ফিদেল কাস্ত্রো।
এই ভাবেই তবে দুনিয়ার পরিসমাপ্তি হয়— মহাবিস্ফোরণ নহে, অস্ফুট কিছু গোঙানিমাত্র শোনা যায়।’ টি এস এলিয়টের পঙ্ক্তিকে বদলাইয়া লইয়া বলা চলে, গোঙানিও নহে, নিতান্ত নীরবেই শেষ হইয়া যায় আরও একটি অলীক খোয়াবের সফরনামা। চার দশকেরও বেশি পুরাতন সংবিধানের খোলনলচে বদলাইয়া ফেলিতেছে কিউবা। ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবা। সোভিয়েতের পতনের পর, দেং জ়িয়াও পিং-এর উত্থানের পর যাহা দুনিয়ার কমিউনিস্ট খোয়াবের শেষ রাজধানী ছিল। সংবিধান হইতে ‘কমিউনিস্ট সমাজ’ গড়িয়া তুলিবার উদ্দেশ্যটি বাদ পড়িতেছে। এবং, ফিরিয়া আসিতেছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার। ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকার দেশটির প্রধানতম আয়ুধটিকেই নিঃশব্দে বাতিল করিতে উদ্যত দেশের সদ্য-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াস-কানেল। ফিদেলের কনিষ্ঠ ভ্রাতা রাউল কাস্ত্রোকে সরাইয়া গত এপ্রিলে ক্ষমতায় আসিয়াছিলেন তিনি। অর্ধ শতকের কাস্ত্রো যুগ মুছিতে তিনি সময় লইলেন মাত্র তিন মাস।
ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরুদ্ধে বামপন্থী জেহাদটির বয়স যত, অগ্রগতির সহিত ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওতপ্রোত সম্পর্ক তাহার তুলনায় বহু প্রাচীন। কার্ল মার্ক্সের জন্মের প্রায় দেড় শতক পূর্বে জন লক তৎকালীন ব্রিটেন (যেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত ছিল) ও আমেরিকার (যেখানে সব সম্পত্তিই ছিল সর্বজনীন মালিকানাধীন, যাহাকে বলা হয় ‘কমনস’) প্রসঙ্গে লিখিয়াছিলেন, ব্রিটেনের এক জন সম্পত্তিহীন মজুরও আমেরিকার রাজা-বাদশাহদের তুলনায় ভাল খায়, ভাল পরে, ভাল থাকে, কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার আছে বলিয়াই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বেগ বাড়ে, তাহার সুফল পৌঁছায় সম্পত্তিহীন মানুষদের নিকটও। উদারবাদের দর্শন দাঁড়াইয়া আছে ব্যক্তিগত সম্পদের অধিকারের উপর। যত ক্ষণ না কেহ অন্যকে সেই অধিকার হইতে বঞ্চিত করিতেছে, তত ক্ষণ ব্যক্তিগত সম্পদের অধিকার প্রশ্নাতীত। মোহান্ধ বামপন্থী ভিন্ন সকলেই মানিবেন, গত দুই শতকে দুনিয়া যতখানি অগ্রসর হইয়াছে, তাহা শিল্পবিপ্লবের ঐতিহ্যবাহী ধনতন্ত্রের জোরে। তাহার মূলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার। কমিউনিস্ট দিবা স্বপ্ন এই অধিকারটিকেই কাড়িবার পক্ষে সওয়াল করিত।
সম্পদের অধিকারের সহিত বণ্টনের ন্যায্যতার কোনও বিরোধ নাই। বরং, সমাজকে যদি যথার্থ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চালনা করা যায়, অথবা বণ্টনের প্রশ্নের কেন্দ্রে মানুষের সক্ষমতাবৃদ্ধিকে লইয়া আসা যায়, তবে সাযুজ্যই আছে। কমিউনিস্টরা এই সত্য বুঝিতে চাহেন নাই। তাঁহারা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি লইয়া পরিহাস করিয়াছেন। জন রলস-এর দর্শনকে প্রতিক্রিয়াশীল বলিয়া নাক সিঁটকাইয়াছেন। অমর্ত্য সেনকেও এই সে দিন অবধি ‘অপর’ ঠাহরাইয়াছেন। কিন্তু, কী আশ্চর্য, এই পথগুলিই ন্যায্যতর সমাজের দিকে যায়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির জোরে কেহ যদি উপার্জন করিতে পারেন, আর সেই উপার্জনের ব্যবহার যদি সমাজের অনগ্রসর অংশটির উন্নতির কাজে ব্যবহার করা চলে, তাহা অপেক্ষা গ্রহণযোগ্য আর কী? আশার কথা, চেতনা ক্রমে আসিতেছে। কিউবাও যদি কমিউনিজ়মের নির্মোকটিকে ত্যাগ করিতে পারে, অন্যদেরও জ্ঞানচক্ষু খুলিবে, আশা করা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy