Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

ভাওয়াইয়া, উত্তরের ইতিহাসের ধারা

লোকসংস্কৃতি, লোকগান উঠে আসে মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাপনের মধ্য থেকে। একদিনে নয়, যুগ যুগ ধরে তার দেহ তৈরি হয়ে ওঠে। ভাওয়াইয়া গানের জন্মও একই ভাবে। মৈষালি জীবনের বিরহ-যন্ত্রণা, ঘরসংসার ছেড়ে আসার যন্ত্রণা অনূদিত হয়েছে এই ঘারার গানের সুরে-কথায়। উত্তরবঙ্গের ঐতিহাসিক এই সংস্কৃতি কেমন আছে আজ?লোকসংস্কৃতি, লোকগান উঠে আসে মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাপনের মধ্য থেকে। একদিনে নয়, যুগ যুগ ধরে তার দেহ তৈরি হয়ে ওঠে। ভাওয়াইয়া গানের জন্মও একই ভাবে। মৈষালি জীবনের বিরহ-যন্ত্রণা, ঘরসংসার ছেড়ে আসার যন্ত্রণা অনূদিত হয়েছে এই ঘারার গানের সুরে-কথায়। উত্তরবঙ্গের ঐতিহাসিক এই সংস্কৃতি কেমন আছে আজ?

তোর্সা নদী

তোর্সা নদী

অনিতা দত্ত
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৯ ০৬:৫৩
Share: Save:

প্রকৃতির অকৃপণ দান ছড়িয়ে রয়েছে উত্তরবঙ্গে। তারই ছোঁয়া উত্তরের শিল্পসংস্কৃতিতে। যেমন ভাওয়াইয়া। উত্তরবঙ্গের বিশিষ্টতার অন্যতম অভিজ্ঞান।

ভাওয়াইয়া নিম্ন-অসম ও উত্তরবঙ্গের প্রাণের গান, মাটির গান। এই গানের উৎসভূমি বাথান সংস্কৃতি। বাথান সংস্কৃতি থেকে উঠে এসেছে মৈষালি জীবন। যে মৈষালি জীবনের মধ্যে রয়েছে এই অঞ্চলের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রত্নরূপ। ধরা যাক, একজন জোতদারের অধীনে চারটে বাথান রয়েছে। এই চারটে বাথানের দেখাশোনার জন্য চারজন মৈষাল বা বাথানের তত্ত্বাবধায়ক দরকার। এই মৈষালেরা আদপে সংসারি। কিন্তু তাঁরা সংসার ত্যাগ করে একা চলে আসতেন বাথানে। এই বাথানকে কেন্দ্র করে মৈষাল-জীবনের যে বিরহ-বেদনা বা প্রেম, তারই সুরকাঠামো এবং বাণীরূপ পাওয়া যায় ভাওয়াইয়া গানে।

ভাওয়াইয়া শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, ‘ভাওয়া’ শব্দ থেকে ভাওয়াইয়ার উৎপত্তি। ‘ভাওয়া’ মানে গোচারণভূমি। এই গোচারণভূমি কেন্দ্রিক গানই ভাওয়াইয়ায় রূপ পেয়েছে।। ভাওয়াইয়া লোকসঙ্গীত। বিশ্বের যে কোনও লোকসংগীত সৃষ্টির মূলে রয়েছে ছোট ছোট ধারা-উপধারা। ধারা-উপধারাই বৃহৎ নদীর ক্যানভাস। তেমনই উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে সেই বৃহৎ নদীর নাম ভাওয়াইয়া। পরবর্তীকালে গাড়িয়াল, মৈষাল ও মানুষের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে ত্রিধারা। যে ত্রিধারার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি এবং মাতৃতান্ত্রিক ভাবনা ভাওয়াইয়ার প্রাণসত্তায় সিঞ্চিত।

ভাওয়াইয়ার জগতে বিচরণ করতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে আব্বাসউদ্দিন আর নায়েব আলির কথা। মনে পড়ে সুরেন বসুনিয়ার কথাও। উত্তরের লোকসংস্কৃতির এই ধারাকে আজও লালন করছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুখবিলাস বর্মা, দীপ্তি রায়, দুর্গা রায়, ধনেশ্বর রায়, সুমিত্রা রায়, সন্তোষ বর্মণ, জিনাত আমন, চৈতন্য দেব রায়, হৈমন্তী পাটোয়ারি, প্রতিমা দাস, নগেন শীল শর্মা, যুথিকা রায়, মনা রায় প্রমুখ।

বৃহত্তর বা অখণ্ড উত্তরবঙ্গের রংপুর, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এবং অসমের গোয়ালপাড়া জেলায় ছড়িয়ে আছে ভাওয়াইয়া গানের সুরের সুবাস। তবে, সমাজসংস্কৃতির বিবর্তনের ধারায় ভাওয়াইয়াও অনেকাংশে বিবর্তিত। পুরনো দিনের গায়কি আর তেমন খুঁজে পাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই। বদলে যাচ্ছে ভাওয়াইয়া গানের ভাষাও। তাতে স্থান পাচ্ছে পরিশীলিত বাংলা। বাহিরানা থেকে ক্রমশ ঘরমুখী হতে চলেছে ভাওয়াইয়া। ‘ভাত না চড়ায়া, ভাত না আন্ধিয়া, ভাত না বাড়িনু রে / তবু বন্ধু মোর আসিল না রে’— এখানে ‘না’ অব্যয় পদ। এই অব্যয় পদের ব্যবহার আজকের ভাওয়াইয়া গানে ক্রমশ কমে আসছে। বদল ঘটছে আবহ ও যন্ত্রানুষঙ্গেও। ভাওয়াইয়ার আদি বাদ্যযন্ত্র দোতারা, খোল আর বাঁশি। সাম্প্রতিক কালে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ লক্ষ করা যাচ্ছে। বর্তমানে ভাওয়াইয়া গানের বাণীতে উঠে আসছে রিকশা, টোটো এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতও।

লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ দীপককুমার রায় মনে করেন, ভাওয়াইয়া উত্তরবঙ্গের অতি-গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। যে সংস্কৃতির মধ্যে অবিভক্ত উত্তরবঙ্গ ও নিম্ন-অসমের সমাজ, সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্য এবং ইতিহাস জড়িয়ে আছে। উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি ও মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাওয়াইয়া সঙ্গীতধারা। এই অঞ্চলের গাড়িয়াল, দফাদার মৈষাল, মাহুতের কথা যেমন ভাওয়াইয়া গানে জড়িয়ে আছে, তেমনই স্থান পেয়েছে তিস্তা-তোর্সার উথালপাথাল ঢেউয়ের কথাও। উত্তরবঙ্গের নদীগুলি খরস্রোতা। নদীর সুর ও ছন্দে, লোকজীবনের জীবনচর্যার মধ্যে দিয়ে গীতিময় রূপজগৎ বাধা পড়েছে ভাওয়াইয়ায়। গাছগাছালি আর অরণ্যভূমি যেমন ধরা পড়েছে, তেমনই ধরা পড়েছে শস্যশ্যামলা কৃষিভূমিও, যেখানে তৈরি হয় গামছাবান্ধা দই, বিন্নিধানের চিঁড়ে। কৃষিফসলের বিস্তৃত ভাণ্ডারের সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে ভাওয়াইয়া গানের বাণীতে।

‘তিস্তানদী উথালপাথাল কার-বা চলে নাও’— উচ্চারণমাত্রে বোঝা যায়, প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে ভাওয়াইয়ার ভাণ্ডার অসম্পূর্ণ। ভাওয়াইয়ার মধ্যে নিহিত আছে রাজবংশী সমাজের ভাষা-সংস্কৃতি। এ ধারার মধ্যে নিহিত রয়েছে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক মিলিত সংস্কৃতি। অশান্ত এই সময়ে ভাওয়াইয়ার চর্চা তাই খুব জরুরি। কারণ, এর মধ্যে বাংলার আবহমান পরিচয়টি গাঁথা রয়েছে।

দুঃখের বিষয়, ভাওয়াইয়া নিয়ে আগ্রহ আজ অনেকটাই তলানিতে। আশঙ্কা ঠিক এখানেই। ইতিহাসবিস্মৃত মানুষ হতভাগ্যই! যুগের হাওয়ায় ভাওয়াইয়া সংস্কৃতি যদি হারিয়ে যায় বা বিকৃত হয়ে পড়ে, তা হলে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অস্তিত্বের সঙ্কটই গাঢ়তর হবে, ক্ষুণ্ণ হবে ঐক্যভাবনা আর সম্প্রীতি।

তাই এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রয়াস খুব জরুরি। একই সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে উত্তরবঙ্গের মানুষজনকেও। ভাওয়াইয়াকে রক্ষা করা, তাকে লালন করার প্রধান দায় এবং দায়িত্ব ভাওয়াইয়ার মাটির মানুষজনেরই।

অন্য বিষয়গুলি:

Bhawaiya song River
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy