অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো। ছবি: এএফপি
অনেক বিবর্তনের পথ পেরিয়ে এসেছে উন্নয়নের অর্থনীতি। উন্নয়নের অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয় আঠারো শতকের ‘বাণিজ্যবাদ তত্ত্বটি’ দিয়ে। ‘বাণিজ্যবাদ’-এর মূল বিষয় ছিল দেশের বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের পথ মসৃণ করতে হবে এবং তা করা সম্ভব রফতানি বাড়িয়ে ও আমদানি কমিয়ে। সুতরাং, বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত বাড়ানোর জন্য নানা রকমের সংরক্ষণের পদ্ধতি, যেমন শুল্ক প্রাচীর-এর নীতি অবলম্বন করা হয়েছিল। আর এই বাণিজ্যবাদের তত্ত্ব ধরেই উঠে এসেছিল ঔপনিবেশিকবাদ। ক্রমে এই ঔপনিবেশিকবাদের শিকড় যখন জাঁকিয়ে বসে তখন আমরা সাম্রাজ্যবাদের রূপটি দেখতে পাই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আধুনিক উন্নয়নের অর্থনীতি যাত্রা শুরু হয়। অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ে আধুনিক উন্নয়নের অর্থনীতির প্রথম তত্ত্ব, ওয়াট হুইটম্যান রস্টো-র ‘বৃদ্ধির পর্যায়’-এর (stages of growth) কথা আমরা উল্লেখ পাই। তার পরে একে একে ‘সাম্য ও অসাম্য বৃদ্ধিতত্ত্ব’ (balanced and unbalanced growth theory) ও ‘নির্ভরতা তত্ত্ব’-এর (dependency theories) আবির্ভাব হয়। এর পরে আরও অনেক তত্ত্ব ও গবেষণা পেরিয়ে এখন উন্নয়নের অর্থনীতি বিবর্তনের এক নতুন ধাপের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নতুন দিগন্তের নাম ‘পরীক্ষামূলক অর্থনীতি’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই পরীক্ষামূলক অর্থনীতির পোশাকি ভাষা ‘র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল্ড ট্রায়াল’-এর (আরসিটি) কথা এখন সর্বত্র শোনা যাচ্ছে। সৌজন্যে এ বারের অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী ত্রয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্থার দুফলো ও মাইকেল ক্রেমার।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষণায় এই আরসিটি-র সফল প্রয়োগ হয়ে থাকে। বিশেষত চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন ওষুধের প্রভাব নির্ণয় হয়ে থাকে এই পদ্ধতির দ্বারা। একটু বিস্তৃত করে বলতে গেলে এই আরসিটি পদ্ধতির দু’টি মূল স্তম্ভ আছে। প্রথম স্তম্ভ হচ্ছে ‘ট্রিটমেন্ট গ্রুপ’ যা বিচার্য গবেষণার স্বপক্ষে রয়েছে বা অভ্যন্তরীণ। অন্য দিকে, দ্বিতীয় স্তম্ভটি হচ্ছে ‘কন্ট্রোল গ্রুপ’ যা কিনা উক্ত গবেষণার সুবিধাভোগের বাইরে। কোন নতুন কিছু প্রয়োগের ফলে ‘ট্রিটমেন্ট গ্রুপ’-এর অবস্থায় যদি ‘কন্ট্রোল গ্রুপ’-এর থেকে উন্নতি লক্ষ করা যায় তা হলে সেই নতুন প্রয়োগ গ্রহণযোগ্য হয়। শোনা যায়, ১৯৩৫ সালে রোনাল্ড ফিশার প্রথম এই আরসিটি-র কথা উল্লেখ করেন তাঁর ‘দ্য ডিজাইন অব এক্সপেরিমেন্ট’ বইটিতে।
অর্থনীতিতে আরসিটি-র সফল প্রয়োগ এক যুগান্তকারী অবদান। বাস্তব জীবনে আরসিটি-র প্রয়োগ ও দারিদ্র্য দূরীকরণে মধ্যস্থতার মাধ্যমেই অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে এই পরীক্ষামূলক গবেষণা। মাইকেল ক্রেমার এই পদ্ধতি প্রথম প্রয়োগ করেন কেনিয়াতে। উনি লটারির মাধ্যমে স্কুল পড়ুয়াদের দু’টি ভাগে ভাগ করেন। প্রথম দলের বাচ্চাদের বিনামূল্যে বই ও খাবার দেওয়ার নীতি নেওয়া হয়। অর্থাৎ গবেষণায় এই প্রথম দলটি হল ‘ট্রিটমেন্ট গ্রুপ’। আর অন্য দলটি ‘কন্ট্রোল গ্রুপ’ যেখানে বাচ্চাদের কোনও কিছু দেওয়া হয় না। এই পরীক্ষামূলক গবেষণায় ক্রেমার দেখেন যে বাচ্চাদের মধ্যে স্কুলে যাবার প্রবণতার উন্নতি লক্ষ করা যায় যদি তাদের বিনা পয়সায় পাঠ্যপুস্তক ও খাবার দেওয়া হয়। পরে ভারতে ওই একই ফিল্ড ট্রায়াল প্রয়োগ করেন এস্থার দুফলো ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। ধাপে ধাপে এ ভাবে ফিল্ড ট্রায়াল অন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পরীক্ষিত হতে থাকে। স্বনির্ভর গোষ্ঠী, ক্ষুদ্রঋণ থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবায় টিকাকরণের প্রভাব— সব কিছুতেই আরসিটি-র প্রয়োগ করে দেখার চেষ্টা হয়। দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে দারিদ্র দূরীকরণের জন্য এই আরসিটি-র দ্বারা নির্ধারিত উপযুক্ত নীতির প্রয়োগ ক্ষমতা। তৈরি হয় ‘আব্দুল লাতিফ জামিল পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’। মূলত তৃতীয় বিশ্বে দারিদ্র দূরীকরণের পরীক্ষামূলক গবেষণায় নিযুক্ত হয় এই ল্যাবটি। পাঠকদের হাতে চলে আসে ‘পুওর ইকনমিক্স’ নামে এক অমূল্য বই। বইটিতে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো দেখান যে, দরিদ্র মানুষেরাও, অন্যদের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এবং সেই সিদ্ধান্ত বাস্তববাদী ও সময়োপযোগী হয়। এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, দরিদ্র মানুষ সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন বা তাঁদের কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই।
১৯৯৫ সালে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের মৈত্রীশ ঘটক পশ্চিমবঙ্গের অপারেশন বর্গা উপরে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ‘পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ও বামফ্রন্টের কৃষি নীতি’ শীর্ষক সেই গবেষণায় চারটি জেলায় (বর্ধমান, বাঁকুড়া, মালদহ এবং মেদিনীপুর) সমীক্ষা থেকে উঠে আসে ভূমি সংস্কারের সাফল্যের কথা। যদিও এটি গবেষণামূলক সমীক্ষার ফসল কিন্তু পরীক্ষামূলক অর্থনীতি নয়।
ভুললে চলবে না যে পরীক্ষামূলক অর্থনীতি সর্বস্তরে বা সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি ফ্লাইওভার তৈরির জন্য এই পরীক্ষামূলক অর্থনীতির প্রয়োগ অসম্ভব। বা একটি ভারী শিল্প নির্মাণের প্রাথমিক সমীক্ষা হিসেবে এই পরীক্ষামূলক অর্থনীতির কোনও বাস্তব ভিত্তি থাকে না। সুতরাং কোন একটি নীতির বাস্তব প্রয়োগ আরসিটি-র সাহায্যে সম্ভব অল্প সংখ্যক প্রতিনিধি থাকলে অর্থাৎ মাইক্রো লেভেলে।
আবার এটাও ঠিক যে নীতির গুনাগুন বিচার করার জন্য আরসিটি-র ব্যবহার হয় সেই নীতিই সবচেয়ে ভাল ও গ্রহণযোগ্য তা কখনই বলা যায় না। এমনও হতে পারে ওই একই গোষ্ঠীর উপর সেই একই পরীক্ষামূলক সমীক্ষায় অন্য কোনও নীতি আরও ভাল ফল দিতে পারে। স্থান ও সময় পরিবর্তনের ফলে সেই পরীক্ষামূলক অর্থনীতি অন্য ফল দিতে পারে।
অন্য দিকে, অর্থনীতিতে আরসিটি-র ব্যবহার খুবই ব্যয় সাপেক্ষ। অধিকাংশ সময় এই ফিল্ড ট্রায়েলের ব্যয় বহন করে কোনও সরকারি সংস্থা বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এই পৃষ্ঠপোষকদের চাহিদা ও মর্যাদাকে সমীহ করলে গবেষণার ফল পাল্টে যায়।
আরসিটি-র এত প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও এর অভিনবত্ব সত্যিই প্রশংসনীয়। বিশেষ করে আর্থসামাজিক পরিমণ্ডলে ক্ষুদ্র সংখ্যক উপভোক্তার উপরে কোন নির্দিষ্ট নীতির প্রভাব বিশ্লেষণ করায়। উল্লেখযোগ্য যে এই পরীক্ষামূলক অর্থনীতির মূল আকর্ষণ হচ্ছে নীতি নির্ধারণের সময় নিচুতলার থেকে উঠে আসা পছন্দকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এত দিন নীতি প্রণয়নের সময় উঁচুতলার পছন্দকে চাপিয়ে দেওয়া হত। নিঃসন্দেহে এটি উন্নয়নের অর্থনীতির এক নতুন দিগন্ত।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy