যাত্রীদের হাতে পেন ড্রাইভ দিয়ে সেটি দিল্লি বা অন্যত্র তাঁদের সংশ্লিষ্ট দফতরে পৌঁছে দিতে অনুরোধ করছেন সাংবাদিকরা। কারণ, ‘জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে’ সাংবাদিকদের জন্যও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা দিতে রাজি নয় প্রশাসন। অবশ্য গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সরকার সাংবাদিকদের একেবারে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। শ্রীনগরের একটি হোটেলে ‘মিডিয়া ফেসিলিটেশন সেন্টার’ খোলা হয়েছে। সেখানে ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাঁরা ‘কপি’ পাঠাতে পারবেন। কিন্তু, সাংবাদিকদের কাজ কি তাতে মেটে? সংবাদপত্র দফতরে ইন্টারনেট না থাকলে বা সাংবাদিকদের বাড়িতে সেই সংযোগ না থাকলে কী ভাবে রোজের কাজ সামলাবেন তাঁরা? সাংবাদিকরা হাটের মাঝে বসে কাজ করলে তাঁদের উপর নজরদারির সুবিধা হয় বটে, কিন্তু তাতে গোপনীয়তার মালিকানা থাকে না! এই সেন্টার-এ যাঁরা কম্পিউটার ব্যবহার করেন তাঁদের নামধাম, যাঁদের মেল পাঠানো হচ্ছে তাঁদেরও সবিস্তার নামধাম খাতায় নথিবদ্ধ করা হয়।

কাশ্মীর ‘স্বাভাবিক’? তা-ই যদি হয়, তা হলে মোবাইল পরিষেবা এত দিন পরে চালু হয় কেন? সেটাও পোস্টপেড। মেনে নেওয়া যাক, নিরাপত্তার স্বার্থেই এই বাধানিষেধ, জঙ্গি কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের জন্যই এত নজরদারি। কিন্তু সাংবাদিকরা? তাঁরাও কি জঙ্গি? দেশদ্রোহী? তা না হলে জম্মু-কাশ্মীরে সাংবাদিকদের সঙ্গে এই ধরনের ব্যবহার করা যেতে পারে? কী ধরনের ব্যবহার?

এর বেশ কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন অনুরাধা ভাসিন জামওয়াল। অনুরাধা ‘কাশ্মীর টাইমস’-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক। উপত্যকায় মিডিয়ার কণ্ঠরোধের প্রতিবাদে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবনের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। অনুরাধা জানিয়েছেন, কয়েক দিন আগে একটি ওয়েব পোর্টালের সম্পাদক কাজি শিবলি-কে গ্রেফতার করা হয়। স্থানীয় একটি সংবাদপত্রের সাংবাদিক ইরফানকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কয়েক দিন পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কাশ্মীরের প্রখ্যাত সাংবাদিক-লেখক গওহর গিলানিকে দিল্লির ইন্দিরা গাঁধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে আটকে দেওয়া হয়। একটি প্রশিক্ষণের জন্য তিনি জার্মানি যাচ্ছিলেন। এরই পাশাপাশি, অন্তত তিন জন সাংবাদিককে তাঁদের সরকারি আবাসন ছাড়ার নোটিস দেওয়া হয়েছে।

কয়েক দিন আগে এক মহিলা সাংবাদিকের গাড়ি লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয় নিরাপত্তা বাহিনী, তাঁকে অকথ্য গালিগালাজ করা হয়। চিত্রসাংবাদিকদের অবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। মহরমের মিছিলের ছবি তোলার সময় নিরাপত্তা বাহিনী চার জন চিত্রসাংবাদিককে বেধড়ক মারধর করে। ছররা বন্দুকও (পেলেট গান) ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। ছররার ঘায়ে এক জন চিত্রসাংবাদিক জখম হন। অবশ্য, উপত্যকায় চিত্রসাংবাদিকরা অনেক দিন ধরেই নিরাপত্তা বাহিনীর ছররা বন্দুকের লক্ষ্য।

কাশ্মীরের জেলা সাংবাদিকদের অবস্থাও অত্যন্ত করুণ। প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যাঁরা খবর সংগ্রহ করে চলেছেন, তাঁরা জানেন না সে খবর কী ভাবে শ্রীনগরে পৌঁছবে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের দিন থেকে এখনও পর্যন্ত জেলা সাংবাদিকদের এই রোজের লড়াইয়ের খবর কি বাইরের পৃথিবী রাখে?

যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন, পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী জেলা সাংবাদিকদের পরিচয়পত্রকে আদৌ গুরুত্ব দেয় না। জেলা প্রশাসনের অফিসারেরা তাঁদের ফোন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরেন না।

এত দিন তাঁরা শ্রীনগরে তাঁদের প্রতিষ্ঠান বা সম্পাদকদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারেননি। আর জেলা শহর থেকে শ্রীনগরে গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য। ফলে যাঁরাই শ্রীনগর যান, জেলা সাংবাদিকরা তাঁদের হাতে পেন ড্রাইভ ধরিয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করেন। ওই পেন ড্রাইভেই তাঁরা তাঁদের রিপোর্ট ও ছবি পাঠান।

কাশ্মীরের জেলা সাংবাদিকেরা বস্তুত শঙ্কিত। যখন-তখন বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ভয়, জম্মু-কাশ্মীর জনসুরক্ষা আইনে যে কোনও সময় কোনও কারণ না দেখিয়ে গ্রেফতারের ভয়, গ্রেফতারির পরে বাড়ির লোককে না জানিয়েই রাজ্যের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার আতঙ্ক গ্রাস করে, এমনকি সাংবাদিকদেরও।

কয়েক দিন আগে নয়াদিল্লিতে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনাসভায় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদীরা কোনও কিছু করার পরেও সংবাদমাধ্যম যদি সেটা না দেখায় তা হলেই সন্ত্রাসবাদ ধ্বংস হয়ে যাবে।’’

ভূস্বর্গ ‘স্বাভাবিক’ রাখতে এর থেকে বড় দাওয়াই আর কী হতে পারে?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy