গল্প রহিয়াছে, জেলা জজ হইয়া নাতি ঠাকুরমাকে প্রণাম করিলে তিনি আপ্লুত হইয়া বলেন, ‘আশীর্বাদ করি দারোগা হও।’ কেন্দ্রীয় সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির ধারণাও বোধ করি ওই ঠাকুরমার অনুরূপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিচালকদের উপর দারোগাগিরি করিবার জন্য তাঁহার প্রবল আগ্রহ অবশ্য হাস্যকর নহে, ভয়ঙ্কর। বিশ্বভারতীর উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্তকে বরখাস্ত করা উচ্চশিক্ষার আকাশে অশনিসংকেত। ইহা ইঙ্গিত দিতেছে যে, এ দেশে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির সম্মান ও স্বাতন্ত্র্যে আরও আঘাত আসিবে। যাহার সীমাবোধ নাই, তাহার নিকট সুবিচার আশা করা চলে না। সৌজন্য, শোভনতা তো অতি দূরের কথা। মন্ত্রী ভুলিয়াছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি কর্মচারী নহেন। তাঁহাদের কাজের ন্যায্যতা বিচার করিবার কাজটি কখনওই মন্ত্রকের নহে। এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি স্বতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসিত। তাহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসিলে, তাহার সমাধান করিবার জন্য প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নানা বিধিব্যবস্থা রহিয়াছে। তাহাতেও কেহ সন্তুষ্ট না হইলে আদালতের দরজা খোলা রহিয়াছে। শিক্ষক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, কর্মচারীদের সংগঠনও নানা দাবি, অভিযোগ লইয়া কর্তৃপক্ষের সহিত দরদস্তুর করেন, বোঝাপড়া করেন। মতে না মিলিলে আন্দোলন হয়, পূর্বের সিদ্ধান্ত পরে বাতিলও হইয়া যায়।
এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা লইয়া বিতর্ক চলিতে পারে। কিন্তু তাহার ন্যায্যতা লইয়া প্রশ্ন নাই। মন্ত্রী সেই ন্যায্যতাকে লঙ্ঘন করিয়াছেন। নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত ও শাস্তির নিদান দিতেছে তাঁহার দফতর। সেই বিচারকার্যটাই তাঁহাদের অকর্তব্য। সুতরাং বিচারলব্ধ সিদ্ধান্ত ঠিক কি ভুল, সে প্রশ্ন উঠিতে পারে না। বিচারের এই আগ্রহকেই বরং কাঠগড়ায় তোলা যাইতে পারে। কখনও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কখনও হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কখনও বিশ্বভারতীর উপাচার্যকে অপদস্থ করিয়া মন্ত্রী হয়তো কড়া প্রশাসকের ভাবমূর্তি গড়িতে চাহেন। কিন্তু তাঁহার কীর্তি দেখিয়া লুইস ক্যারল-এর লাল পান বিবিকে মনে পড়ে, যিনি কথায় কথায় ডাক ছাড়িতেন: মাথা কাটিয়া লও।
হাতে মাথা কাটিবার এই ঝোঁক অবশ্য নূতন নহে। অনিল বিশ্বাসের আমলে আলিমুদ্দিন শিক্ষায় প্রায় সার্বিক দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। তবে বাহ্যিক বিধিব্যবস্থার আবরণ বজায় রাখিয়া আড়ালে কলকাঠি নাড়া হইত। সে কাজটিকে বামপন্থীরা শিল্পের পর্যায়ে লইয়া গিয়াছিলেন। বিজেপি অবশ্য ক্ষমতার নৃত্যে নিয়মানুবর্তিতার ঘোমটা টানিবার পক্ষপাতী নহে। কিছু লোক, যাঁহাদের অনেকেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, একযোগে উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিতেই মন্ত্রী বিচার-নাটিকার চিত্রনাট্য রচনা করিতে বসিয়া গিয়াছেন। ইহা এক ভয়ানক দৃষ্টান্ত নির্মাণ করিল। ভারতে যে কোনও প্রতিষ্ঠানই ব্যক্তিস্বার্থের আকচা-আকচিতে জীর্ণ। বিশ্বভারতীতে এই প্রবণতা বরাবরই একটু অধিক। শিক্ষক-কর্মচারীদের নিকট অপদস্থ হইতে হয় নাই, এমন কোনও উপাচার্যের কথা সম্ভবত তাহার ইতিহাসে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। যিনিই ওই প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনরীতিতে কোনও সংস্কার করিতে গিয়াছেন, তাঁহাকেই প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। অপবাদ, গুজব, ঘেরাও, মামলায় তাঁহাকে ব্যতিব্যস্ত করা হইয়াছে। গুরুদেবের দোহাই দিয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি কূপমণ্ডূক, কায়েমি ক্ষুদ্রস্বার্থের আখড়ায় পরিণত করা হইয়াছে। উপাচার্য বরখাস্ত হইবার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবিরখেলার কুরুচিকর উল্লাসের যে ছবি দেখা গেল, তাহা বিশ্বভারতীর কপালে এক নূতন তিলক আঁকিয়া দিয়াছে। কলঙ্কের তিলক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy